Beta
শুক্রবার, ২৩ মে, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ২৩ মে, ২০২৫

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দুই বছরে কী হলো

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া।
[publishpress_authors_box]

প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সর্বাত্মক হামলা শুরু করে রাশিয়া। অনেকেই মনে করেছিল, রাজধানী কিয়েভের নিয়ন্ত্রণ নিতে রুশ বাহিনীর দুদিনের বেশি সময় লাগবে না। কারণ সামরিক শক্তিতে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের তুলনাই চলে না।

এমনটা মনে করার আরও একটা কারণ অবশ্য ছিল। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চল বেশ সহজেই দখল করেছিল রাশিয়া। তেমন একটা প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়নি তাদের। ফলে দুই দিনে রুশ সেনারা কিয়েভ দখল করবে এমন ধারনা জন্মেছিল।

যদিও বাস্তবে তা হয়নি। যুদ্ধের দুই বছরে ইউক্রেনের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি শহর ছাড়া খুব বেশি এলাকা কিন্তু রাশিয়া দখল করতে পারেনি। তবে যুদ্ধের এই সময়ে ইউরোপকে নতুন এক অধ্যায়ের ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। স্নায়ু যুদ্ধের অবসানের পর এতটা সংকট পোহাতে হয়নি ইউরোপকে।

পশ্চিমাদের সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে ইউক্রেনের বাহিনী। তারা রুশ সেনাদের তাদের মাতৃভূমি থেকে হটাতে পারবে কিনা, এ নিয়ে সন্দেহ আছে। ইউরোপীয় দেশগুলো ইউক্রেনকে সমর্থন দিলেও সেসব দেশের মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করে, রুশদের পরাজিত করতে পারবে ইউক্রেনীয়রা।

ইউক্রেনে হামলার দুই বছর পূর্তির ঠিক আগে দেশটিতে হামলা জোরদার করেছে রাশিয়া। এর আগে কয়েক মাস রুশ বাহিনীর তেমন একটা অগ্রগতি ছিল না। সম্প্রতি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় শহর আভদিভকা থেকে পিছু হটেছে ইউক্রেনীয় সেনারা। ফলে শহরটির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় রুশ সেনাদের হাতে। গত বছরের মে মাসে বাখমুত শহর পতনের পর এটি রাশিয়ার জন্য় বড় জয়।

এর বাইরে দক্ষিণাঞ্চলীয় জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলের গ্রামগুলোতে রুশ হামলা বেড়েছে। গ্রামগুলোর কয়েকটিতে অবশ্য ইউক্রেনীয় বাহিনী প্রতিরোধ করে যাচ্ছে। কৃষ্ণ সাগরে রুশ নৌবহরেও হামলাও চালিয়ে যাচ্ছে তারা।

ইউক্রেনীয় বাহিনী সম্প্রতি দাবি করেছে, ক্রিমিয়া উপকূলে রুশ নৌবাহিনীর জাহাজ সিজার কুনিকভ তাদের হামলায় ডুবেছে।

রুশ নিয়ন্ত্রণে আভদিভকা

আভদিভকা থেকে নিজেদের সেনা প্রত্যাহার করেছে ইউক্রেন। এছাড়া শহরটির কাছে কোকাকোলার একটি কারখানা থেকেও ইউক্রেনীয় সেনারা সরে গেছে। কিয়েভ ওই কারখানার মাধ্যমেই সেখানে লড়াইরত ইউক্রেনীয় সেনাদের রসদ সরবরাহ করা হত।

গত বছরের অক্টোবর থেকে আভদিভকা দখলে নিতে হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল মস্কো। রুশ নিয়ন্ত্রিত দনেৎস্ক অঞ্চলে যেতে এই শহর ব্যবহার করত ইউক্রেনীয়রা।

আভদিভকার ওপর রাশিয়ার হামলা অবশ্য এই প্রথম নয়। ২০১৪ সালে রুশ সমর্থিত যোদ্ধারা যখন ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলের বিশাল এলাকা দখল করে নেয়, তখন শহরটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ আভদিভকায় বাস করত। রুশ বাহিনী নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর শহরটি ছেড়ে প্রায় সবাই চলে যায়। রাশিয়ার মুহুর্মুহু হামলায় গোটা আভদিভকা বলতে গেলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

আভদিভকার পতন এক হাজার কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ যুদ্ধক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

আভদিভকার পতনকে ‘গুরুত্বপূর্ণ বিজয়’ হিসেবে দেখছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। অন্যদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, সেনাদের জীবন বাঁচাতে আভদিভকা থেকে তাদের প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

একই সঙ্গে জেলেনস্কি আভদিভকা পতনের জন্য পশ্চিমাদের দায়ী করেন। পশ্চিমা দেশগুলো অস্ত্র সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় শহরটি রক্ষা করা যায়নি বলে জানান তিনি। 

রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোর অস্ত্র সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল ইউক্রেন।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।

বাখমুতের জন্য লড়াই

দনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলঘেঁষা ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাখমুতের নিয়ন্ত্রণ নিতে দুপক্ষের মধ্যে ভয়াবহ লড়াই বাধে। গত বছরের মে মাসে রাশিয়ার হাতে পতনের পর শহরটির আশপাশের কয়েকটি এলাকার নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছিল ইউক্রেন।

তবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ারের (আইএসডব্লিউ) বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাখমুত শহরের চারপাশে সম্প্রতি রুশ বাহিনী তাদের আরও নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়েছে।

দক্ষিণে অগ্রগতি  

ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলের ভারবোভ ও রোবোতিন গ্রামের কাছে রুশ বাহিনী ধীর গতিতে এগুচ্ছে।

গত বছরের আগস্টে ইউক্রেনীয় বাহিনী পুনরায় রোবোতিনের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তখন দেশটি আশা করেছিল, তাদের বাহিনী স্থলপথে ক্রিমিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার যোগাযোগ ছিন্ন করতে পারবে। এতে মস্কোর সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটবে।

এ সপ্তাহের শুরুতে ইউক্রেনের কমান্ডাররা বলেন, রোবোতিন গ্রামের কাছে তাদের অবস্থানে একের পর এক হামলা করেছে রুশ বাহিনী।

অবশ্য আইএসডব্লিউ জানিয়েছে, ইউক্রেনের কমান্ডাররা এমন দাবি করলেও তাদের প্রাপ্ত ফুটেজ বলছে, রোবোতিন গ্রামের বাইরে পশ্চিমে ও দক্ষিণে সম্প্রতি অগ্রসর হয়েছে রুশ বাহিনী।

এছাড়া ইউক্রেনের খেরসন শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে ক্রিনকি গ্রাম ঘিরে বয়ে চলা দিনিপ্রো নদীর পূর্ব তীরের কয়েকটি অঞ্চল রুশ বাহিনী পুনরায় নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু গত মঙ্গলবার দাবি করেন, তাদের বাহিনী ক্রিনকি ফের দখল করেছে। তবে আইএসডব্লিউর মতে, গ্রামটির হাতেগোনা কয়েকটি এলাকা এখনও ইউক্রেনীয় বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

রুশ নৌবহরে হামলা

নিজ ভূ-খন্ডে রাশিয়ার উপর্যুপরি হামলার মধ্যে কৃষ্ণ সাগরে রুশদের নৌবহরে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেন। এরই জেরে উপকূলীয় শহর আলুপকার কাছে সাগরে রুশ জাহাজ সিজার কুনিকভ ডুবে যায়।

ইউক্রেনের এমন দাবি নিয়ে রুশ নৌবাহিনী এখনও মুখ খোলেনি। ক্রেমলিনও এ ঘটনায় কোনও মন্তব্য করেনি। তারা কেবল জানিয়েছে, ইউক্রেনের ছয়টি ড্রোন তাদের হাতে ধ্বংস হয়েছে।

এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইউক্রেনের দাবি সঠিক হলে এটি হবে রুশদের তৃতীয় বড় জাহাজ, যার মাধ্যমে কৃষ্ণ সাগরে নিজেদের নৌবহরে কারিগরি সহায়তা পাঠাচ্ছিল ক্রেমলিন।

জাহাজডুবির ঘটনার দুদিন পর রুশপন্থী সামরিক ব্লগাররা জানান, কৃষ্ণ সাগরে রুশ নৌবহরের কমান্ডার অ্যাডমিরাল ভিক্তর সোকোলভকে সরিয়ে ভাইস-অ্যাডমিরাল সের্গেই পিনচুকাকে ওই অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

ব্লগারদের ধারণা, যুদ্ধে ইউক্রেনীয় বাহিনীর অগ্রগতির প্রমাণ হতে পারে এই ঘটনা।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে ক্রিমিয়ার শহর সেভাস্তোপোলে কৃষ্ণ সাগরে অবস্থানরত রুশ নৌ বাহিনীর সদরদপ্তরে হামলা করেছিল ইউক্রেন। ওই হামলায় কমান্ডার অ্যাডমিরাল ভিক্তর সোকোলভের মৃত্যু হতে পারে, এমন কথাও চালু আছে।

এছাড়া সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বেশ কয়েকটি রুশ বিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে ইউক্রেন। এগুলোর মধ্যে ছিল এসইউ-৩৪ ও এসইউ-৩৫এস। দেশটির পূর্বাঞ্চলে গত সোমবার এ দুটি বিমান ভূপাতিত করা হয়।         

দুই বছরের লড়াই

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরের একটু আগে রুশ ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে কেঁপে ওঠে ইউক্রেন। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় ইউক্রেনে রাশিয়ার কথিত ‘বিশেষ অভিযান’।        

প্রতিবেশি দেশটিতে খুব দ্রুত ঢুকে পড়ে রুশ বাহিনী। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তারা দেশটির বিশাল এলাকা নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। এর পাশাপাশি রাজধানী কিয়েভের উপকণ্ঠে অগ্রসর হতে থাকে রুশরা।

এরপর ইউক্রেনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর খারকিভে রুশ বাহিনী বোমাবর্ষণ করতে থাকে। পাশাপাশি তারা খেরসেন শহরের পূর্ব ও দক্ষিণের অঞ্চল দখল করে। একই সঙ্গে বন্দর নগরী মারিওপোলও ঘিরে ফেলে।

পুরো দেশে ইউক্রেনের বাহিনী যেসব জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল সে সময়, তার প্রায় সবগুলোতেই রুশরা হামলা চালায়। এক পর্যায়ে তারা খাদ্য, পানি ও গোলাবারুদের সংকটে পড়ে।

২০২৩ সালের ১০ মার্চ যুদ্ধে মৃত সহকর্মীর কফিন কাঁধে ইউক্রেনীয় সেনারা।

এমন পরিস্থিতিতে ইউক্রেনীয় বাহিনী দ্রুতই পশ্চিমাদের কাছ থেকে অস্ত্র ও ট্যাঙ্ক নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে সেনা মোতায়েন শুরু করে। এসব অস্ত্রশস্ত্র ইউক্রেনের ভেতরে রুশদের অগ্রগতি থামাতে বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখে।

২০২২ সালের অক্টোবরের মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। রুশ বাহিনী কিয়েভের পতন ঘটাতে ব্যর্থ হয়।

ইউক্রেনের উত্তরাঞ্চল থেকে তারা নিজেদের পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতির সামান্যই বদল ঘটেছে।

অবশ্য ইউক্রেনে হামলার দুই বছর পর ও পাঁচ লাখের বেশি মানুষ হতাহতের পর রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন এখনও মনে করেন, ইউক্রেন যুদ্ধে তিনিই জিতবেন।

তথ্যসূত্র : বিবিসি

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত