ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারির পর পেরিয়ে গেছে ১৩টি বছর। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় এখনও জমা পড়েনি তদন্ত প্রতিবেদন। এতগুলো বছর ধরে শুধু ছেলে ও ছেলের বউয়ের খুনিদের দেখার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন মা সালেহা মনির।
মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এখন পর্যন্ত ১১৫ বার সময় নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৭ জানুয়ারি মামলাটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য ছিলো। তবে ওই দিন মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। এজন্য ঢাকার মহানগর হাকিম জি.এম. ফারহান ইশতিয়াকের আদালত প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ ২ মার্চ ধার্য করেন।
র্যাব ১২ বছর ধরে হত্যাকাণ্ডটির তদন্ত করলেও গত ৩০ সেপ্টেম্বর তাদের এই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয় উচ্চ আদালত।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সেদিন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি মুহাম্মদ মাহবুব উল ইসলামের হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ এক আদেশে বলে, সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলার তদন্ত এখন থেকে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স করবে, যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে গঠিত হবে।
সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত চেয়ে করা রিট আবেদনের আদেশ সংশোধন চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত এই আদেশ দিয়েছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আজিজুল হক জানান, “হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী মামলার তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তবে এখনই তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে কিছু বলা যাবে না। তদন্ত সাপেক্ষে আমরা যথাসময়ে প্রতিবেদন দাখিল করবো। আশা করি খুবই শীঘ্রই এই প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।”
তের বছরের বেশি সময় পার হলেও ছেলে হত্যার বিচার না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির। তিনি বলেন, “অন্ধকারের মধ্যে পড়ে আছি। প্রত্যাশার বা আশার কিছু নেই। পিবিআই তদন্তভার নিয়েছে। দেখি তারা কতদূর কি করেন। এরপর বুঝবো কতদূর অগ্রসর হতে পারেন। তাদের একটা কথায় বলেছি, চোরের দোহায় বা ডাকাতির দোহায় দিবেন না। আমি এটা মেনে নিব না। চোর চুরি করতে এলে চুরি করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাবে। আর ডাকাতরা অস্ত্র নিয়ে আসবে, তারা মারবে না। এটা বলে দিয়েছি।”
ছেলে ও ছেলের বউকে কেন খুন করা হলো বেঁচে থাকতে দেখে যেতে চান উল্লেখ করে সালেহা মনির বলেন, “শুধু এটুকু দেখে যেতে চাই কেন, কিসের জন্য ওদের খুন করা হলো। কারা এই খুনের সাথে জড়িত, তাদের দেখে মরতে চাই। এরপর কি হলো না হলো (বিচার) জানার দরকার নেই। এখন পর্যন্ত ছেলের কবরস্থানে যাইনি। রুনির মা তো চলে গেছে (মারা গেছে)। এখন আমি একা আছি। দেখি আল্লাহ ভরসা।”
বর্তমান সরকারের প্রতি প্রত্যাশা ব্যক্ত করে সালেহা মনির বলেন, “গত সরকার আমাদের জন্য কিছু করে নাই। আমাদের আশা, এই সরকারের সময় হত্যার রহস্য উদঘাটন হবে। ড. ইউনূস সরকারের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা, সঠিকভাবে যেন মামলার তদন্ত শেষে দোষীদের বের করেন।”
মামলার বাদী এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনির ছোট ভাই নওশের আলম রোমান জানান, “আমাদের একটাই কথা, বিচার চাই। নতুন করে আর চাওয়ার কি আছে। সরকার ৬ মাস সময় দিছে। দেখি, অপেক্ষা করি কি দাঁড়ায়।”
ঢাকা জজ কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সাবেক ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর এহসানুল হক সমাজী জানান, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ (৫) ধারায় ১২০ কার্যদিবসের মধ্যে কোন মামলার তদন্ত শেষ করার বিধান রয়েছে। তবে তা বাধ্যতামূলক নয়। তার পরও কোন মামলার তদন্ত চলতে বাধা নেই।
তিনি বলেন, “তবে এই নয় যে, তা বছরের পর বছর চলতে থাকবে। মামলার তদন্ত সঠিকভাবে হচ্ছে কি না? এবিষয়ে আদালতের নজরদারি বাড়াতে হবে। আদালত তদন্ত কর্মকর্তাকে কেস ডায়েরিসহ তলব করতে পারেন। তদন্ত কর্মকর্তার কেস ডায়েরি পর্যালোচনা করে যদি ম্যাজিষ্ট্রেট দেখেন যে, তদন্ত কর্মকর্তা ইচ্ছা করে তদন্ত বিলম্ব করছে। তবে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিতে পারেন। একই সঙ্গে পরবর্তী ধার্য্য তারিখের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিতে পারেন।
মামলার তদন্ত প্রতিবেদন পেছানোর জন্য রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষ উভয়ে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে উল্লেখ করে আসামি পক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ আবু সাইদ সিদ্দিকী (টিপু) বলেন, “মামলাটা নিয়ে আমরা পরিশ্রান্ত। বারবার বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত করছে। এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনও উন্নতি হয়নি। এ থেকে পরিত্রাণ চাই। আশা করি তদন্ত প্রতিবেদনে আসামিরা অব্যাহতি পাবেন।”
২০১২ সালের বছর ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রুনি নিজেদের ভাড়া বাসায় খুন হন। পরদিন ভোরে তাদের ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। ওইদিন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ঘটনাস্থলে এসে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তারপর ১৩ বছর পেরিয়ে গেলেও ফলাফল শূন্য।
আদালত সুত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সাগর-রুনির ভাড়া বাসার নিরাপত্তা প্রহরী এনামুল হক ও পলাশ রুদ্র পাল ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দেয়। এ পর্যন্ত ১৫৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে র্যাব।
মামলার আসামিরা হলেন, রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মাসুম মিন্টু, কামরুল ইসলাম ওরফে অরুন, আবু সাঈদ, সাগর-রুনির বাড়ির ২ নিরাপত্তারক্ষী পলাশ রুদ্র পাল ও এনায়েত আহমেদ এবং তাদের ‘বন্ধু’ তানভীর রহমান খান। এদের মধ্যে তানভীর ও পলাশ জামিনে রয়েছে; বাকিরা কারাগারে রয়েছেন।