স্থানীয় নাম চন্দ্রবোড়া, তবে হালে রাসেলস ভাইপার নামেই বেশি পরিচিত এই সাপটি। বিষধর এই সাপ নিয়ে এখন চলছে শোরগোল, ছড়াচ্ছে আতঙ্কও। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অলস প্রকৃতির এই সাপটি যতটা বিপজ্জনক, মাতামাতি চলছে তার চেয়ে বেশি।
রাসেলস ভাইপার এই অঞ্চলেরই সাপ, দক্ষিণ এশিয়ায় চারটি বড় সাপের একটি এটি। বাংলাদেশে বরেন্দ্রভূমি অর্থাৎ রাজশাহী অঞ্চল ছিল এর বিচরণস্থল, তবে এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে এটি উলুবোড়া নামেও পরিচিত।
প্রাণীবিজ্ঞানের বিভিন্ন সাময়িকী ঘেঁটে দেখা যায়, এই সাপের নামকরণে জড়িয়ে আছে এক স্কটিশ গবেষকের নাম, তিনি হলেন প্যাট্রিক রাসেল। ব্রিটিশ শাসনামলে তিনি এসেছিলেন ভারতবর্ষে।
১৭৮০ সালের ঘটনা। কর্নাটকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা সাপ নিয়ে তখন আতঙ্কিত। প্রায় দিনই তাদের কোনও না কোনও সহকর্মীকে সাপের আক্রমণের মুখে পড়তে হচ্ছিল। তখন তারা খুঁজতে থাকে এমন একজনকে, যে তাদের সহায়তা করবে কোন সাপ বিষধর আর কোনটি বিষধর না, তা বুঝতে।
ঠিক সে সময়ই প্যাট্রিক রাসেল ভারতে এসেছিলেন এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক ইতিহাস অধ্যয়ন করতে। ১৭৮১ সালে স্কটিশ প্রকৃতিবিদকে নিযুক্ত করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তিনি কোবরার পর যে সাপকে বিষধর হিসেবে শনাক্ত করেছিলেন সেটি হলো রাসেলস ভাইপার। এর বৈজ্ঞানিক নাম ডাবোয়া রাসেলি।
তখন থেকে রাসেলস ভাইপার নিয়ে গবেষণা শুরু করেন প্যাট্রিক রাসেল। এরপর তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে সাপের ওপর একটি বইও লিখেছেলেন। বিষধর এই সাপের ওপর তার গবেষণার জন্যই এই প্রজাতির সাপের নাম রাসেলস ভাইপার হয়।
দৈহিক গঠন
রাসেল ভাইপারের মাথা চ্যাপ্টা, ত্রিভুজাকৃতির এবং ঘাড় থেকে আলাদা। মুখ ভোতা, গোলাকার এবং উত্থিত। নাসারন্ধ্রগুলো বড়। মাথার মুকুট খণ্ডিত আঁশ দিয়ে ঢাকা। চোখ বড় এবং তাতে হলুদ বা সোনালি রঙের দাগ আছে।
এই বিষধর সাপ লম্বায় সর্বোচ্চ পাঁচ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। এটি দেখতে কিছুটা বাচ্চা অজগরের মতো। একটি স্ত্রী রাসেলস ভাইপার একবারে ৩০ থেকে ৩৫টি বাচ্চা দেয়।
আবাসস্থল
দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষত ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও পাকিস্তানে রাসেলস ভাইপারের আনাগোণা আছে। এছাড়া তাইওয়ান, ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে এদের দেখা মেলে।
ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে এই সাপ তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যায়। এছাড়া দেশটির পশ্চিম উপকূলবর্তী অঞ্চল, সেখানকার পাহাড়, দক্ষিণাঞ্চল বিশেষ করে কর্ণাটক রাজ্য ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে রাসেলস ভাইপারের বিচরণ আছে।
তবে রাসেলস ভাইপার কোনও নির্দিষ্ট আবাসস্থলে সীমাবদ্ধ থাকে না। এরা বিভিন্ন পরিবেশে বাস করতে সক্ষম। অবশ্য ঘন জঙ্গল সচরাচর এই সাপ এড়িয়ে চলে। সাধারণত এটি উন্মুক্ত, ঘাসে ঢাকা বা ঝোপঝাড়পূর্ণ এলাকায় বাস করে। সমতলভূমি, উপকূলীয় নিম্নভূমি এবং পাহাড় এই প্রজাতির সাপের পছন্দের জায়গা।
রাসেলস ভাইপার সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে খুব বেশি উচ্চতায় থাকে না। তবে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে ৭ হাজার থেকে ৯ হাজার ৮০০ ফুট উচ্চতায় এদের দেখা গেছে। আর্দ্র পরিবেশ, যেমন জলাভূমি বা রেইনফরেস্ট এরা সচরাচর মাড়ায় না।
এই প্রজাতির সাপ ঘনবসতিপূর্ণ নগরাঞ্চল এবং গ্রামাঞ্চলেও দেখা যায়।
ইঁদুর প্রধান খাদ্য হওয়ায় মনুষ্যবসতির আশপাশেই রাসেলস ভাইপার বেশি দেখা যায়। এছাড়া ফসল কাটার মৌসুমে কৃষিজমিতে এই সাপ দেখতে পাওয়া যায়।
আচরণ
রাসেলস ভাইপার প্রধানত রাতের বেলায় খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। তবে শীতল আবহাওয়ায় এটি দিনের বেলায় বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। বাচ্চা রাসেলস ভাইপার সাধারণত অনেক বেশি নার্ভাস প্রকৃতির হয়।
বয়স্ক রাসেলস ভাইপার ধীরগতির ও অলস। উসকানো না হলে সাধারণত এরা আক্রমণ করে না। তবে আক্রমণ করে বসলে তা বিদ্যুৎ গতিতে করে।
আক্রান্ত বোধ করলে রাসেলস ভাইপার ‘এস’ আকৃতির লুপ তৈরি করে দেহের প্রথম এক-তৃতীয়াংশ উঁচু করে এবং এমন জোরে হিস শব্দ করে যা অন্য কোনও সাপ করে না। আরও বেশি উসকানো হলে তারা ছোবল মারে এবং এত জোরে বলপ্রয়োগ করে যে, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ লাফিয়ে ওঠে।
রাসেলস ভাইপারের এমন আচরণ দেখে অনেকে মনে করেন, এরা মানুষকে তাড়া করে কামড় দেয়। তাদের এই ধারণা ঠিক নয়।
বাংলাদেশে যেসব সাপ দেখতে পাওয়া যায়, সেগুলোর মধ্যে রাসেলস ভাইপার বিষধরদের মধ্যে একটি। তবে এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বিষধর সাপ বলা যাবে না। বরং শক্তিশালী বিষ ও আক্রমণাত্মক আচরণের কারণে ব্ল্যাক মাম্বা ও পাফ অ্যাডার রাসেলস ভাইপারের চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক।
বাংলাদেশে বিচরণ
বাংলাদেশে রাসেলস ভাইপার বিলুপ্তির হুমকির মুখে থাকা একটি প্রজাতি হিসাবে চিহ্নিত। তবে ইদানিং এর বিস্তার আবার দেখা যাচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, সাধারণত শুকনো অঞ্চলে বাস করা রাসেলস ভাইপার এরই মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন জলবায়ু পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছে এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে তারা দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের অন্তত ২৭টি জেলায় এই সাপ দেখা গেছে। বিশেষ করে পদ্মা তীরবর্তী অঞ্চলে এই বিষধর সাপের দেখা মিলছে বেশি। এটিকে নিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, রাসেলস ভাইপার মারতে পদ্মাপারের লোকজন প্রচার শুরু করে দিয়েছে।
মানুষের আতঙ্কের কারণ নেহায়তই অমূলক নয়। ২০২৩ সালের এক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় সাত হাজার মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়।
তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, রাসেলস ভাইপারের কামড়ের পর উপশমের জন্য অ্যান্টিভেনম রয়েছে। আর দেশের সব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এই প্রতিষেধক পাঠানো হচ্ছে।