আইএসের নামে দায় স্বীকারের বার্তা এসেছে, তাতেও রয়েছে সন্দেহ। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, এমন হামলার আভাস তারা আগেও পেয়েছিল। মস্কোর সন্দেহ, পেছনে রয়েছে ইউক্রেন। রাশিয়ার বিরোধী মতের ব্যক্তিরা আবার খোদ রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে দুষছেন। সব মিলিয়ে রাশিয়ার হামলা কারা চালাল, তা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না।
রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর কাছে শুক্রবার রাতে একটি হলে কনসার্টে হামলায় নিহত হয় শতাধিক মানুষ। সৈনিকের মতো পোশাক পরা অন্তত চারজন ভারী অস্ত্র নিয়ে এই হামলা চালায়, দেখা গেছে একটি ভিডিওতে। গোলাগুলির মধ্যে সেখানে আগুনও ধরে যায়।
ব্যান্ড দল ‘পিকনিক’র কনসার্ট উপলক্ষে ক্রোকাস সিটি হল ও কনসার্ট কমপ্লেক্সে জড়ো হয়েছিল ৬ হাজারের বেশি মানুষ। কনসার্ট শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই শুরু হয় হামলা।
রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুতিন আবার জয়ী হওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যে এই হামলা নিয়ে সারাবিশ্বেই সরগরম আলোচনা চলছে।
যুক্তরাষ্ট্র আভাস পেয়েছিল
রাশিয়ায় এমন হামলা হতে পারে, এমন খবর আগেই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। সেজন্য দুই সপ্তাহ আগে রাশিয়ায় থাকা তাদের নাগরিকদের বড় ধরনের জনসমাগম এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল বলে সিএনএন জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, মস্কোয় বড় ধরনের সমাবেশ লক্ষ্য করে সম্ভাব্য জঙ্গি হামলার তথ্য রয়েছে তাদের কাছে।
সর্বশেষ শুক্রবার সন্ধ্যায় আরেকটি সতর্ক বার্তা দেওয়া হয় রাশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস থেকে। ওই সতর্কবার্তায় সেই এলাকা এড়িয়ে চলতে বলা হয় তাদের নাগরিকদের, যেখানে শুক্রবার রাতে হামলার ঘটনা ঘটে।
আইএসের দায় স্বীকার
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক দল ইসলামিক স্টেট (আইএসআইএস) এই হামলার দায় স্বীকার করেছে বলে খবর আসে আন্তর্জাতিক সব সংবাদমাধ্যমে।
এই হামলার প্রশংসা করে আইএসের পাঠানো বার্তা ধরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তানভিত্তিক আইএস খোরাসান (আইএসআইএস-কে) এই হামলা চালায়।
আইএসআইএস-কে ২০১৪ সালের শেষের দিকে পূর্ব আফগানিস্তানে আত্মপ্রকাশ করে। এর নামটি হয়েছে ইরান, তুর্কমেনিস্তান ও আফগানিস্তানের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত অঞ্চলের পুরোনো নাম ‘খোরাসান’ থেকে।
বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠী থেকে পলাতক সদস্যদের নিয়ে এটি গঠিত হয়েছিল। এদের মধ্যে রয়েছে আল-কায়দা, তেহরিক-ই-তালেবান (টিটিপি) এবং আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সাবেক তালেবান যোদ্ধারা।
আইএসআইএস-কে ইসলামিক স্টেটের অন্যতম সক্রিয় আঞ্চলিক শাখা। ২০১৮ সালে এর সদস্য সংখ্যা সর্বাধিক হলেও পরে তা কমতে থাকে। তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণের ফলে সংগঠনটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের পর থেকে আইএসআইএস-কে এর মতো চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে তাদের সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।
এই দাবি নিয়ে সন্দেহ
আইএস দায় স্বীকার করলেও তাদের দাবি নিয়ে যুক্তরাজ্যের দৈনিক গার্ডিয়ান লিখেছে, এখানে গুরুত্বপূর্ণ যে আইএস-খোরাসানের নামে বার্তাটি আসেনি। এসেছে আইএসের সেন্ট্রাল কমান্ড থেকে।
আইএস-খোরাসানের কাজ মূলত অঞ্চলকেন্দ্রিক, সেটাও দায় স্বীকারের এই বার্তা নিয়ে সন্দেহের কারণ।
এই দলটি গত কয়েক বছরে শতাধিক হামলা চালিয়েছিল। আফগানিস্তানে পশ্চিমা লক্ষ্যবস্তু ছাড়াও তারা হামলা চালিয়েছিল কাবুলের হাসপাতাল ও কাবুল ইউনিভার্সিটিতে। ২০২১ সালে কাবুল বিমানবন্দরেও হামলা চালায় তারা।
তবে তাদের সব হামলাই ঘটে আফগানিস্তানে। দেশের বাইরে তাদের হামলার নজির পাওয়া যায় প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে। এবছর ইরানে হামলা চালিয়ে ১০০ মানুষকে হত্যার জন্য আইএস-খোরসানকে সন্দেহ করা হলেও তারা এর দায় স্বীকার করেনি।
তবে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত যুক্তরাষ্ট্রের একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা বলেছিলেন যে আইএস-খোরাসান আফগানিস্তানের বাইরেও হামলা চালাতে পারে যে কোনও সময়।
মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের পতন ঘটলেও গোষ্ঠীটির মূল নেতাদের সঙ্গে আইএস-খোরসানের নেতাদের সরাসরি যোগাযোগ থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, এমনটা লিখেছে গার্ডিয়ান। সংবাদপত্রটি লিখেছে, আইএস এখন এমন হামলা চালাতে চায়, ফলে তাদের নির্দেশে আফগানিস্তানের দলটি এতে জড়িত থাকতে পারে।
আবার পশ্চিমা দেশগুলো ছেড়ে রাশিয়াকে কেন হামলার লক্ষ্যবস্তু করবে আইএস, সেটা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।
গার্ডিয়ান লিখেছে, এটার একটা উত্তর হতে পারে, সিরিয়ায় বাশার আল আসাদকে মদদ দেওয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়া তাদের বিরাগভাজন হতে পারে।
২০২২ সালে আফগানিস্তানে রুশ দূতাবাসে হামলা চালিয়েছিল আইএস-খোরাসান।
ওয়াশিংটনভিত্তিক উইলসন সেন্টারের মাইকেল কুগেলম্যান গার্ডিয়ানকে বলেন, মুসলিম জঙ্গিরা নানা কারণে এখন ভ্লাদিমির পুতিনকে শত্রু মনে করছে।
ষড়যন্ত্র ইউক্রেনে?
দুই বছর ধরে প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে রয়েছে রাশিয়া। তারমধ্যে এই হামলার জন্য কিয়েভকেই সন্দেহ করছে ক্রেমলিনের কর্তাব্যক্তিরা।
আইএসের দাবি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে রুশ ট্যাবলয়েড মস্কোভস্কিয়া কমসোমলেট সম্পাদকীয়তে লিখেছে, “এই ধরনের দাবি ভুয়া হতে পারে, এটা আরও ভালোভাবে যাচাই করা দরকার।”
শুক্রবারের হামলার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১১ জনকে গ্রেপ্তারের খবর দেয় রুশ নিরাপত্তা সংস্থা আরএফবি।
তারা এক বিবৃতিতে বলছে, এদের চারজন ইউক্রেন সীমান্ত অতিক্রম করতে যাচ্ছিল এবং তাদের সঙ্গে হামলার সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে।
“হামলাকারীরা ইউক্রেনে পালাতে চাইছিল, তার মানে ওপারে তাদের যোগাযোগ রয়েছে।”
তবে রাশিয়ার এই অভিযোগ ইউক্রেন উড়িয়ে দিয়েছে বলে আল জাজিরা জানাচ্ছে।
ইউক্রেনের সেন্টার ফর কাউন্টার ডিসইনফরমেশন পাল্টা বলেছে, ইউক্রেন যুদ্ধের নতুন অজুহাত তৈরি করতে আরএফবিই এই হামলা সাজিয়েছে।
পুতিনেরই লাভ?
এক সময়ের কেজিবি এজেন্ট পুতিন টানা দুই যুগ ধরে রাশিয়া শাসন করছেন, একচ্ছত্রভাবে। অথচ তার শাসনে গোয়েন্দা সংস্থার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে বলে অভিযোগ এবার জোরেশোরে উঠেছে।
৫১ বছর বয়সী রুশ শিক্ষক আলেক্সান্দ্রা চেনিশেভা আল জাজিরাকে বলেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা নাজুক, তা মেলে ধরল এই হামলা। এখন নিরাপত্তা রক্ষীরা দেশে বেতনের দিক থেকে সবচেয়ে অবহেলিত।
জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব ব্রেমেনের রুশ গবেষক নিকোলাই মিত্রোখিন আল জাজিরাকে বলেন, রুশ নিরাপত্তা সংস্থা এখন নির্বিষ হয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কবার্তা উপেক্ষা করেছিলেন পুতিন। তিনি বলেছিলেন, এটা ওয়াশিংটনের এক ধরনের ‘ব্ল্যাকমেইল’ হিসাবে দেখছিলেন তিনি।
তবে হামলা ঠেকাতে তার বাহিনী যেমন ব্যর্থ হয়েছিল, তেমনি হামলার পর কনসার্ট হলে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েনেও আধা ঘণ্টা লেগেছিল যানজটের কারণে, যা এসেছে আল জাজিরার প্রতিবেদনে।
মিত্রোখিন বলেন, “হেলিকপ্টারগুলো তখন কোথায় ছিল? সাঁজোয়া যানগুলোও বা ছিল কোথায়?
“আমরা জানি সেগুলো কোথায়? সেগুলো পুড়ছে কিয়েভের কাছে সড়কে, সেগুলো লুকিয়ে আছে দনেৎস্কের কাছে কোথাও মাটির নিচে কিংবা টহল দিচ্ছে লুহানস্কে। বিপদ সেখানে নয়, অথচ আমাদের ক্ষ্যাপাটে প্রেসিডেন্ট যুদ্ধেই আছেন।”
কেউ কেউ আবার সন্দেহ করছেন, হামলার ঘটনাটি ঘটেছে আরএফবির ইন্ধনেই। আর তা পুতিনের রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণে।
লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল এশিয়া ডু ডিলিজন্সের প্রধান অ্যালিশের ইখামভের ধারণা, এই হামলা থেকে আখেরে পুতিনেরই লাভ।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, “সবার আগে প্রশ্ন করুন, এই হামলায় কার লাভ হলো? আমার মনে হয় না, রাশিয়ায় হামলা চালিয়ে আইএসের কোনও লাভ আছে।”