রাজনীতির রক্তপিপাসু রকমসকম নিয়ে আরও একটি ‘কিসসা’ যোগ হলো ওটিটি প্লাটফর্মে; ৮ নভেম্বর থেকে হইচই দেখাচ্ছে নির্মাতা অনম বিশ্বাসের ‘রঙিলা কিতাব’।
কারো বিশ্বাসঘাতকতার জেরে ফেঁসে গিয়ে প্রাণ বাঁচাতে প্রদীপ পালিয়ে বেড়ায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সুপ্তিকে সঙ্গে করে। কিন্তু পেছনের কূটচাল ততই ঘোরালো হয়ে ওঠে। দুই সপ্তাহ পর প্রসব হবে এমন স্ফীত উদর নিয়ে ছুটতে থাকা সুপ্তির সঙ্গে প্রদীপের অস্থির শ্বাস-প্রশ্বাস গোটা ওয়েব সিরিজে দর্শককে চিন্তায় ফেলবে।
স্বামী সোহাগী সুপ্তি চরিত্রে অভিনয় করেছেন পরীমনি। এই প্রথম কোনো ওয়েব সিরিজে দেখা গেল তাকে।
সাক্ষাৎকার ও ফেইসবুক স্ট্যাটাস থেকে খবরের শিরোনাম হয়ে সারা বছর আলোচনায় থাকলেও দীর্ঘদিন রঙিন পর্দায় অনুপস্থিত ছিলেন এই নায়িকা।
সেই নীরবতা ভাঙতে ‘রঙিলা কিতাব’ নিয়ে স্বভাবতই ‘শুটের শুরুর দিন থেকেই বেশ এক্সাইটেড ছিলেন’ তিনি।
স্বামীকে রক্তের খেলা থেকে ফেরাতে ‘কসম’ আদায় করে নেয়া অস্থির স্ত্রী সুপ্তি। অন্তঃসত্ত্বা শরীরেও পাহাড় চরে ‘বর্ডার’ পেরিয়ে এইসব রক্তপাত থেকে স্বামীকে বার করে নিয়ে চলে যেতে উদগ্রীব বায়না ধরা স্ত্রী সুপ্তি। আবার ভয়ে অসহায় মুহূর্তে থান ইট তুলে স্বামীকে আক্রমণ করা শত্রুর মাথা ফাটিয়ে দিতে পারে সুপ্তি।
প্রসব বেদনায় ঘামতে থাকা, কাতরাতে থাকা সুপ্তি চরিত্রে পরীমনিকে দেখে মনে হয় বাস্তবে নিজের মাতৃত্বের অভিজ্ঞতা তাকে অভিনয় জীবনেও পূর্ণতা দিয়েছে।
স্ক্রিনে পরীমনিকে খুব বেশি মেকআপে দেখা যায়নি; তবুও কমনীয়তা ফুটে উঠেছে।
বিতর্ক পিছু না ছাড়া পরীমনি আসলে যে একজন সাবলীল অভিনেত্রী ‘রঙিলা কিতাব’ তা দর্শককে আবার মনে করিয়ে দেবে।
২০১৬ সালের ‘আয়নাবাজি‘ সিনেমার চিত্রনাট্য লেখায় ছিলেন অনম বিশ্বাসও। এরপর ২০১৮ সালে ‘দেবী’ নির্মাণ করেন তিনি। ‘আয়নাবাজি’ হচ্ছে থ্রিলার ও অ্যাকশনে ভরপুর; আর ‘দেবী’ হলো রহস্য ঘেরা সিনেমা।
অনম বিশ্বাস ‘দেবী’ বেছে নিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের থেকে। ‘পত্রিকায় আসা সত্য ঘটনা অবলম্বনে’ গাউসুল আলম শাওনের লেখা কাহিনী থেকে চিত্রনাট্যের কাজ করলেন ‘আয়নাবাজি’ সিনেমার জন্য।
সাময়িক বিরতির পর অনম বিশ্বাস ফিরে এলেন চিত্রনাট্য, সংলাপ এবং নির্মাণ কারিশমা নিয়ে; কিঙ্কর আহ্সানের লেখা ২০১৫ সালে প্রকাশিত ‘রঙিলা কিতাব’ উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে নির্মাণ করলেন এই ওয়েব সিরিজ।
চিত্রনাট্য ও সংলাপে অনম বিশ্বাসের সঙ্গে আরও আছেন আশরাফুল আলম শাওন।
১৬+ উপযুক্ত এই আট পর্বের ওয়েব সিরিজ থ্রিলার ঘরানার। এতে প্রচুর গালি, গুলি, খুন এবং রক্তপাত রয়েছে। থ্রিলার বলতে যে টান টান উত্তেজনা বোঝায় তা অন্তত প্রথম ছয় পর্বে মিলবে না। তবে কাহিনী একটি নির্দিষ্ট লয়ে এগোতে থাকে বলে দর্শকের কাছে কখনই ঢিমেতালে গতি মনে হবে না।
বলিউডের ‘রেস’ ফ্র্যাঞ্চাইজির মতো ধুন্ধুমার ও ধারালো বেগ এখানে মিলবে না; এরপরেও ‘রঙিলা কিতাব’ ওয়েব সিরিজের প্রতিটি মারপিটের দৃশ্য তাগড়া ও জোরালো লাগবে দর্শকের কাছে।
সন্তানসম্ভবা সুপ্তির জন্য রক্তক্ষয়ী জীবন থেকে পালাতে মরিয়া হয়ে ওঠা প্রদীপ চরিত্রে অভিনয় করেছেন মোস্তাফিজুর নূর ইমরান।
ভারতের দক্ষিণী থেকে বলিউড সিনেমায় গ্যাংস্টার চরিত্রের মতো উষ্কখুষ্ক-রুক্ষ চেহারায় এই অভিনেতা রীতিমত খাপেখাপ নির্বাচন। তামাটে চেহারার সঙ্গে অবিন্যস্ত চুল-দাঁড়িতে তার অভিব্যক্তি কোথাও কৃত্রিম বা আরোপিত লাগবে না।
সুপ্তির প্রতি ভালোবাসায় কোমল অভিব্যক্তির প্রদীপ চরিত্রে অভিনয় করা মোস্তাফিজুর নূর ইমরান মারপিটের দৃশ্যে জোরদার হয়ে ধরা দেন। কাহিনীর দুয়েক জায়গায় চেহারা ঢাকতে সানগ্লাস পরা মোস্তাফিজুর নূর ইমরানকে ‘পুষ্পা’ সিনেমার আল্লু অর্জুন থেকেও আকর্ষণীয় লাগবে দর্শকের কাছে।
নিজ নিজ চরিত্রে একেবারে মাপ মতো অভিনয় করেছেন ফজলুর রহমান বাবু, তানভিন সুইটি এবং মনোজ প্রামাণিক, সমু চৌধুরী। ইরেশ যাকেরের অভিনয়ে কণ্ঠ ও অভিব্যক্তিতে কমেডি ভালো জমে। এই ওয়েব সিরিজে কমেডির জায়গা ছিল না; তবু কোনো বাড়াবাড়ি না করেই ইরেশ যাকেরের খল চরিত্রে প্রচ্ছন্ন কমেডি ঢং ভালো লাগবে দেখতে।
ভাতের হোটেল দোকানির চরিত্রটি সাধারণ অভিনয়েই উতরে যেত, কিন্তু শিল্পী সরকার অপু বুঝিয়ে দিয়েছেন একটি সাধারণ চরিত্রকে আপাদমস্তক নিখুঁত করে তোলার মতো একজন অভিজ্ঞ শিল্পী তিনি।
উপন্যাসের নামেই এই ওয়েব সিরিজের নাম হয়েছে ‘রঙিলা কিতাব’। যদিও স্ক্রিনে কাহিনীর সঙ্গে ‘রঙিলা কিতাব’ নামের তাৎপর্য ততটা স্পষ্ট হয় না। এরচেয়ে ওয়েব সিরিজের পোস্টারে লেখা ‘রক্তেরাঙা প্রেমের কিসসা’ এই চিত্রনাট্যের জন্য একটি যুতসই শিরোনাম।
খুন হওয়া এমপির লাশ দেখতে এসে ফজলুর রহমান বাবু অভিনীত চরিত্র ‘নওরোজ সাহেব’ বলেন, “সাবধান! পলিটিক্স খুব রিস্কি জায়গা।”
এই সংলাপ খেয়াল করার পর থেকে ‘রঙিলা কিতাব’ গল্পের পরিণতি কোন দিকে মোড় নিতে পারে ভেবে পুরো সময় জুড়ে দর্শকের কপালে ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে থাকবে।
ওয়েব সিরিজের বড় অংশ জুড়ে আছে বরিশালের স্বরূপকাঠি এবং সন্ধ্যা নদী। এরপরও মূল চরিত্রদের মধ্যে ‘বরিশাইল্যা’ ভাষার সংলাপ ততোটা আসেনি।
ক্যামেরায় মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখানোর প্রবণতা দেখা যায়নি। যদিও খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটিতেও দৃশ্যধারণ হয়েছে বলে পাহাড়, ঘন সবুজ বৃক্ষরাজি, আঁকাবাঁকা মসৃণ সড়কের সৌন্দর্য ধরা দিয়েছে স্বাভাবিকভাবেই।
ওয়েব সিরিজের শুরুতে খুনিকে চেনার সূত্র দেয়া হয় দর্শকের কাছে। কাহিনী এগোতে থাকায় দর্শক ওই সূত্র ক্যামেরায় একটি অ্যাঙ্গেল ভেবে ভুলে যাওয়া শুরু করতেই পারেন। খুনি কে তা নিয়ে সন্দেহের তীর এদিক-ওদিক থাকলেও স্ক্রিনে কোনো জটিল রহস্যও ঘনীভূত করা হয়নি। এরপরও শেষ দৃশ্যের ঠিক আগে আগে গোড়ার ওই সূত্র থেকেই খুনির ভেদ উন্মোচিত হলে দর্শক নড়েচড়ে বসবেন।
ওয়েব সিরিজটি যেখানে গিয়ে শেষ হয় তাতে বোঝা যাচ্ছে, দ্বিতীয় সিজনে পরীমনি তো বটেই তানভিন সুইটির চরিত্রেও দুর্দান্ত কোনো চমক আসবে।
মুক্তির সপ্তাহখানেক পেরোতে না পেরোতেই দর্শকের মধ্যে এই ওয়েব সিরিজ নিয়ে সোশাল মিডিয়াতে সাড়া দেখা যাচ্ছে।
নায়িকার অভিনয়ের প্রশংসায় একজন লিখেছেন, “পরীমনির এরকম একটা কামব্যাক দরকার ছিল।”
আর মোস্তাফিজুর নূর ইমরানের উদ্দেশে এসকে মিঠু লিখেছেন, “অসাধারণ হিরো, নূর ভাইয়ের অভিনয়।”
‘রঙিলা কিতাব’ দেখে এমডি রনি লিখেছেন, “অসাধারণ মানতেই হবে। আমি দেখা শুরু করেছিলাম। দেখি, ফালতু না কি? এখন দেখি অনেক জোশ।”
কাওসার লিখেছেন, “অনেক দিন পর না টেনে একটা সম্পূর্ণ মুভি দেখলাম। দেখলাম বলতে এর গল্প ও অভিনয় দেখতে বাধ্য করেছে। আসলে মুভি বা নাটকের ট্রেইলার দেখলেই বোঝা যায় পুরো মুভি কেমন হবে। ধন্যবাদ মুভির পুরো টিমকে।”
পরের সিজনের দিন গোনা শুরু করে দিয়ে ইউটিউবে সোহান মাহমুদ লিখেছেন, “পুরোটা দেখলাম। লাস্ট ফিনিশিং এভাবে দিলো, অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। মনে হচ্ছে দ্বিতীয় পার্ট আসবে।”
আইএমডিবিতে ‘রঙিলা কিতাব‘ ওয়েব সিরিজের রেটিং এসেছে ৬.৬/১০।