বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য ধানের চালের সাধারণত রঙ সাদা, তবে দেশে-বিদেশে আলোচিত গোল্ডেন রাইসের রঙ হলদে-সোনালি। এটি করা হয় জিনগতভাবে রূপান্তর (জেনেটিক্যালি মডিফাইড- জিএম) করে। উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত গবেষকদের দাবি, ভিটামিন ‘এ’ ঘাটতিজনিত (ভিএডি বা ভ্যাড) সমস্যা মোকাবেলার জন্য এই ধানে পুষ্টিগুণ বাড়ানো হয়েছে।
তবে অনেক গবেষণার পরও গোল্ডেন রাইস বা সোনালি চাল ঘিরে এখনও অনেক প্রশ্ন ও নৈতিক উদ্বেগ রয়ে গেছে। ঝুঁকি ও সুবিধা মাপার পাশাপাশি, সোনালি চাল ব্যবহার করা হবে কি না—সে সিদ্ধান্ত কে নেবে, সে বিষয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির চিকিৎসাশিক্ষা কেন্দ্র এনওয়াইইউ ল্যাংগন হেল্থ একটি প্রতিবেদনে বলছে, বিরোধিতার কারণে প্রস্তাবিত সব দেশে এটি উৎপাদনে প্রকল্প এগোতে পারেনি। এখন বাংলাদেশ, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনামসহ মাত্র ১৬টি দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এটি উৎপাদনে গবেষণা চলছে।
বর্তমানে ধানটি কৃষক পর্যায়ে চাষের অনুমোদনের জন্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)।
তবে এ ঘটনায় বিশেষ উদ্বেগ জানিয়েছে দেশের পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। তারা বলছে, গোল্ডেন রাইসে ধানের স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক গঠন সংকেতে ভিন্ন জিনগত রূপান্তরে জবরদস্তি করা হয়েছে। এর ফলে এই ধান চাষে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
গোল্ডেন রাইস কী
ব্রি বলছে, গোল্ডেন রাইস হলো বিটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ এক ধরনের ধান। বিটা ক্যারোটিনের উপস্থিতির কারণে এ ধানের চাল সোনালি বর্ণের হয়ে থাকে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ভুট্টা থেকে একটি জিন ধানে সন্নিবেশ করে গোল্ডেন রাইস উদ্ভাবন করা হয়েছে। উদ্ভাবকদের দাবি, গোল্ডেন রাইসের বিটা ক্যারোটিন মানুষের শরীরে প্রয়োজন অনুযায়ী ভিটামিন ‘এ’ তে রূপান্তরিত হয়।
সুস্থ ত্বক, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও দৃষ্টিশক্তির জন্য আমাদের ভিটামিন ‘এ’ এর প্রয়োজন।
গোল্ডেন রাইস কীভাবে, কারা উদ্ভাবন করে
যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা ফোর্ড ও রকফেলার ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ১৯৬০ সালে ফিলিপিন্স সরকার দেশটির লস বানোসে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) প্রতিষ্ঠা করে।
ইরির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, রকফেলার ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে গোল্ডেন রাইস উদ্ভাবনে ১৯৮২ সালে গবেষণা শুরু করেন সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ইমেরিটাস অধ্যাপক ইঙ্গো পোট্রিকাস এবং জার্মানির ফ্রাইবুর্গ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক পিটার বেয়ার। এর ১০ বছর পর ১৯৯২ সালে নিউ ইয়র্কে বিভিন্ন দল একত্রিত হয়ে প্রকল্পটি এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে ড্যাফোডিল ও সাধারণ মাটির ব্যাকটেরিয়া থেকে জিন প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে ১৯৯৯ সালে ধানে বিটা ক্যারোটিন উপস্থিত করতে সফল হয় গবেষকরা।
এরপর গোল্ডেন রাইসের উদ্ভাবকরা সিনজেনটা ও অন্যান্য বিজ্ঞানীদের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে একটি উন্নত সংস্করণ তৈরি করেন। এই উন্নত সংস্করণটি ভুট্টা থেকে একটি জিন ও একই মাটির মাইক্রোঅর্গানিজম যোগ করে তৈরি করা হয়। এটির বিটা ক্যারোটিনের মাত্রা প্রথম সংস্করণের চেয়ে ২০ গুণ বেশি। ভিটামিন ‘এ’ এর ঘাটতি রোধে সাহায্য করার জন্য ২০০৪ সালে গোল্ডেন রাইস নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গবেষকরা নতুন এই সংস্করণটি ফিলিপিন্স, বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়াসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে দান করে।
আরেক মার্কিন সংস্থা বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ও ইরির নেতৃত্বে বর্তমানে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশ, ফিলিপিন্স ও ইন্দোনেশিয়ায় গোল্ডেন রাইসের জাত উদ্ভাবন এবং মূল্যায়নের কাজ পরিচালিত হচ্ছে। এসব দেশের জনপ্রিয় ধানের জাতের গোল্ডেন রাইস উদ্ভাবন ও মূল্যায়নের কাজ এগিয়ে চলছে।
সাধারণ চালের সঙ্গে গোল্ডেন রাইসের পার্থক্য কোথায়
ইরি বলছে, গোল্ডেন রাইস হলো নির্দিষ্ট পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ সাধারণ ধানের উন্নত সংস্করণ, আর এর স্বাদ ও উৎপাদন খরচ পার্থক্য নেই। তবে এর বিটা ক্যারোটিন এমনই মূল্যবান, যা ভিটামিন ‘এ’ এর ঘাটতিজনিত রোগ প্রতিরোধে লড়াই করে। শরীরের গড়ন, বিকাশ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও চোখ সুস্থ রাখার জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান হচ্ছে ভিটামিন ‘এ’। এর ঘাটতি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে দেয়; যে কারণে মানুষ অন্ধ, এমনকি সঠিক চিকিৎসা না করালে মৃত্যুও হতে পারে।
বাংলাদেশ ও ফিলিপিন্সের মতো যেসব দেশে প্রায় প্রতি বেলা ভাত খাওয়া হয়, সেখানে বিটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ গোল্ডেন রাইস ভিটামিন ‘এ’ এর গড় প্রয়োজনের ৩০-৫০ ভাগ পর্যন্ত চাহিদা মেটাতে পারে। এটি বিশেষ করে ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শিশু (প্রাক-বিদ্যালয় বয়সী) এবং গর্ভবতী ও বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের জন্য উপকারী বলে দাবি ইরির।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ভিটামিন ‘এ’ এর ঘাটতিজনিত রোগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্কুল যাওয়া শুরু করেনি এমন বয়সী প্রায় ২৫ কোটি শিশু আক্রান্ত। এমন প্রায় ২৭ লাখ শিশুকে ভিটামিন ‘এ’ এর সাপ্লিমেন্ট রক্ষা করতে পারে।
বিরোধীদের যুক্তি
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গোল্ডেন রাইস নিয়ে উদ্বেগের পেছনে স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকিসহ বিভিন্ন কারণ তুলে ধরা হয়েছে। নেদারল্যান্ডসভিত্তিক পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনপিস এ বিষয়ে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেছে।
বলা হচ্ছে, গোল্ডেন রাইসে দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে, যেমন- অ্যালার্জি, ক্যান্সার ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ।
আর বড় ধরনের পরিবেশগত ঝুঁকির কথাও বলছে অনেক। বিরোধীরা বলছে, জিনগতভাবে পরিবর্তিত ধানের জীবাণু প্রাকৃতিক জাতের সঙ্গে মিশে যেতে পারে এবং জীববৈচিত্র্য হ্রাস করতে পারে।
বৈষম্য ও নিয়ন্ত্রণ নিয়েও দুশ্চিন্তার কথা বলছে অনেকে। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বীজের উপর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে এবং তাদের উপর নির্ভরতা বাড়তে পারে কৃষকদের।
এছাড়া উঠছে নৈতিক প্রশ্নও। জিনগতভাবে পরিবর্তিত খাদ্য গ্রহণ করা নৈতিক কি না—তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
গোল্ডেন রাইস নিয়ে দেশে আপত্তি কাদের ও কেন
বাংলাদেশের কৃষিতে জিনগতভাবে রূপান্তর বা জিএম প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রয়োজন আছে কি না—তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠছে।
গোল্ডেন রাইস প্রবর্তনের অব্যাহত চেষ্টার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), নয়াকৃষি আন্দোলন, নাগরিক উদ্যোগ ও জিএম বিরোধী মোর্চা।
এ বিষয়ে গত ৬ মে জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিক, পরিবেশ ও কৃষক সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভারও আয়োজন করে সংগঠনগুলো। সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন উবিনীগের প্রধান নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার। স্বাগত বক্তব্য দেন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে গোল্ডেন রাইস প্রবর্তনের চেষ্টা চলছে অভিযোগ করে বক্তারা।
তারা বলেন, গোল্ডেন রাইস একটি জেনেটিক্যালি মডিফাইড ফসল। ধানের স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক গঠন সংকেতে জোর করে ভিন্ন ‘জিন’ প্রবিষ্ট করানো হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ব্রি) এই গবেষণা করেছে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইরি) অধীনে। তাই এটাকে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলা যাবে না।
সভায় তুলে ধরা মূল প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ব্রি ধান-২৯ ধানের সঙ্গে ফিলিপিন্সের আই আর-৬৪ ও আর সি-২৮ জাতের সঙ্গে ভুট্টার জিন যুক্ত করে বিটা ক্যারোটিন যুক্ত নতুন জাত সৃষ্টি করা হয়েছে। ধানটির চাল সোনালি রংয়ের বলে এর নাম দেওয়া হয়েছে গোল্ডেন রাইস, যার স্বত্ব সিনজেনটা কোম্পানির কাছে।
এখানে বলে রাখা দরকার, সিনজেনটার প্রধান কার্যালয় সুইজারল্যান্ডের বাসেলে। এটি মূল প্রতিষ্ঠান সিনজেনটা গ্রুপের পুরোপুরি মালিকানা রয়েছে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সিনোচেমের হাতে। বাংলাদেশে সিনজেনটার কার্যক্রম চলছে ৫০ বছর ধরে। তবে সিনজেনটা প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ ৯০টির বেশি দেশে তাদের গবেষণা কার্যক্রম চালাচ্ছে।
৬ মে সভার মূল প্রবন্ধে আরও বলা হয়, জিএম ফসল হিসেবে গোল্ডেন রাইসের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংক্রান্ত ঝুঁকি, কার্যকারিতা এবং এই ধানের আদৌ কোনও প্রয়োজনীয়তা আছে কি না—সেসব প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর এখনও মেলেনি।
সময় নিয়ে এই ধানের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করায় এবং এখনও অনুমোদন না দেওয়ায় পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানায় মতবিনিময় সভা আয়োজনকারী সংস্থাগুলো। তবে তারা এটাও অভিযোগ করে, কোম্পানি ও উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে তাড়া দেওয়া হচ্ছে। সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তারেরও চেষ্টা চলছে।
বিশ্বে গোল্ডেন রাইস নিয়ে বিতর্ক চলার কথা প্রবন্ধে উঠে আসে। সেখানে বলা হয়, ফিলিপাইনে অনুমোদন দেওয়া হলেও পরে তা বাতিল করা হয়েছে। ফিলিপাইনের কৃষকরাও এর বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলছেন।
লিখিত প্রবন্ধে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক ব্রি-২৯ চাষ করেন। সেখানে কারও কোনও পেটেন্ট নেই। কৃষক এই ধানের বীজ নিজেই রাখে, কিংবা বাজার থেকে কিনে নেয়। স্বাধীনভাবেই তারা এই ধান চাষ করতে পারে।
তাহলে ধানের স্বত্ব কেন বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দিতে হবে? স্বত্ব চলে গেলে দেশের লাখো-কোটি কৃষকের ভাগ্যে কী ঘটবে? এসব প্রশ্নও উঠে আসে আলোচনায়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে এসব প্রশ্নের জবাবও চান উপস্থিত বক্তারা।
উবিনীগের নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদা আখতার বলেন, “দাবি করা হচ্ছে এবং প্রচার চালানো হচ্ছে, গোল্ডেন রাইস ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ। বলা হচ্ছে, এর মধ্যে ক্যারটিনয়েড রয়েছে, যা মানুষের শরীরে হজম হতে গিয়ে ভেঙে ভিটামিন এ-তে রূপান্তরিত হয়। এটা অনুমান। যদি অনুমান সত্যি বলেও ধরে নেওয়া হয়, তাহলে জানতে হবে এই ভাত খেলে কী পরিমাণ ক্যারোটিনয়েড ভাত থেকে আলাদা করে শরীর গ্রহণ করতে পারে এবং তা ভেঙে রূপান্তর ঘটিয়ে কী পরিমাণ ভিটামিন ‘এ’ বানাতে সক্ষম হয়।”
বিভিন্ন অনুমাননির্ভর তথ্য নিয়ে আশঙ্কা তুলে ধরা হয় মূল প্রবন্ধে। সেখানে আরও উল্লেখ করা হয়, এই ধান ঘরে রাখলে, গুদামজাত করলে এবং রান্নার পরে শেষ পর্যন্ত কী পরিমাণ ক্যারোটিনয়েড টিকে থাকবে, সে বিষয়ে তথ্য উপাত্তও নেই।
বক্তারা বলেন, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এই গোল্ডেন রাইসকে পুষ্টির একটি মাধ্যম দেখিয়ে দাতব্য কাজের উদাহরণ সৃষ্টি করতে চাইছে। তাদের দাবি, ভিটামিন ‘এ’ ঘাটতি এবং রাতকানা রোগ থেকে বাঁচতে এই ধানের ভাত খেতে হবে। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন ‘এ’ বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যের সাধারণ উৎসের মধ্যেই আছে। তাহলে কেন অহেতুক দেশের একটি প্রচলিত ধান বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দিতে হবে—সে প্রশ্নও উঠে আসে।
প্রবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশ ধানের আদি নিবাস। ১৯১৫ সালে এদেশে ১৫ হাজার জাতের ধান ছিল। এখনও কমপক্ষে সাড়ে সাত হাজার জাতের জাত ধান দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানেই আছে, কৃষকদের হাতেও আছে তিন হাজার জাতের ধান। এ অবস্থায় বাংলাদেশের মানুষের জন্য নতুন জাতের ধানের প্রয়োজন আছে কি না, সে প্রশ্ন রয়েছে।
ধানের দেশে ধানের ওপর ‘জিন কারিগরি’ কোনও দায়িত্বশীল আচরণ হতে পারে না বলে অভিমত তুলে ধরেন বক্তারা।
জিএম ফসল প্রবর্তনের ঝুঁকি যে বিশাল ও মারাত্মক হতে পারে, সেটা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানী ও নীতি নির্ধারক মহলে সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বাংলাদেশে সেটিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর।
যা বলছেন ব্রির গবেষক
পরিবেশগত নিরাপত্তা যাচাইয়ের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী গোল্ডেন রাইসের নিয়ন্ত্রিত-মাঠ-মূল্যায়নের কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবি করেছে ব্রির গবেষকরা। তারা বলছেন, এ পরীক্ষা চলাকালে পরীক্ষাস্থলের পরিবেশ সংশ্লিষ্ট অনুঘটকের উপর গোল্ডেন রাইসের প্রভাব পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা হয়েছে। এ কাজে ইরি ও তার কতিপয় আন্তর্জাতিক সহযোগী প্রতিষ্ঠান ব্রি-কে সহায়তা করছে। কৃষক ও ভোক্তা পর্যায়ে প্রাপ্যতা অনুমোদনের জন্য ব্রি গোল্ডেন রাইসের খাদ্যমান এবং পরিবেশগত নিরাপত্তা সম্পর্কিত তথ্য ও উপাত্ত সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছে।
এ বিষয়ে ব্রির উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আবদুল কাদেরের সঙ্গে কথা হয় সকাল সন্ধ্যার।
২০১৫ সাল থেকে গোল্ডেন রাইসের প্রধান গবেষক হিসেবে কাজ করা এই বিজ্ঞানী বলেন, “প্রয়োজনীয় সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে গোল্ডেন রাইসের জৈব নিরাপত্তা বিষয়ক অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। সব ধরনের পরীক্ষাতেই গোল্ডেন রাইস খাদ্য হিসেবে নিরাপদ ও পরিবেশসম্মত বলে প্রমাণিত হয়েছে। এরপরও কেন পরিবেশবিদরা এর বিরোধিতা করছেন জানি না।
“পরিবেশবিদরা যে বলছেন গোল্ডেন রাইস পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, কিংবা খাদ্য হিসেবে নিরাপদ নয়, সে বিষয়ে তাদের কোনও গবেষণা কিংবা দালিলিক প্রমাণ কি আছে? যদি থাকে তাহলে তারা সেটা দেখাক। শুধু মুখে মুখে ক্ষতিকর দাবি করলে তো হবে না।”
তিনি বলেন, “এর আগেও হাইব্রিড ফসল কিংবা উচ্চফলনশীল (উফশী) জাতের ধান নিয়েও পরিবেশবাদীরা বিরোধিতা করেছেন। এমনকি যখন ভূগর্ভস্থ পানি তোলার বিষয় এসেছিল, তখনও এর বিরুদ্ধে সরব ছিলেন তারা। সে সময় যদি তাদের বিরোধিতার কারণে আমরা এসব কাজ থেকে বিরত থাকতাম, তাহলে এখন দেশের খাদ্য নিরাপত্তার কী অবস্থা হতো, দেশ কি কখনও খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন হতে পারতো?”
গোল্ডেন রাইস অনুমোদন পেলে ধানের বীজের নিয়ন্ত্রণ বহুজাতিক কোম্পানির হাতে চলে যাবে- এ কথা পরিবেশবাদীরা বলার চেষ্টা করছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তাদের এই বক্তব্য একেবারেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। কারণ, অন্যান্য জাতের ধানের মতোই গোল্ডেন রাইসের বীজও কৃষকরা নিজেরাই উৎপাদন করতে পারবেন। অন্যান্য ধানের মতো এই ধানেরও সারাজীবনই বীজ হবে। তাহলে বীজের নিয়ন্ত্রণ বহুজাতিক কোম্পানির হাতে যাবে কীভাবে?”