প্রায় তিন যুগ আগের সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলায় দুজন দণ্ডিত হলেও খালাস পেয়েছেন তিনজন যাদের দুজনকে খুনের পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই।
বুধবার ঢাকার আদালতের দেওয়া রায়ে খালাসপ্রাপ্ত তিনজন হলেন সগিরা মোর্শেদের ভাসুর ডা. হাসান আলী চৌধুরী (৭১), তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিন (৬৫) এবং মন্টু মণ্ডল ওরফে মিন্টু। এদের মধ্যে হাসান ও শাহিন খুনের পরিকল্পনাকারী হিসাবে চিহ্নিত ছিলেন।
খুনি হিসাবে চিহ্নিত ছিলেন শাহিনের ভাই আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান এবং মারুফ রেজা। তাদের দুজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ হয়েছে ঢাকার তৃতীয় বিশেষ দায়রা জজ মোহাম্মদ আলী হোসাইনের দেওয়া রায়ে।
বুধবার রায়ের পরপরই সগিরার মেয়ে আদালতে অসন্তোষ জানিয়েছিলেন। পরিকল্পনাকারীদের সাজা না হওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছিলেন তিনি।
তিন আসামির খালাসের বিষয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মামলার বাদী আসামিদের সম্পর্কে কোনো বক্তব্য দেন নাই, এ বিষয়ে তিনি কোনও সাক্ষ্য প্রমাণ দিতে পারেননি।
“১৬৪ ধারায় জবানন্দি দিলেও সেটির সমর্থনে কোনও সাক্ষ্য প্রমাণ দিতে পারেন নাই। এমনকি ওই বাড়ি কিংবা তার আশপাশের কোনও সাক্ষীও হাজির করতে পারেননি। মামলার বিচার চলাকালে সাক্ষ্যে পারিবারিক বিরোধের বিষয়টিও আসেনি। যে কারণে আদালত তাদেরকে খালাস দিয়েছেন।”
এক বাড়িতে থাকার মধ্যে দুই জায়ের বিরোধ থেকে ১৯৮৯ সালে সগিরাকে হত্যা করা হয়েছিল বলে মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল। তিন দশক পরে অধিকতর তদন্তে নেমে পিবিআই এই খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করে। পিবিআই কর্মকর্তারা বলেন, পারিবারিক বিরোধ থেকে ভাড়াটিয়া খুনি দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল।
দুই আসামির সাজার বিষয়ে জানতে চাইলে আসামি পক্ষের আইনজীবী কাজল বলেন, “এই দুই আসামির বিরুদ্ধে পিডব্লিউ-৮ সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ সাক্ষী এ দুজনের বিষয়ে সরাসরি সাক্ষ্য দিয়েছেন। এই কারণে তাদেরকে সাজা দিয়েছেন আদালত।”
তবে এই সাজার বিরুদ্ধেও আপিল করবেন বলে জানান তিনি।
মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী ফারুক আহমেদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আদালত এ আসামিদের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি বিশ্বাস করেনি। আদালত মনে করেছেন, সঠিকভাবে এই স্বীকারোক্তি রেকর্ড হয়নি।”
এই মামলায় চারজন আসামি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “সেখানে(আদালত) দুজনেরটা গ্রহণ করে সাজা দিয়েছেন, আর দুজনেরটা গ্রহণ করেননি। এসব বিবেচনায় নিয়ে আদালত তাদের খালাস দিয়েছেন।”
বাদীর সঙ্গে আলোচনা করে খালাসে পাওয়া আসামিদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করবেন বলে তিনি জানান।
সগিরা মোর্শেদের স্বামী, মামলার বাদী আব্দুস সালাম চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, এ রায়ে বেশি সন্তুষ্টও না, আবার একেবারে অসন্তুষ্টও নন। মূল পরিকল্পনাকারী হিসাবে যার নাম এজহারে ছিল, তাদের খালাস পাওয়া তার কাছে বোধগম্য নয়।
আপিলে যাবেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এখনও সিদ্ধান্ত নিইনি। তবে দুই একদিনের মধ্যে নিতে পারি।”
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পরও কেন আসামি খালাস পেলেন- জানতে চাইলে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হেলাল উদ্দিন মোল্লা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখানে দেখতে হবে, আসামি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিজেকে জড়িয়ে দিয়েছেন, নাকি নিজেকে না জড়িয়ে দিয়েছেন?
“আসামি যদি নিজেকে না জড়িয়ে জবানবন্দি দেন এবং তাতে যদি কোনও লুপ হোল থাকে, তাহলে রায় শুদ্ধ আছে। আর যদি নিজেকে জড়িয়ে স্বীকারোক্তি দেন এবং তার পক্ষে সাক্ষ্য সাবুদও সমর্থন করে, তাহলে রায়ের ভিন্ন চিন্তা হতে পারে।”
এ মামলায় ৫৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়। গত ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে আলোচিত মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে। এরপর দুই দফা পিছিয়ে বুধবার রায় হয়।
৩৫ বছর আগে ১৯৮৯ সালে রাজধানীর ভিকারুননিসা স্কুলে নিজ সন্তানকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে খুন হন সগিরা মোর্শেদ। সে সময়ের আলোচিত এ ঘটনায় ২০১৯ সাল পর্যন্ত সবাই জানত, ছিনতাইকারীর গুলিতে নিহত হয়েছেন তিনি।
আসামির আবেদনে দীর্ঘদিন হাইকোর্টে মামলাটি ঝুলে থাকার পর আদালতের আদেশে তদন্তের দায়িত্ব নেয় পিবিআই। তারা ২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারি অভিযোগপত্র জমা দেয়।
তার আগে পুলিশ মন্টুর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছিল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে ১৯৯১ সালে বিচারও শুরু হয়েছিল। সাক্ষ্যগ্রহণ চলাকালে মারুফ রেজার নাম আসায় রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে ১৯৯১ সালের ২৩ মে অধিকতর তদন্তের আদেশ হয়। তারপর মারুফ রেজা হাই কোর্টে গেলে ঝুলে গিয়েছিল বিচার।