উখিয়ার আশ্রয় শিবির থেকে মঙ্গলবার ভোরে গ্রেপ্তার করা হয় এক রোহিঙ্গাকে, তার কাছে পাওয়া গিয়েছিল একটি বন্দুক ও গুলি। তার আগে রাতেই উখিয়ায় আরেক শিবিরে এক পক্ষের হামলায় নিহত হন এক রোহিঙ্গা।
মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধের জেরে সীমান্তে উত্তেজনার মধ্যে সীমান্ত জেলা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে অস্ত্রের ঝনঝনানি নিয়ে শঙ্কিত স্থানীয় বাংলাদেশিরা।
ওপারের যুদ্ধ এরই মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে বাংলাদেশ সীমান্তে, গোলা-বুলেট উড়ে এসে পড়ছে। তাতে হতাহতও হচ্ছে। সীমান্ত পেরিয়ে এসেছে মিয়ানমারের কয়েকশ নাগরিক, যাদের মধ্যে দেশটির সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সদস্যই বেশি।
এই উত্তেজনার মধ্যে কিছু অস্ত্রধারী রোহিঙ্গাও শরণার্থী শিবিরে ঢুকে পড়েছে বলে স্থানীয়দের ভাষ্য। রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র দল নবী হোসেনের অনুসারীরা মঙ্গলবার ভোর ও রাতে ক্যাম্পে ঢুকেছেন বলে দাবি করছেন উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আলতাজ হোসেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে এখনও নবী হোসেনের কথা নিশ্চিত করা না হলেও বেশ কিছু অস্ত্রধারী স্থানীয়দের হাতে ধরা পড়েছেন বলে স্বীকার করা হয়েছে।
জাতিগত নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে ১৩ লাখের মতো রোহিঙ্গা। তাদের বেশিরভাগই আছেন কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার আশ্রয় শিবিরে।
২০১৭ সালে রাখাইন প্রদেশে সেনা-বিদ্রোহী সংঘর্ষের পর যে দমন অভিযান চলে, তাতে সীমান্তে নামে রোহিঙ্গাদের ঢল। প্রথমে বাংলাদেশ সীমান্ত আটকে রাখলেও পরে খুলে দিলে একবারেই চলে আসে ৭ লাখের মতো রোহিঙ্গা।
তবে এই রোহিঙ্গাদের ভার বহন করা এখন বাংলাদেশের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে বলে সরকারের তরফে বলা হচ্ছে। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গা শিবিরে খুনোখুনি তৈরি করছে উদ্বেগ। গত ছয় বছরে দুইশর মতো রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে, মাদক কারবারও চলছে সেখানে।
সেনাশাসিত মিয়ানমারে এখন চলছে গৃহযুদ্ধ। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো এক হয়ে লড়ছে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে। আর এবার লড়াইয়ের চিত্র ভিন্ন, মার খেতে দেখা যাচ্ছে সরকারি বাহিনীকে।
এরমধ্যেই বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সশস্ত্র দলের সদস্যদের অনুপ্রবেশের খবর পাওয়া যাচ্ছে। রাখাইনে যে বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মি সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রয়েছে, তাদের সমর্থন দিচ্ছে মিয়ানমারে থাকা রোহিঙ্গাদেরই সশস্ত্র সংগঠনগুলো।
উখিয়া সীমান্তের পালংখালীর ইউপি সদস্য আলতাজ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেনের দলটি সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে থাকার কথা শোনা যেত। রহমতবিল সীমান্তের ওপারে এসব সন্ত্রাসীরা আস্তানা করে ছিল।
“সংঘাতের ঘটনার পর সেই গোষ্ঠিটি অস্ত্রসহ অনুপ্রবেশ করেছে। গতকাল (মঙ্গলবার) ভোর ও রাতে অন্তত ৫০-৬০ জন অস্ত্র নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকে গেছে।”
এই চক্রের ৩০-৩৫ জন অস্ত্রধারী রোহিঙ্গাকে স্থানীয়রা আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে বলে জানান তিনি।
কে এই নবী হোসেন
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়াদের একজন নবী হোসেন। রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের ঢেকিবনিয়ার মোস্তাক আহমদের ছেলে তিনি। নবী হোসেন উখিয়ার বালুখালী ৮ নম্বর ক্যাম্পের বি ব্লকের ৪১ নম্বর ঘরে থাকতেন। তখনই একটি অপরাধ চক্র গড়ে তোলেন তিনি। পুলিশ ও রোহিঙ্গাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নবী হোসেনের এক ভাই ভুলু ক্যাম্প-৮ পশ্চিমের ডি ব্লক এবং আরেক ভাই মোহাম্মদ কামাল বি-৪১ ব্লকের মাঝির দায়িত্বে ছিলেন। রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসার হুমকিতে এখন তারা আত্মগোপনে। বালুখালী এলাকার চারটি ক্যাম্প (ক্যাম্প-৮ পশ্চিম, ৯, ১০ ও ১৪) নবী হোসেন বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে বলে খবর পাওয়া যায়। এই বাহিনী মাদক পাচার, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িত হিসেবে চিহ্নিত। নবীর বিরুদ্ধে পাঁচটি হত্যা মামলাসহ অন্তত ১২টি মামলা রয়েছে বাংলাদেশে। ২০২২ সালে মার্চে উখিয়া ও টেকনাফে নবী হোসেনকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে পোস্টার সেঁটেছিল বিজিবির কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়ন। সেই পোস্টারে জঙ্গলের ভেতরে অস্ত্র হাতে দাঁড়ানো নবী হোসেনের ছবি ছাপানো হয়। এর পরপরই নবী হোসেন পালিয়ে গিয়েছিলেন মিয়ানমারে। তবে ওখানে বসেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অপরাধ চক্র নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রহমতবিল, ধমনখালী এলাকার কয়েকজন জানিয়েছেন, নবী হোসেনের দলের লোকদের হাতে ভারী অস্ত্র দেখা গেছে।
পালংখালীর ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মঙ্গলবার রহমতবিল, আনজুমানপাড়া সীমান্ত দিয়ে অনেকে পালিয়ে এসেছে। এদের বেশিভাগই বিজিবি হেফাজতে অস্ত্র জমা দিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। এর বাইরে আরও ৩০ জনের বেশি অস্ত্রধারী রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে।”
এর বাইরে কিছু অস্ত্রধারী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকে পড়েছেন বলে খবর পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি প্রশাসনকে জানানো হয়েছে।
মিয়ানমারে নতুন সংঘাতের পর গত কয়েকদিনে মোট ৩২৮ জনের বাংলাদেশে আসার কথা সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি জানিয়েছে। তার অধিকাংশই মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিপির সদস্য।
সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে আসা এরা সবাই বিজিবির হেফাজতে রয়েছে। তবে তার বাইরেই অস্ত্রসহ যে ৩০-৩৫ জনকে স্থানীয়রা আটক করেছে, তাদের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির একটি স্কুলে রাখা হয়েছে বলে এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান।
৩২৮ জনের বাইরে আর কাউকে আটক করা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে কোনও তথ্য দিতে পারেননি বিজিবির সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহাফুজুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যার প্রশ্নে বলেন, পালিয়ে আসাদের মধ্যে মিয়ানমারের বিজিপি, সেনা সদস্যসহ অন্যান্য কর্মকর্তা রয়েছেন। এর বাইরে কিছু সংখ্যক মানুষ রয়েছে, যাদের পরিচয় শনাক্তের কাজ করছে বিজিবি।
“ওখানে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী থাকলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি রোহিঙ্গা বা অন্যান্য কেউ থাকে, তাদের অবশ্যই মিয়ানমারের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া করবে বিজিবি,” বলেন তিনি।
ক্যাম্পে ঢুকে পড়ার খবর নিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, “রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কারও প্রবেশ করার তথ্য আমার কাছে নেই।
“বিষয়টি সত্য হলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঝুঁকি বাড়বে। এব্যাপারে ক্যাম্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত এপিবিএনসহ অন্যান্য বাহিনীর সাথে আলাপ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের জন্য আশ্রয় শিবির রয়েছে মোট ৩৩টি, এর ২৬টি উখিয়ায়। এসব ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্ব এপিবিএনের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দুজন নেতা বলছেন, মঙ্গলবার রাতে নবী হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল অস্ত্রসহ ক্যাম্পে ফিরেছে। তারা ক্যাম্পের পশ্চিমে পাহাড়ে নতুন করে আস্তানা গেঁড়েছে।
বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ৮ এপিবিএনের সহ অধিনায়ক পুলিশ সুপার খন্দকার ফজলে রাব্বি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, মঙ্গলবার রাত থেকে নবী হোসেন ও তার দলের মিয়ানমার সীমান্ত অতিক্রমের খবর তারা শুনেছেন। তবে ক্যাম্পে ঢোকার খবরটি তার জানা নেই।
“সে ক্যাম্পে প্রবেশ করতে পারে, এমন আশঙ্কায় সর্বোচ্চ সর্তকতা পালন করা হচ্ছে। তাকে পাওয়া মাত্রই গ্রেপ্তার করা হবে। এছাড়া সন্ত্রাসীসহ ক্যাম্পে যাতে কেউ প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য এপিবিএন সজাগ রয়েছে।”