কয়েক লাখ ছিল আগে থেকেই, সাত বছর আগে রাখাইনে সেনা অভিযানের মুখে বাংলাদেশ সীমান্তে নামে রোহিঙ্গাদের ঢল, তাতে এক মাসেই শরণার্থীর সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যায়। এবার ওপারে সংঘাতের মধ্যে আবারও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে খবর আসছে।
মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ চলছে কয়েক বছর ধরে। তার মধ্যে বাংলাদেশ লাগোয়া রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে তুমুল সংঘাতের আঁচ পাওয়া যাচ্ছে কয়েক মাস ধরে।
এর মধ্যেই কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে, এমন খবর দিয়েছে রয়টার্স।
বাংলাদেশের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার, অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান রয়টার্সকে জানিয়েছেন, কক্সবাজার এলাকার শরণার্থী শিবিরগুলোতে কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গার আশ্রয় নেওয়ার খবর তিনি পেয়েছেন।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গার অধিকাংশই রয়েছে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে। নতুন করে অনুপ্রবেশের কারণে সেখানে এখন সংখ্যাটি বাড়ছে।
মিজানুর বলেন, “কিছু রোহিঙ্গা বিভিন্ন উপায়ে বাংলাদেশে ঢুকতে সক্ষম হয়েছে এবং বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে।”
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানরা গত কয়েক দশক ধরেই নিপীড়নের মুখে রয়েছে। আর তাতে অনেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
সর্বশেষ ২০১৭ সালে দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের উপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে বিপুল সংখ্যক মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
মিয়ানমারের সেনাদের হাতে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গার দলে দলে বাংলাদেশে আসতে থাকেন আশ্রয়ের জন্য। সেসময় প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। বাংলাদেশ প্রথমে রাজি না হলেও পরে মানবিক কারণে সীমান্ত খুলে দিয়েছিল।
ওই রোহিঙ্গাদের টেকনাফের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচরেও পাঠানো হয়েছিল।
দীর্ঘদিন ধরে বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর ভার বহন করে আসা বাংলাদেশের সরকার এরপর আর কোনও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় না দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল।
রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর চেষ্টাও চালানো হচ্ছিল বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ েথকে। কিন্তু ২০২১ সালে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান ও গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সে প্রক্রিয়া থেমে যায়।
গত বছরের নভেম্বর থেকে রাখাইন রাজ্যের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মিও যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাতিল করে সেনা সরকারের সঙ্গে লড়াই শুরু করে। এতে রাখাইনের রোহিঙ্গারা ফের বিপাকে পড়ে।
সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদেরকে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য করে। ফলে আরাকান আর্মিও রোহিঙ্গাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরাকান আর্মি এরই মধ্যে রাখাইনের ৯টি প্রধান শহরাঞ্চল দখল করে নিয়েছে। গত মাসের শেষদিকে আরাকান আর্মি বুথিডং শহরসহ এর আশেপাশের এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়।
এসময় আরাকান আর্মির যোদ্ধারা রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা চালায় বলে অভিযোগ উঠে। যদিও আরাকান আর্মি সে অভিযোগ অস্বীকার করে।
বুথিডংয়ের পর আরাকান আর্মি বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মংডু ও এর আশেপাশের এলাকায় অভিযান শুরু করে। গত রবিবার আরাকান আর্মি মংডুর বাসিন্দাদের হামলার আগেই সরে যাওয়ার বার্তা দিয়েছে।
কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারাসহ একজন রোহিঙ্গা নেতা এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান বলেছেন, চলাচলের রাস্তাগুলো অবরুদ্ধ হওয়ায় মংডুর বাসিন্দাদের পালিয়ে যাওয়ারও উপায় নেই।
ওই এলাকায় প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা আটকা পড়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মিজানুর রহমান রয়টার্সকে বলেন, তিনি রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে খবর পেয়েছেন যে আরাকান আর্মির হামলায় বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মংডুতে আরও রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হতে পারে।
তিনি বলেন, “বিভিন্ন সংস্থা থেকে আমি চিঠি পাচ্ছি। বিশেষ করে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) থেকে। তাদের অসহায় পরিস্থিতি সম্পর্কে এবং তারা কীভাবে আটকা পড়েছে। তারা বাংলাদেশে আসতে চায়। তাদের সুরক্ষা দরকার।”
বৃহস্পতিবার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মংডুর একজন বাসিন্দাও রয়টার্সকে বলেন, কিছু শহরবাসী বিমান এবং গোলা হামলার ভয়ে কাছাকাছি গ্রামে চলে গেছে। আরাকান আর্মি কাছাকাছি চলে এসেছে। ইতোমধ্যে গোলা হামলায় কিছু মানুষ আহতও হয়েছে।
রয়টার্স ইউএনএইচসিআরকে তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্যের জন্য ইমেইল করলেও কোনও জবাব পায়নি।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্যের জন্য রয়টার্সের করা ইমেইলের জবাব দেয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বাংলাদেশের নীতিতে কোনও পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের ঢুকতে না দেওয়ার সিদ্ধান্তই বহাল রয়েছে।
তথ্যসূত্র : রয়টার্স