মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের বিভিন্ন গ্রাম ও উদ্বাস্তু শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের চলাফেরায় স্বাধীনতা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে সেনাবাহিনীতে নেওয়ার চেষ্টা করছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। মানবাধিকার কর্মীদের আশঙ্কা, দেশটিতে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের চলমান গৃহযুদ্ধে রোহিঙ্গাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে।
দ্য ইরাবতীর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি রাখাইন প্রদেশের রাজধানী সিত্তে ও বুথিডং শহরের কিছু উদ্বাস্তু শিবির ও আশেপাশের গ্রাম থেকে অন্তত ৪০০ রোহিঙ্গাকে দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণের জন্য সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটিতে পাঠানো হয়েছে। প্রদেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য তাদেরকে জোরপূর্ক ও লোভ দেখিয়ে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা নে সান লুইন বলেন, “প্রশিক্ষণের সময়কাল মাত্র দুই সপ্তাহ। এতো অল্প সময় প্রশিক্ষণ দিয়ে কাউকে দিয়ে যুদ্ধ করানো সম্ভব না, শুধু মানব ঢাল হিসেবেই ব্যবহার করা সম্ভব।”
মিয়ানমারের জান্তা সরকার দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ করতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন প্রদেশসহ চীন সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলোর কয়েকটি অঞ্চলে তারা বিদ্রোহীদের হাতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জান্তা সরকার সম্প্রতি মিয়ানমারের তরুণদের বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগদানের একটি আইন কার্যকর করেছে।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ওই আইন কার্যকর করার পর দেশজুড়ে তরুণদের সেনাবাহিনীতে যোগদানে বাধ্য করা হচ্ছে। তার অংশ হিসেবেই রোহিঙ্গাদেরও সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। অথচ জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবেই স্বীকার করে না। তবে এবার যুদ্ধে যোগ দেওয়ার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার লোভও দেখানো হচ্ছে।
জান্তার বাহিনী রোহিঙ্গা পুরুষদের বলছে, তারা সেনাবাহিনীতে চাকরি করলে প্রত্যেককে এক বস্তা করে চাল, একটি নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র এবং মাসিক ১ লাখ ৫০ হাজার কিয়াট (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭৮৪০ টাকা) করে বেতন দেওয়া হবে।
সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদানের আইন মিয়ানমারে ২০১০ সালে প্রথম পাস হয়েছিল। তবে সে সময় এটি কার্যকর করা হয়নি। আইনটি এখন এমন সময় কার্যকর করা হয়েছে যখন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ব্যাপক বেসামাল পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। মিয়ানমারের স্বাধীনতার ৭৬ বছরের মধ্যে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সেনাবাহিনীই দেশটির রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল।
ওই আইনে বলা হয়েছে, ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী পুরুষ ও ১৮ থেকে ২৭ বছর বয়সী নারীদের অবশ্যই দুই বছরের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হবে। পাশাপাশি ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত বিশেষজ্ঞদের (যেমন চিকিৎসক) অবশ্যই তিন বছর সামরিক সেবা দিতে হবে। মিয়ানমারে চলমান জরুরি অবস্থার মধ্যে এই সেবার সময়কাল পাঁচ বছর পর্যন্ত বাড়তে পারে।
কিন্তু আইনটি কার্যকর করার পর থেকে মিয়ানমারের শহরগুলো থেকে তরুণরা পালিয়ে যেতে শুরু করেছে। তরুণরা বলেছে, তারা দেশ ছেড়ে চলে যাবে বা জান্তাবিরোধী বাহিনীগুলোতে যোগ দেবে, তবু অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা সামরিক বাহিনীর জন্য লড়াই করবে না।
গত বছরের অক্টোবরের শেষদিক থেকে চীন সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে জাতিগত বিদ্রোহীদের জোট থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স আর গত নভেম্বর থেকে রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় মিয়ানমার জান্তার সামরিক বাহিনী। এরপর থেকেই জান্তা সরকার সেনাবাহিনীতে নতুন লোকবল নিয়োগের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
গত বছরের নভেম্বর থেকে আরাকান আর্মির তীব্র হামলার মুখে জান্তা সরকার রাখাইনের পৌকতো, মিনবিয়া, ম্রাউক-ইউ, কিয়াউকতোয়া, মায়া পোন ও তাউং পিয়ো শহরের পাশাপাশি চিন প্রদেশের পালেতোয়া শহরের নিয়ন্ত্রণও ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, জান্তা সরকার রাখাইন রাজ্যে জাতিগত উত্তেজনা ছড়াতে রোহিঙ্গাদের সামরিক চাকরিতে নিয়োগ করছে। আর আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের নিয়োগ বেআইনি হবে। কারণ জান্তা সরকার গত কয়েক দশক ধরে রোহিঙ্গাদের দেশটির নাগরিকত্ব দেয়নি।
২০১৭ সাল থেকে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে বসবাস করছে। সে বছর মিয়ানমারের জান্তা সরকার রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ও জাতিগত নিধনযজ্ঞ শুরু করলে তারা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
এছাড়া মিয়ানমারেও অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত আরও ছয় লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এদের বেশিরভাগই জাতিসংঘের শরণার্থী শিবিরগুলোতে বাস করে এবং স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে না।
রাখাইনের রাজধানী সিত্তে শহরের ১৩টি শিবিরে বাস করে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা। ২০১২ সালে জাতিগত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তারা ঘরবাড়ি হারা হয়।
ইরাবতীর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১০ ফেব্রুয়ারি থেকেই জান্তা সরকারের বাহিনী রাখাইনের বিভিন্ন রোহিঙ্গা গ্রামসহ বুথিডং, মংডু ও সিত্তে শহরের উদ্বাস্তু শিবিরের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নেতা ও প্রশাসকদের ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী পুরুষদের তালিকা তৈরি করার জন্য চাপ দিয়ে আসছিল।
প্রতিটি ছোট গ্রাম থেকে অন্তত ৫০ জন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু শিবির ও বড় গ্রাম থেকে ১০০ জনের তালিকা দিতে স্থানীয় রোহিঙ্গা নেতা ও প্রতিনিধিদের বলে দেয় জান্তার বাহিনী।
এরপর গত বুধবার পর্যন্ত সিত্তের উদ্বাস্তু শিবিরগুলো থেকে অন্তত ৩০০ রোহিঙ্গা পুরুষকে প্রশিক্ষণের জন্য ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর আগে ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি বুথিডং এলাকার চারটি গ্রাম থেকে অন্তত ১০০ রোহিঙ্গা পুরুষকে ধরে নেওয়া হয়।
রেডিও ফ্রি এশিয়ার এক প্রতিদবেদনে বলা হয়েছে, রাখাইনের কিয়াউকফু শহরের কিয়াউক তা লোন উদ্বাস্তু ক্যাম্পের বাসিন্দারা বলেছেন, গত সোমবার ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মুসলমানদের আদমশুমারি করা হয়েছে। শহরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও সামরিক বাহিনীর লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন ৫৪২ এর অপারেশন কমান্ডারসহ জান্তা বাহিনী ওই আদম শুমারি করে।
এসময় সেনাবাহিনীতে নিয়োগের জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত ১৬০ জনেরও বেশি লোকের একটি তালিকা করা হয়েছে। দুই সপ্তাহের সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে তাদের যুদ্ধে পাঠানো হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কিয়াউক তা লোন ক্যাম্পের এক বাসিন্দা রেডিও ফ্রি এশিয়াকে বলেন, “শহরের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসে আমাদের বলেন, মুসলমানদেরও সামরিক বাহিনীতে চাকরি করতে হবে, কিন্তু আমরা তার আদেশ মানতে অস্বীকার করি। তারপর, সামরিক অপারেশন কমান্ডার তার সৈন্যদের নিয়ে এখানে এসে নতুন সামরিক সার্ভিস আইনের অধীনে আমাদের বাধ্য করেন। তারা ১৬০ জনেরও বেশি মানুষের নাম সংগ্রহ করেছেন।”
আরেক বাসিন্দা বলেন, জান্তার বাহিনী আমাদের কিয়াউকফু শহরে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অনুমতি দেওয়ার লোভও দেখিয়েছে। তিনি বলেন, “তারা আমাদের নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা দেবে না। তবে আমরা যদি সামরিক বাহিনীতে চাকরি করি, তাহলে আমাদের কিয়াউকফু শহরে অবাধে চলাচল করতে দেওয়া হবে।”
কিন্তু ওই ক্যাম্পের কয়েকজন বাসিন্দা বলেছেন, তারা মরে গেলেও জান্তার বাহিনীতে চাকরি করবেন না। তাদের মতে, রোহিঙ্গা মুসলমান ও রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্যই সেনাবাহিনী এই কৌশল নিয়েছে। জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত আরাকান আর্মি মূলত রাখাইনদের সশস্ত্র সংগঠন।
কিন্তু জান্তার বাহিনী উদ্বাস্তু শিবিরগুলো ঘিরে রাখায় রোহিঙ্গারা পালিয়েও যেতে পারছে না।
তথ্যসূত্র: রেডিও ফ্রি এশিয়া, দ্য ইরাবতী