ঢাকায় গণপরিবহনের চরম সংকটের মধ্যে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা চালুর পর দ্রুতই তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, স্বস্তি পান অসংখ্য মানুষ।
যানজটের এ নগরীতে পাঁচ লাখের মতো এবং সারাদেশে আরও ৮-১০ লাখ মোটরযান শেয়ারে চলে বলে যাত্রীকল্যাণ সমিতি বলছে। ঢাকায় ব্যক্তিগত অনেক গাড়িও শেয়ারে চলে। তবে নিবন্ধন করে উবার ও পাঠাও অ্যাপসে চলে ২৮ হাজারের মতো মোটরযান-গাড়ি।
কোভিড-১৯ অতিমারির পর অনেক বেকার আয়ের মাধ্যম হিসেবে রাইড শেয়ারিংয়ে ঝোঁকেন। আবার স্বল্প আয়ের অনেকেও বাড়তি আয়ের জন্য এটি করে থাকেন।
রাইড শেয়ারে অনেকে আয় করছেন, সেবাও নিচ্ছেন; তবে নেই কার্যকরী কোনও নীতি-ব্যবস্থাপনা। ফলে শহরের মোড়ে মোড়ে রিকশার মতো দেখা যায় এসব যানের জট।
আর এই সেবা নিয়ে যাত্রী ও চালক উভয় পক্ষের রয়েছে নানা অভিযোগ ও দাবি, তবে এর সমাধানে কার্যত কোনও সরকারি উদ্যোগ নেই।
সরকারি একটি নীতিমালা ২০১৮ সালের মার্চে কার্যকর হলেও বেশিরভাগই কার্যকর হয়নি। বর্তমানে বাইক ও গাড়ি চালকরা তাদের ইচ্ছেমতো যাত্রী আনা-নেওয়া করছে।
চালকদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষ কোনও দিকনির্দেশনা না থাকায় বিভিন্ন সংকটে পড়তে হচ্ছে বলে দাবি তাদের সংগঠন বাঁচাও রাইড-পরিষেবা ঐক্য পরিষদের।
রবিবার ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটের সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি উত্থাপন করে সংগঠনটি। সেখানে তারা সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ, কর্মের নিশ্চয়তা, কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, আইনি ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দাবি জানান।
স্বাধীন পেশা হিসেবে শুরু করলেও কেন আজ তারা শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি চান?
এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির আহ্বায়ক বেলাল আহমেদ বলেন, “সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে প্রেরিত নীতিমালায় এই পেশার সাথে জড়িত চালকদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষ কোনও দিকনির্দেশনা না থাকায় এবং অ্যাপস-ভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উপর পরিপূর্ণ তদারকি না থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বাণিজ্যিক লাভের আশায় বিভিন্ন পলিসি নিচ্ছে। তা আমাদের রাইডারদের জন্য অমানবিক এবং একই সাথে আমাদের কর্মপরিবেশকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দিচ্ছে।
“এর ফলে ছোটবাহন অর্থাৎ মোটরসাইকেলগুলো রাইড শেয়ারিং থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে এবং প্রাইভেট গাড়িগুলো ও তাদের চালকরা দিন দিন অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।”
তিনি অভিযোগ করেন, “বাহনগুলো আমাদের নিজস্ব, এর জ্বালানি খরচও আমাদের। রাস্তায় যত সমস্যা হয় তা আমাদেরই মেটাতে হয়। তারপরও এইসব কোম্পানিকে চার ভাগের এক ভাগ দিয়ে দিতে হয়।”
বেলাল আহমেদ বলেন, “আজ থেকে কয়েকদিন আগে একজন রাইডারকে পুলিশের এক কর্মকর্তা রাত দেড়টায় সাভার যাওয়ার কথা বলেন। সেই রাইডার সাভার যেতে রাজি না হওয়ায় তাকে বেধরক প্রহার করেন সেই পুলিশ কর্মকর্তা। পরে সেই ঘটনা উবারকে জানালে উবার জানায় তারা এ বিষয়ে কিছু করতে পারবে না।
“এসব কারণে আমরা শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি চাই। তাহলে কম হলেও আমাদের নিরাপত্তা থাকবে। কিছু একটা হলে আমরা জানতে পারব আমাদের কোথায় যেতে হবে,কার কাছে অভিযোগ করতে হবে।”
শেয়ারে চালানো গাড়িচালকদের বিরুদ্ধে আছে নানা অভিযোগ। তারা অ্যাপসের মাধ্যমে যোগাযোগে সাড়া দিলেও সেই ভাড়ায় গাড়ি চালাতে চান না। আবার কোম্পানিগুলোর স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধেও চালকদের অভিযোগের অন্ত নেই।
নানা অজুহাতে রাইডারদের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয় জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বেলাল বলেন, “রাইডাররা জানেও না কীভাবে কখন তার অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যায়। যাত্রীদের তথ্য আমাদের দেওয়া হয় না। এমনকি নামটাও জানানো হয় না। এতে গ্রাহকদের সাথে আমাদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।”
তিনি আরও বলেন, “এই পরিষেবার সাথে সংশ্লিষ্ট চালকদের শ্রমিক স্বীকৃতির মাধ্যমে তাদের সকল ধরনের ন্যায্যতা ফিরিয়ে দেওয়া হলে এই শিল্পটি একটি টেকসই শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে, যা টেকসই এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করবে।”
এজন্য সঠিক নীতিমালা প্রণয়নের জন্য সংবাদ সম্মেলন থেকে সংগঠনটি বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটিকে (বিআরটিএ) দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ারও আহ্বান জানায়।
যুক্তরাজ্যে উবার চালকদের শ্রমিক স্বীকৃতি
২০২১ সালে উবার চালকদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাজ্য। এই রায় দেওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্ট মূলত চারটি জিনিসকে প্রাধান্য দিয়েছিল।
সেগুলো হল- উবার ভাড়া নির্ধারণ করে, যার মানে তারা ঠিক করে যে চালকরা কতটা উপার্জন করতে পারে; উবার চুক্তির শর্তাবলী ঠিক করে এবং চালকদের সেগুলোতে কোনও বক্তব্য রাখার সুযোগ নেই; রাইডের জন্য অনুরোধ উবার ঠিক করে ও চালকরা তা প্রত্যাখান করলে তাদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতাও তারা রাখে এবং উবার স্টার রেটিংয়ের মাধ্যমে চালকদের পরিষেবা নিরীক্ষণ করে এবং বারবার সতর্ক করার পরেও যদি এটির উন্নতি না হয় তবে সম্পর্কটি শেষ করারও ক্ষমতা রাখে।
ঢাকায় কবে শুরু রাইড শেয়ারিং
ঢাকায় ২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাপের মাধ্যমে ট্যাক্সি সেবাদানকারী কোম্পানি উবার যাত্রা শুরু করে। এতে স্বস্তি পেয়েছিল অসংখ্য মানুষ।
এমনকি উবারের কার্যক্রম শুরুর পর বিআরটিএ এর কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দিলে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল সামাজিক মাধ্যমে, যার জের ধরে সরকার তাৎক্ষণিকভাবে জানিয়েছিল যে উবার বা এ ধরনের রাইড শেয়ারিং সার্ভিস বন্ধ হবে না।
শুরুর দিকে উবার ছাড়াও দেশে স্যাম, পাঠাও, আমার রাইড, মুভ, বাহন, চলো অ্যাপে, ট্যাক্সিওয়ালা, ওই খালি, ইজিয়ার, লেটস গো ইত্যাদি নামে বিভিন্ন কোম্পানি অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবার কাজ শুরু করলেও অধিকাংশই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
নীতিমালায় কী ছিল
২০১৮ সালের ১৫ জানুয়ারি শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে ‘রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা, ২০১৭’ এর অনুমোদন দেয় বিআরটিএ।
এ নীতিমালাটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয় ওই বছরেই ২৮ ফেব্রুয়ারি এবং কার্যকর হয়ে মার্চ মাসের ৩ তারিখ থেকে ।
কিন্তু এ নীতিমালার বেশিরভাগই কার্যকর হয়নি এবং বর্তমানে বাইক ও গাড়িচালকরা তাদের ইচ্ছেমত যাত্রী আনা-নেওয়া করছে। এমনকি অনেক চালক অ্যাপে না গিয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে যাত্রী সংগ্রহ করে নিজেদের পছন্দমতো ভাড়ায় পরিবহন করছে। রাইড শেয়ারিং সার্ভিস পরিচালনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু শর্ত রাখা হয়েছে নীতিমালায়। এর মধ্যে আছে:
>> প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনের মালিককে বিআরটিএতে তালিকাভুক্ত হতে হবে।
>> রাইড শেয়ারিং সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের সার্ভিস এলাকায় অফিস থাকতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অফিস তো দূরের কথা সুপরিচিত প্রতিষ্ঠান উবারে যাত্রীদের সরাসরি অভিযোগ জানানোর কোনও সুযোগই নেই।
>> যাত্রীর অভিযোগ জানানোর সুযোগ রাখতে হবে।
>> অ্যাপে এসওএস সুবিধা রাখতে হবে যাতে স্পর্শের সাথে সাথে চালক ও যাত্রীর লোকেশন ৯৯৯ নম্বরে চলে যায়।
>> অ্যাপে অভিযোগ দায়ের ও নিষ্পত্তির সুবিধা থাকতে হবে।
>> রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের কল সেন্টার প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখতে হবে। কিন্তু কার্যত এ ধরনের কোনও কল সেন্টারই নেই। ফলে যাত্রীরা যেমন গাড়ি পেতেও চালকের মর্জির ওপর নির্ভর করেন, আবার গাড়ি বা বাইকে উঠেও অনেকে দুর্ব্যবহারের শিকার হন।
কীভাবে হবে শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি
বাংলাদেশের শ্রম আইনের ২ নং ধারার ৬৫ নং উপধারা ঠিক করে দিয়েছে শ্রমিকের সংজ্ঞা। আইনে বলে আছে, “শ্রমিক” অর্থ শিক্ষাধীনসহ কোনও ব্যক্তি, তার চাকরির শর্তাবলী প্রকাশ্য বা উহ্য যেভাবেই থাকুক না কেন, যিনি কোনও প্রতিষ্ঠানে বা শিল্পে সরাসরিভাবে বা কোনও মাধ্যমে মজুরি বা অর্থের বিনিময়ে কোনও দক্ষ, অদক্ষ, কায়িক, কারিগরি, ব্যবসা উন্নয়নমূলক অথবা কেরানীগিরির কাজ করার জন্য নিযুক্ত হন।
এই সংজ্ঞায়ন অনুসারে রাইড শেয়ারের চালকরা শ্রমিক হতে পারবেন না। কারণ,তারা কোম্পানিগুলোর থেকে কোনও মজুরি নেন না। বরং তারাই কোম্পানিগুলোর একটি সেবা গ্রহণ করে তারা তাদের কাজ করেন।
এ বিষয়ে সকাল সন্ধ্যার কথা হয় শ্রম আদালতের আইনজীবী একিএম কাদেরের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে শ্রমিকের যে সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে তা মূলত কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের কথা উল্লেখ করে। সেখানে এখনও অনেক ধরনের কাজকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, যা ধীরে ধীরে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।
রাইড শেয়ারিং বিষয়টি একদম নতুন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখনও এইসব একদম নতুন। আমরা এদের কে কীভাবে দেখব, তাদের জন্য কী রকমের আইন তৈরি হবে, তা ভাবতে হবে। বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষের পেশাকে নিরাপদ করার দায়িত্ব আইনের। ফলে, রাইডারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সেটা শ্রম আইনের মধ্যে থেকেও হতে পারে কিংবা নতুন কোনও আইনের মাধ্যমেও হতে পারে।
আইনজীবী একিএম কাদের কীভাবে এই পেশাকে একটি নিয়মের মধ্যে আনা যায় তার পথ বাতলে দিয়ে বলেন, প্রথমেই বিএরটিএকে উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ এটা তাদের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে। তারপর তারা যদি আইন করতে চায় তখন তারা আইন কমিশনের সাহায্য নিতে পারে। এই দুই সংস্থা মিলিতভাবে একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করে সবার মতামতের জন্য এটি উন্মুক্ত করবে। সংযুক্তি-বিযুক্তি শেষ করে এই খসড়া নীতিমালা যাবে শ্রম বা আইন বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে। পরবর্তী সময়ে সেই খসড়া সংসদে উত্থাপন হওয়ার পর সংসদ অনুমোদন দিলে তা আইন হিসেবে ধার্য হবে।