Beta
বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫
Beta
বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫

সংস্কৃতি বদলে ‘লম্বা রেসের ঘোড়া’ রিশাদ

পপপপপপপপপপপপপ
[publishpress_authors_box]

তার উচ্চতা ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি। লম্বা এই লেগ স্পিনার হতে চলেছেন বাংলাদেশের ‘লম্বা রেসের ঘোড়া’। দেশের ক্রিকেটে একজন লেগ স্পিনার যখন হাহাকারের নাম, সেখানে রিশাদ হোসেন বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচেই জিতলেন ম্যাচ সেরার পুরস্কার।

ক্যারিয়ারসেরা বোলিংয়ে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার নায়ক রিশাদই। ১৪ ওভারে ৩ উইকেটে ১০০ করা লঙ্কানরা ভিত পেয়ে গিয়েছিল ১৫০ রানের। তখনই আক্রমণে এসে টানা দুই বলে দুই উইকেট রিশাদের।

সাধারণত বাঁহাতি ব্যাটারের বিপক্ষে ডান হাতি বোলাররা কমই বল করেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে। সেই ‘রীতি’ ভেঙে বাঁহাতি চারিথ আসালাঙ্কার বিপক্ষেই বোলিংয়ে ফেরেন রিশাদ। আগের ওভারে ছক্কা মারা আসালাঙ্কা স্লগ সুইপে ডিপ ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার দিয়ে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ক্যাচ দেন সাকিব আল হাসানকে।

বল অব দ্য ম্যাচ

পরের বলটা ছিল ‘বল অব দ্য ম্যাচ’। লেগে পিচ করা বল কয়েক ডিগ্রি বাঁক খাওয়ার পর ভানিন্দু হসারাঙ্গার ব্যাট ছুঁয়ে জমা পড়ে স্লিপে সৌম্যর হাতে। হ্যাটট্রিকটা অবশ্য হয়নি। তবে ফ্লাইট ও গতি বৈচিত্র্যে দুর্দান্ত বল করা রিশাদ ১৭তম ওভারে ফেরান ধনঞ্জয়া ডি সিলভাকেও। ফ্লাইট লেগব্রেক দিয়ে প্রলুব্ধ  করেছিলেন ধনঞ্জয়াকে, তাতেই হন স্টাম্পড।

ক্যারিয়ার সেরা বোলিং ২২ রানে ৩ উইকেট নেওয়ার পথে বাঁক পেয়েছেন ৩.৪ ডিগ্রি, যা ডালাসের এই মাঠে এবারের বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ। ম্যাচ সেরার পুরস্কার হাতে অবশ্য হ্যাটট্রিক মিসের আক্ষেপ ঝড়েনি রিশাদের কণ্ঠে, ‘‘পিচ ও কন্ডিশন ভালো ছিল। আমি আমার সেরাটা দেয়ার চেষ্টা করেছি। আমি আক্রমণাত্মক ফিল্ডিং রেখে বোলিং করেছি। একটা স্লিপও রেখেছি। চেষ্টা করেছি যেন রান কম দেই। হ্যাটট্রিক বলটা নিয়ে আলাদা কোন চিন্তা ছিল না। অধিনায়ক বলছিল লাইনে রাখতে। সেটাই চেষ্টা করেছি। অটল থাকতে চেয়েছি নিজের শক্তির জায়গায়।’’

২০০৭ বিশ্বকাপে অলক কাপালীর পর এই ফরম্যাটের আরেক বিশ্বকাপে আবির্ভাবেই নায়ক হলেন রিশাদ। করলেন বাংলাদেশি লেগ স্পিনারদের মধ্যে সেরা বোলিংও। ২০২০ সালে আমিনুল ইসলামের মিরপুরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৩ ওভারে ৩৪ রানে ৩ উইকেট ছিল এতদিনের সেরা।

তামিম ইকবালের মুগ্ধতা

রিশাদের এমন বোলিংয়ে স্টার স্পোর্টসে মুগ্ধতা ঝড়ল তামিম ইকবালের কণ্ঠে, ‘‘রিশাদ আজ একদম অভিজ্ঞ একজন বোলারের মতো বল করেছে। ও বোলিংয়ে আসার আগের চারটা ওভার বাংলাদেশ খুব কম রান দেয়। তাই লঙ্কানদের ব্যাটারদের সামনে রিশাদকে টার্গেট করা ছাড়া উপায় ছিল না। রিশাদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। এবং লাইন-টু লাইন বল করেছে। এজন্য ওকে বড় শট খেলতে গিয়ে উইকেট দিয়েছে শ্রীলঙ্কান ব্যাটাররা। এটা আসলে দারুণ পরিকল্পনার সফলতা। সামনের ম্যাচ গুলোতেও রিশাদ এভাবে বল করবে বলে আশা রাখি।’’

প্রশংসা করলেন অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তও, ‘‘অসাধারণ বোলিং করেছে। শেষ কয়েকটি সিরিজ ধরেই ভালো বল করছে। ওর প্রস্তুতিও দারুণ ছিল। আমরা সবসময়ই আক্ষেপ করি যে আমাদের একজন লেগ স্পিনার নেই। ওই জায়গাটা আমাদের পূরণ হয়েছে। আমি আশা করব যে সামনের ম্যাচগুলোতে সে ওই ভাবে অবদান রাখবে।’’

মামার জুতা আর বাবার বানানো ব্যাটে শুরু

এভাবে বিশ্বকাপ মাতানো রিশাদের উঠে আসার গল্পটা রোমাঞ্চকর আর যুদ্ধ জেতার মতো। তার জন্ম উত্তরবঙ্গের নীলফামারী জেলায়। ক্রিকেটের প্রথম পাঠ নীলফামারী ছমির উদ্দিন স্কুল এন্ড কলেজে। কলেজের টানা তিন টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড় হওয়া রিশাদ অনুশীলন শুরু করেন নীলফামারীর নজরুল স্মৃতি একাডেমির হয়ে শেখ কামাল স্টেডিয়ামে।

অভাব-অটননের সংসারে তার ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাকাটা ছিল বিলাসিতা। তবে ছেলের ক্রিকেটে আগ্রহ দেখে বাবা নূর আলম ব্যাট বানিয়ে দিতেন কাঠ দিয়ে। সেই ব্যাটে খেলা যেতনা স্বাভাবিকভাবে। অভাব ছিল জুতা আর জার্সিরও। তার মামা আসাদুজ্জামান আসাদও (ডাক নাম সুইডেন) খেলতেন ক্রিকেট। সকালে তিনি যে জুতা আর জার্সি পড়তেন বিকেলে সেগুলোই দিতেন ভাগিনকে। এভাবেই বেড়ে ওঠা রিশাদের।

 নীলফামারী ছমির উদ্দিন স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক ভুবন মোহন তরফদার সকাল সন্ধ্যাকে জানালেন, ‘‘শ্রীলঙ্কা এত বেশি ক্রিকেটার পায় স্কুল থেকে। রিশাদও কিন্তু স্কুল থেকে তৈরি। শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক হিসেবে আমার হয়ত কিছুটা অবদান আছে তবে আজ এই পর্যায়ে পৌঁছানোর কৃতিত্বটা ওর বাবা আর মামার। অভাবের সংসারে এই দুজন ভীষণ সাহায্য করেছে রিশাদকে।’’

উপেক্ষা থেকে সংস্কৃতি বদলানো

২০১৭ সালে স্পিনার হান্টে অংশ নিয়ে সেরা না হলেও ছিলেন সেরা দশে। নিখুঁত নিশানার জন্য পান সেরা ‘অ্যাকুরেসি’ স্পিনারের পুরস্কার। এই স্পিনারদের নিয়ে দুটি ক্যাম্প করেছিল বিসিবি, সেখানে অংশ নিয়ে রিশাদ ২০১৮ সালে জায়গা পান অনূর্ধ্ব-১৭ দলে। এরপর হাই পারফরম্যান্সের স্পিন স্কোয়াড থেকে ‘এ’ দল হয়ে জাতীয় দলে অভিষেক গত বছর।

২০১৮ সালে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক রিশাদের। ৬ বছরের ক্যারিয়ারে প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলেছেন কেবল ১৯টি আর লিস্ট ‘এ’ ১৬টি। বাংলাদেশের ক্রিকেটে লেগ স্পিনার নিয়ে তাচ্ছিল্যই এর কারণ! অভিযোগ তারা বেশি রান দিয়ে ফেলেন।

রিশাদ বদলে দিয়েছেন ধারণাটা। লেগ স্পিনাররাও রান আটকে রশিদ খান, অ্যাডাম জাম্পাদের মত ম্যাচের নায়ক হতে পারেন, বোঝালেন ভালোভাবে। বিশ্বকাপের আগে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ম্যাচে ৪ ওভারে মাত্র ৭ রানে ১ উইকেট নিয়েছিলেন রিশাদ। ৪ ওভার বল করে বাংলাদেশি বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে কম রান দেওয়ার রেকর্ড এটা।

 বিশ্বকাপের আগে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিলেটে এক ইনিংসে মেরেছিলেন ৭ ছক্কা, সেটাও বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের মধ্যে সেরা।

এভাবে ব্যাট আর বলে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সংস্কৃতি বদলে দেওয়ার নায়ক রিশাদ। তরুণরা এখন থেকে শুধু মাশরাফি, সাকিব আর তামিম নন, হতে চাইবে নতুন রিশাদও।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত