Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

‘সাবদার ধরে আবদার, কিছু হয়না, কেন হয় না…’

আফসান চৌধুরী। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার

শিরোনামের লাইনটা কবি সাবদার সিদ্দিকীর, যাকে অনেকে চেনেন তার উন্মূল ক্ষ্যাপা জীবনের জন্য তার কবিতার চেয়ে। আসলে একজন মানুষের অনেকগুলো দিক থাকে, কখন একটার শুরু, কখন শেষ কে বলবে। সাবদার ভাইয়ের ক্ষেত্রেও তাই। কবিদের বেলায় কখনও কখনও তার মিথ, লিজেন্ড কবিতার চেয়ে বড় হয়ে যায়। আমার ঘনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন, প্রিয় মানুষ, তাকে ওভাবেই মনে রাখব।

২.
সাবদার ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় হয় ১৯৭২ সালে। কলকাতা থেকে বেশ কিছু চরমপন্থী ঢাকায় আসে ‘বিপ্লব’ করতে। আমার সাথে একজনের যোগাযোগ হয় কলকাতার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে। ঢাকায় যারা আসে তারা কলকাতার নামজাদা কলেজের ছাত্র, ইংরেজি তুখোড়, সহজেই মিশে যায় ঢাকায়। সেই কলকাতার একজন একদিন সাবদার ভাইকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসে। তাদের পরিচয় কলকাতায়। আড্ডায় পরিচয় সাবদার ভাইয়ের সাথে, যেটা চলে শেষ দেখা পর্যন্ত।

৩.
সাবদার ভাই খুলনার মানুষ এবং ওই এলাকার অনেকের মতো কলকাতা-যোগাযোগ ভালো ছিল, এখনও যেমন। তিনি কলকাতা-ঢাকা করতেন নিয়মিত, হয়তো কলকাতা বেশি ভালো লাগতো। রাজনীতির নিকটের না তবে খবরটবর রাখতেন। একবার কী বলার কারণে তাকে শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে প্রচণ্ডভাবে মারে ছাত্রলীগের ছেলেরা। সাবদার ভাইয়ের কোনও ঠিক ঠিকানা ছিল না, কী বলেন না বলেন। সেই কলকাতার চরমপন্থী তাকে কক্সবাজারে কোনও বিদেশী সাহায্য সংস্থার কেন্দ্রে নিয়ে যান মাস খানেকের জন্য। ফিরে আবার যে কে সেই।

৪.
এই সময় আমি ‘ডাডাইসম’-এর অনুসরণ করে এক পত্রিকা বার করি। ডাডাইসম সকল প্রথা বিরোধী, কিছুটা আমার মতো, একেবারেই অসুশীল। সাবদার ভাইকে বললাম লিখতে। তারটাই প্রধান লেখা ছিল। কবিতা। বিরাট মজাদার, ব্যাঙ্গ আর ক্ষোভে ভরাট কবিতা। কিন্তু তার মধ্যেও রাজনীতি ও ব্যাক্তিক গভীরতাও ছিল। সকল দলছুট মানুষদের যা থাকে। সাবদার ভাইয়ের সেই কবিতাটা এরকম—

‘‘সাবদার ধরে আবদার
কিছু হয়না, কেন হয়না,
কী হয়না…কী হবে না জানিনা,
জানিনা…।”

কিছুই হলো না জীবনে সাবদার ভাই? এটাই তো শেষ কথা, তাই না?

পত্রিকা বের হবার পর কয়েক মাস মিসিং ছিলেন তিনি। তারপর উদয় হয়ে উচ্ছ্বসিতভাবে আমাকে বললেন, ‘‘কবিতাই আমাকে বাঁচালো।’’ ঘটনা হলো তিনি বর্ডার ক্রস করছিলেন, কিন্তু বিডিআর-এর হাতে ধরা পড়েন। তিনি ঘোষণা করেন, এই সব বর্ডার কবিদের জন্য প্রযোজ্য নয়।

৫.
পত্রিকা বের হবার পর কয়েক মাস মিসিং ছিলেন তিনি। তারপর উদয় হয়ে উচ্ছ্বসিতভাবে আমাকে বললেন, ‘‘কবিতাই আমাকে বাঁচালো।’’ ঘটনা হলো তিনি বর্ডার ক্রস করছিলেন, কিন্তু বিডিআর-এর হাতে ধরা পড়েন। তিনি ঘোষণা করেন, এই সব বর্ডার কবিদের জন্য প্রযোজ্য নয়। তারা তখন তাকে প্রমাণ করতে বলেন যে তিনি কবি। সাবদার ভাই আমাদের পত্রিকা নিয়ে যাচ্ছিলেন সাথে করে। সেখান থেকে তার কবিতা শোনাতে শুরু করেন।

‘‘একবার ভাবো তো, নো ম্যান’স ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে আমি কবিতা পড়ছি, আমার কবিতা শুনছে বর্ডার গার্ডরা— দুই দেশের, আর তারিফ করছে। এমন ঘটনা কি আগে ঘটেছে?’’
জ্বি না সাবদার ভাই, আগামীতে ঘটবে বলেও মনে হয় না।

কবি সাবদার সিদ্দিকী। আলোকচিত্র: সংগৃহীত।

৬.
কিন্তু দেহ মন কোনওটাই তার বেশি দিন ভালো থাকলো না। অবস্থা যেতে লাগলো পড়তির দিকে, রুটি রোজগারহীন। কদিন ছিলেন এক যৌনকর্মীর বাসায়, যে তাকে আপন ভাইয়ের মতো আদর করতো। একদিন একটু স্নেহ আর খুশি নিয়ে আমাকে বলেন, ‘‘আমার চুল আঁচড়ে দেয়, তেল জল দিয়ে।’’

সেই ঠিকানাও বেশি দিন ছিল না। সবাই তাকে অচ্ছুত ভাবতো। একবার ঢাকার বাইরে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে গিয়ে রাতে মাতাল হয়ে কয়েকজন কবি তাকে বালুর মধ্যে চেপে পুঁতে দেবার চেষ্টা করে। কিছুটা ফাজলামি, কিছুটা রাগ থেকে। অনেকেই তার ওপর ক্ষেপে থাকতো জানি না কেন। অবশ্য তার কথা ব্যবহারের হাতা-মাথা ছিল না। আমার বাড়িতে যেত কিন্তু পাগলামি করতো। তবে আমাকে খুব স্নেহ করতো।

সেই ঠিকানাও বেশি দিন ছিল না। সবাই তাকে অচ্ছুত ভাবতো। একবার ঢাকার বাইরে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে গিয়ে রাতে মাতাল হয়ে কয়েকজন কবি তাকে বালুর মধ্যে চেপে পুঁতে দেবার চেষ্টা করে। কিছুটা ফাজলামি, কিছুটা রাগ থেকে।

৭.
একদিন এক দুঃসংবাদ শুনে তাড়াহুড়ো করে হেঁটে ক্যাম্পাস দিয়ে যাচ্ছি, তিনি দৌড়ে এলেন কাছে। বললেন, ‘‘কী হয়েছে তোমার, তুমি কি নেশা করেছো, ড্র্যাগ নিয়েছো?’’ তার চেহারা চিন্তিত। এটা ছিল স্নেহের চিহ্ন। এরপর বেশ কিছুদিন পর দেখা হয়, একেবারেই উল্টাপাল্টা কথা বলছেন, একেবারেই নরমাল না। ভীষণ দমে গেলাম। তাকে দেখার তো কেউ নাই।

৮.
শেষ দেখা হলো এক অদ্ভুত অবস্থায়। আমি কলকাতা যাই এক আত্নীয়ের সাথে, তিনি ডাক্তার দেখাবেন। আশির প্রথম দিকে।

কলকাতা জাদুঘরের কাছে কয়েকটা ভিখারি, উন্মাদ রাস্তায় বসে জটলা পাকাচ্ছে। ওর মধ্যে থেকে একজন উঠে আসে, গায়ে নোংরা কাপড়, চুলে জট, আমি চিনতে পারি। তিনি নিশ্চয় চিনেছিলেন নাহয় উঠে আসবেন কেন? ওটাই শেষ দেখা। আলাপ করার কাল অনেক আগে পার হয়ে গেছে। আমি সরে যাই, তিনিও।

মাঝে মাঝে ভাবি, হয়তো এটাই সাবদার ভাইয়ের শেষ কবিতা ছিল— তার এই অপ্রকৃতস্থ হওয়াটা, যেন সব কিছুকে ছাড়িয়ে চলে গেলেন কোনও অন্যলোকে। সাবদারের শেষ আবদার— কারণ কিছুই তো হয়না, হয়নি।

ভালো থাকবেন, সাবদার ভাই।

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, লেখক ও শিক্ষক।
ইমেইল: afsan.c@gmail.com

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত