আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েই বিভিন্ন পেশাজীবীদের দাবি-দাওয়ার মুখে পড়েছে, সেই সঙ্গে এবার যোগ হয়েছে রাজধানীর রিকশাচালকরা।
প্যাডেল রিকশার চালকরা সোমবার ঢাকার শাহবাগ মোড় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে। রিকশা নিয়ে কয়েক হাজার চালকের অবরোধে শাহবাগ মোড় অচল হয়ে পড়েছিল সকালে।
একদিন আগে আনসার বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষোভ থেকে সচিবালয় অবরোধ করলে সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষও হয়েছিল।
গত কয়েকদিন ধরে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারি আবাস যমুনার সামনেও দাবি-দাওয়া নিয়ে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের ঢল নেমেছিল। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের সড়ক ব্যস্ত রাখছে নানা সংগঠন।
তারমধ্যে রিকশাচালকদের বড় একটি অংশ নামল তাদের দাবি শোনাতে, যারা আওয়ামী লীগ সরকার হটাতে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন সাম্প্রতিক আন্দোলনে বেশ সক্রিয় ছিল।
দাবি ৭টি, মূল আপত্তি ব্যাটারি রিকশা নিয়ে
শাহবাগে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া রিকশাচালকরা সাতটি দাবি জানিয়েছে। তবে তাদের মূল দাবি ব্যাটারি-কিংবা মোটর রিকশা চলাচল বন্ধ করা, যেগুলো অটো নামেই পরিচিত।
“এই অটোগুলা এখন সব রোডে ঢুইকা পড়ে। ওগো লাইগা আমরা এখন আর যাত্রী পাই না ঠিকমতো। আবার ভাড়াও অনেক কইমা গেছে। তাই আমরা চাই, অটো যেন মেইন রোডে আইতে না পারে। আগের মতো তারা শুধু লোকাল সড়কে চললে আমাগো আপত্তি নাই,” বলছিলেন মো. সবুজ।
নওগাঁ সদর উপজেলা থেকে আসা সবুজের পাশাপাশি এই বিক্ষোভে ছিলেন মো. নুহু ইসলাম নামে আরেক রিকশাচালক।
তিনিও বলেন, “ওরা (ব্যাটারিচালিত রিকশা) আগের মতন এলাকার ভেতরের সড়কে চলুক। একেবারে বন্ধ করতে কচ্চি না। ওকেও তো চলা লাগবে, এটা আমরাও বুঝি।”
ঢাকা শহরে কত রিকশা, তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। লাইসেন্সধারী রিকশার পাশাপাশি লাইসেন্সহীন রিকশাও অনেক।
২০১৯ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, ঢাকা শহরে ১১ লাখ রিকশা চলাচল করে। পাঁচ বছরে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যাটারি রিকশা।
ব্যাটারি রিকশার অনুমোদন সরকারিভাবে না থাকলেও তা চলছে দুই দশক ধরে। তবে ঢাকায় এগুলো কেবল অলি-গলিতে চলত।
গত ১৮ মে মাসে ঢাকায় ব্যাটারি রিকশা চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু আন্দোলনের মুখে দুদিন পরই এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর থেকে ঢাকার প্রায় সব সড়কেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই রিকশাগুলো।
প্যাডেলচালিত রিকশাচালকদের ব্যাটারি রিকশা চালাতে সমস্যাটি কোথায়, তা তুলে ধরলেন নুহু ইসলাম।
তিনি বলেন, দাম বেশি হওয়ায় গ্যারেজ মালিকরা সহজে কোনও চালকের হাতে ব্যাটারি রিকশা দিতে চান না।
একটা অটোরিকশা কিনতে গেলে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা লাগে। কিন্তু প্যাডেলের রিকশার দাম ২৫-৩০ হাজার টাকার মধ্যে। পুরনো রিকশা ৫-১০ হাজার টাকায়ও পাওয়া যায়।
দাম বেশি হওয়ায় ব্যাটারি রিকশা পেতে সুপারিশ লাগে জানিয়ে নুহু বলেন, গ্রাম থেকে আসা একজনের পক্ষে সেই সুপারিশ পাওয়া সম্ভব হয় না।
তাছাড়া একটি রিকশার জন্য মালিককে দৈনিক জমা দিতে হয় ১০০-১২০ টাকা। ব্যাটারি রিকশার মালিকরা জমা নেয় ৩৫০-৪০০ টাকা। সেই কারণেও অনেকে ব্যাটারি রিকশা চালাতে চান না বলে জানান নুহু।
রিকশাচালকদের অন্য দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মতো উত্তর সিটি করপোরেশনেও রিকশা মালিকানার নতুন লাইসেন্স প্রদান ও পুরনো লাইসেন্স নবায়ন, রিকশা পেশাজীবীদের স্বার্থে সিটি করপোরেশন থেকে চালক লাইসেন্স প্রদান, অসুস্থ চালকদের ফ্রি ফ্রাইডে মেডিকেল চিকিৎসা প্রদান, রিকশা পেশাজীবীদের ব্যবসায়িক ট্রেড লাইসেন্স প্রদান, গুলশান, বনানী, বারিধারা এলাকায় প্যাডেলচালিত সব রিকশা চলাচলের সুযোগ দেওয়া, দীর্ঘকালের বাহন হিসাবে রিকশাকে জাদুঘরে স্থান দেওয়া।
এই আন্দোলনকেন্দ্রিক কিছু দাবিও রিকশাচালকদের রয়েছে। তাহলো- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে এবং আহতদের চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে দুর্নীতিবাজদের অর্থ ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে সেই অর্থ কাজে লাগানো।
ব্যাটারি রিকশার চালকদের কী প্রতিক্রিয়া
প্যাডেল রিকশার চালকদের দাবির প্রতিক্রিয়ায় ব্যাটারি রিকশার চালকরা বলছেন, যাত্রীরা তাদেরই চাইছে।
ভোলার বাসিন্দা রুবেল হোসেন আগারগাঁওয়ের তালতলা এলাকায় থেকে ব্যাটারি রিকশা চালান।
তিনি বলেন, ব্যাটারি রিকশার কারণে ভাড়া কমায় সাধারণ মানুষের উপকার হয়েছে। তাছাড়া অনেক পঙ্গু ও বৃদ্ধ মানুষের পক্ষে পায়ে টানা রিকশা চালানো সম্ভবপর নয়। তারা ব্যাটারি রিকশা চালিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে। এই রিকশা না থাকলে এসব মানুষের ভিক্ষা করা ছাড়া কোনও উপায় থাকত না।
মিজানুর রহমান নামে আরেক চালক বলেন, “এখন চলার সুযোগ আছে দেখেই আমরা সব সড়কে যাইতেছি। সরকার যদি নিয়ম করে দেয় যে মেইন সড়কে ওঠা যাবে না, তাহলে আমরা যাব না।
“তবে শুধু আমাদের চলাচল বন্ধ করলেই হবে না। চালাইতে গেলে জায়গায় জায়গায় চাঁদা দেওয়া লাগে। সেই চাঁদাবাজিও বন্ধ করা লাগব।”
যাত্রীরা কোন পক্ষে
ব্যাটারি রিকশায় ভাড়া কম ও দ্রুত যাতায়াত করার সুবিধা পাওয়ার কথা বলছেন অধিকাংশ যাত্রী।
আয়েশা সিদ্দিকা নামে মোহাম্মদপুরের এক বাসিন্দা বলেন, “পায়ে টানা রিকশায় যেখানে ৩০ টাকা ভাড়া লাগে, ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো সেখানে ২০-২৫ টাকাতেই চলাচল করে। তাছাড়া গতি বেশি হওয়ায় সময়ও কম লাগে।”
এছাড়া প্যাডেল রিকশার চেয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশার আসন কিছুটা বড় হয়। তা বসার জন্য আরামদায়ক। এছাড়া অন্য একজনকে শারীরিক কষ্ট ভোগ করতে দেখার অপরাধবোধেও ভুগতে হয় না বলে জানান যাত্রীরা।
তবে বেশি গতির কারণে এবং বেপরোয়া চালানোর কারণে পায়ে টানা রিকশার চেয়ে ব্যাটারি রিকশা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলেও মত যাত্রীদের।
আয়েশা বলেন, “ব্যাটারি রিকশাগুলো অনেক বেপরোয়া চালানোয় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি থাকে। ব্যাটারি রিকশার চালকদের মধ্যে ট্রাফিক আইন ভঙ্গের প্রবণতাও বেশি দেখা যায়।
“তাই আমার মনে হয় ব্যাটারি রিকশা বন্ধ না করে এর চালকদের প্রশিক্ষিত করতে পারলে ভালো হবে।”
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
ব্যাটারি রিকশা বন্ধের পরিবর্তে নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, এই রিকশাগুলোর জন্য একটি নকশা নির্দিষ্ট করে দেওয়া প্রয়োজন। নিরাপত্তা বাড়াতে এর নকশার সংস্কারও দরকার। পাশাপাশি চলাচলেও শৃঙ্খলা আনতে হবে।
ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অটোমোবাইল টেকনোলজি বিভাগের চিফ ইনস্ট্রাক্টর ও বিভাগীয় প্রধান (দ্বিতীয় শিফট) প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন ব্যাটারি অটোরিকশার ব্রেকিং সিস্টেমের দুর্বলতার সমাধানে বেশি জোর দিচ্ছেন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এসব অটোরিকশার মূল সমস্যা হলো এর গতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। এর গতির তুলনায় ব্রেকিং সিস্টেম কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এছাড়া এসব অটোরিকশায় ব্যবহৃত ব্যাটারির জীবনকাল খুব বেশি নয়।
“অর্থাৎ ব্যাটারিগুলো বেশিদিন ব্যবহার করা যায় না। নষ্ট হয়ে যাওয়া সেসব ব্যাটারি কীভাবে ধ্বংস করা হয়, কেউ জানি না। এসব ব্যাটারি পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে।”
এসব রিকশার গতি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রসঙ্গ টেনে মোশারফ বলেন, “আমাদের দেশে প্রচলিত ব্যাটারিচালিত রিকশার নকশা অন্যান্য পায়ে টানা সাধারণ রিকশার মতোই। সমস্যা হচ্ছে সাধারণ রিকশার ডিজাইন দ্রুত গতিতে চলার উপযোগী নয়। সাধারণ রিকশায় মোটর লাগিয়ে দ্রুতগতিতে চালানো হচ্ছে বলেই দুর্ঘটনা ঘটছে অনেক সময়।
“এসব বাহন দ্রুতগতিতে চলতে গিয়ে ব্যালান্স হারিয়ে উল্টে যায় অনেক সময়; বেশি গতির কারণে বাঁক নেওয়ার সময়ও উল্টে যেতে পারে। এছাড়া জরুরি মুহূর্তে ব্রেক কষে থামতে না পারার কারণে অন্য গাড়ি বা পথচারীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়।”
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান এই রিকশাগুলোর ঝুঁকির দিকটি বেশি দেখছেন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, দেশে প্রায় ৩০ ধরনের অটোরিকশা চলে। সেগুলোর কোনোটি ৩ জন যাত্রী পরিবহন করে, কোনোটিতে আবার ৮ জন যাত্রীও নেওয়া হয়।
“কিন্তু এসব অটোরিকশার মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয় পায়ে টানা রিকশার বডিতে মোটর লাগানো রিকশাগুলো। সাধারণ রিকশার পেছনের চাকার সঙ্গে একটি মোটর লাগানো হয়, আর যাত্রী সিটের নিচে থাকে ব্যাটারি। রিকশার হ্যান্ডেলের সঙ্গে যুক্ত একটি সুইচ। মোটর লাগিয়ে জোরে চালানোর সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এসব রিকশায় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা বেশি থাকে।”
বুয়েটের এই অধ্যাপকের চোখে, ব্যাটারি রিকশাগুলোর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এর ব্রেকিং সিস্টেম।
তিনি বলেন, “সাইকেলে বা রিকশাতে আমরা যে ব্রেক দেখি, তা হলো ‘ইউ’ ব্রেক। এই ব্রেকে চাকার দুই পাশে দুটি ব্রেক প্যাড থাকে, যা রিমকে চাপ দিয়ে গতি নিয়ন্ত্রণ করে। এই ব্রেকের কার্যকারিতা খুবই কম, ভেজা চাকায় এই ব্রেক খুবই কম কাজ করে।
“সাইকেল কিংবা পায়ে টানা রিকশার জন্য ইউ ব্রেক ঠিক আছে। দাম তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় ব্যাটারিচালিত রিকশাতেও এই ব্রেকই ব্যবহার করা হয়। এছাড়া এসব রিকশার কাঠামো ও চাকা অনেক দুর্বল, দ্রুত গতিতে চলাচলের উপযোগী নয়।”
তবে এখন এসব রিকশা একেবারে বন্ধ করা আর সম্ভবপর হবে না বলে মনে করেন হাদিউজ্জামান।
সেই কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “২০০৯-২০১০ সাল থেকে এরা (ব্যাটারি রিকশা) নিয়ন্ত্রণহীনভাবে সড়কে নেমেছে। বাড়তে বাড়তে এদের সংখ্যা এখন অনেক বেশি হয়ে গেছে। বর্তমানে সঠিক সংখ্যা কেউই বলতে পারে না। সারাদেশে ব্যাটারি রিকশার সংখ্যা কেউ বলেন ২০ লাখ, কেউবা দাবি করেন ৫০ লাখ। তাই এখন এর সঙ্গে বিশাল একটি জনগোষ্ঠির জীবন-জীবিকার বিষয় জড়িয়ে গেছে। হুট করে এসব রিকশা বন্ধ করলে অনেকেই পথে বসে যেতে পারেন।
“এছাড়া ব্যাটারি রিকশা বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ বাহন হিসেবে দেখা দিয়েছে যাত্রীদের কাছে। হুট করে এসব বন্ধ করলে যাতায়াতের জন্য বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন যাত্রীরা। এসব রিকশা বন্ধের সুযোগ নিয়ে অন্য পরিবহনগুলো ভাড়া বৃদ্ধি করতে পারে। তাতে মানুষের যাতায়াত খরচ বাড়বে। সেজন্য আমি বলব ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ নয়, নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি।”
বর্তমানে একটি অটোরিকশা তৈরি করতে এক থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। এর সঙ্গে আর ২০-২৫ হাজার টাকার বিনিয়োগ বাড়ালেই রিকশাগুলোকে নিরাপদ করা সম্ভব বলে মনে করেন বুয়েটের এই অধ্যাপক।
ব্রেক সিস্টেম ও কাঠামোগত দুর্বলতার সমস্যার সমাধান করে সেগুলোকে চলাচলের অনুমতি দেওয়া উচিৎ বলে মত দেন তিনি। সেইসঙ্গে বলেন, “তবে কোনোভাবেই এসব রিকশা মহাসড়ক বা প্রধান সড়কে চলাচলের পক্ষে নই আমি। এসব রিকশা মহল্লার ভেতরের সড়কে, কিংবা পার্শ্ব সড়কে চলতেই পারে।”