পঁয়ত্রিশ বছর আগে ঢাকার সড়কে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন সগিরা মোর্শেদ। ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় খুন হন তিনি, ঘটনাটি এমনভাবেই সাজানো হয়েছিল। দীর্ঘদিন পরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে বেরিয়ে আসে, কীভাবে পারিবারিক বিরোধে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন তিনি।
বুধবার সেই মামলার রায় দিয়েছে ঢাকার আদালত। তাতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে দুই আসামি আনাস মাহমুদ রেজওয়ান ও মারুফ রেজার। তাদের ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়েছে।
খালাস পেয়েছেন অন্য তিন আসামি সাগিরার ভাসুর হাসান আলী চৌধুরী, তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিন এবং মন্টু মণ্ডল নামে অন্য এক ব্যক্তি।
দণ্ডিত রেজওয়ান সগিরার জা সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিনের ভাই।
ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩ এর বিচারক মোহাম্মদ আলী হোসাইনের দেওয়া এই রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সন্তোষ প্রকাশ করলেও বাদী পক্ষ সংক্ষুব্ধ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী হিসাবে চিহ্নিতরা খালাস পাওয়ায়।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রফিক উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেছেন, ওই দুজনকে খালাস দেওয়া নিয়ে আপিলে যাবেন কি না, তা পূর্ণাঙ্গ রায় দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন।
খালাসপ্রাপ্ত দুই আসামির পক্ষে আইনজীবী ছিলেন এহসানুল হক সমাজী ও মোশাররফ হোসেন কাজল।
১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই বিকালে স্কুল থেকে মেয়েকে আনতে রিকশায় করে যাওয়ার পথে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছিল সগিরাকে।
সেদিনই রমনা থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন সগিরার স্বামী সালাম চৌধুরী। সেই মামলায় পুলিশ মিন্টুকে আসামি করে অভিযোগপত্র দিলে ১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি অভিযোগ গঠন করে বিচারও শুরু হয়েছিল আদালতে।
তবে এরশাদ আমলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদুল হাসানের নিকটাত্মীয় মারুফ রেজার নাম বাদী পক্ষের সাক্ষ্যে আসার পর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে ১৯৯১ সালের ২৩ মে বিচারিক আদালত অধিকতর তদন্তের আদেশ দেয়।
এরপর মারুফ রেজা উচ্চ আদালতে গেলে ঝুলে যায় মামলা। সেই জট কাটালে ২০১৯ সালে অধিকতর তদন্তে নামে পিবিআই। তাতেই বেরিয়ে আসে আসল ঘটনা।
তদন্ত শেষে পিবিআই ২০২০ সালের ১৪ জানুয়ারি চারজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। তাতে বলা হয়, পারিবারিক দ্বন্দ্ব থেকে সগিরাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন আসামিরা। আর তা বাস্তবায়নের জন্য ভাড়াটে খুনি নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
ওই বছরের ২ ডিসেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরুর পর বুধবার রায় হলো।
দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে এই মামলার অধিকতর তদন্তের দেখভাল করছিলেন পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার শাহাদাত হোসেন। তিনি ২০১৯ সালে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছিলেন তদন্তের আদ্যোপান্ত।
কী কারণে খুন
বিবিসি বাংলার সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ঘটনার সূত্রপাত ১৯৮৫ সাল থেকে।
সগিরার স্বামী সালাম চৌধুরী তার তিন ভাইয়ের মধ্য সবার ছোট। চাকরি সূত্রে তিনি সপরিবারে ইরাকে থাকলেও ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে ফিরে ঢাকায় রাজারবাগ পেট্রোল পাম্পের কাছে পৈত্রিক বাড়িতে থাকতে শুরু করেন।
দোতলা বাড়ির নিচতলায় বড় ভাই সামসুল আলম চৌধুরীর থাকতেন। ওপরের তলায় থাকতেন সালাম দম্পতি ও তাদের তিন মেয়ে।
তাদের মেজ ভাই ডা. হাসান আলী চৌধুরী স্ত্রী-সন্তানসহ লিবিয়ায় থাকলেও ১৯৮৫ সালে তারাও দেশে ফিরে আসেন। তারা প্রথম কিছুদিন ওই বাড়ির নিচতলায় ছিলেন। পরে দ্বিতীয় তলায় সালাম দম্পতির সঙ্গে থাকা শুরু করেন।
তখন থেকেই জা শাহিনের সঙ্গে সগিরার বিভিন্ন বিষয়ে কলহ শুরু হয় বলে পিবিআইর তদন্তকারীরা জানতে পারেন।
১৯৮৬ সালে বাড়ির তৃতীয় তলার কাজ শেষ হলে হাসান ও শাহিন সেই তলায় উঠে গেলেও নানা কারণে দুই জার মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়তেই থাকে।
শাহিনের অভিযোগ, তিনি স্বল্প শিক্ষিত বলে তাকে তাচ্ছিল্য করা হতো। অন্যদিকে সালামের দাবি, তার স্ত্রী উচ্চশিক্ষিত ও চাকরিজীবী হওয়ায় সবাই ঈর্ষান্বিত ছিলেন।
পিবিআই কর্মকর্তারা বলছেন, সগিরাকে শায়েস্তা করতে হাসান আলী ও তার স্ত্রী শাহিন এই হত্যার পরিকল্পনা করেন এবং ২৫ হাজার টাকায় মারুফ রেজার সঙ্গে চুক্তি করেন।
সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী, সগিরা যখন মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে যান, তখন সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
রিকশাচালকের বয়ানে চিহ্নিত হন খুনিরা
ঘটনার ত্রিশ বছর পর তদন্তে নেমে ছিনতাইয়ের সঙ্গে এর মিল খুঁজে পাচ্ছিলেন না পিবিআই কর্মকর্তারা। তখন তারা খুঁজতে থাকেন প্রত্যক্ষদর্শী সেই রিকশাচালক আবদুস সালামকে। জানতে পারেন, তার বাড়ি জামালপুরে।
কিন্তু সেখানে তাকে না পেলেও খোঁজ চলতেই থাকে। তাতে পাওয়া যায় সেই সালামকে। জিজ্ঞাসাবাদে এই রিকশাচালক জানান, ভিকারুননিসা নূন স্কুলের কাছে মোটর সাইকেলে করে আসা দুই যুবক তার রিকশার পথ আটকায়।
সালামের ভাষ্যে, ওই দুই যুবক সগিরার হাতব্যাগটি ছিনিয়ে নেয় এবং তার পরনে থাকা সোনার বালা ধরে টানাটানি শুরু করলে সগিরা বলে ওঠেন, ‘আমি আপনাকে চিনি’। এই কথা বলার পরই অন্য যুবক পিস্তল বের করে সগিরাকে লক্ষ্য করে দুটি গুলি ছোড়েন।
সগিরা যে নামটি বলেছিলেন, তা সালামের কাছে জেনে এবং দুই যুবকের দেহের অবয়ব সম্পর্কে ধারণা নিয়ে পিবিআই নতুন পথে অনুসন্ধান শুরু করে।
পিবিআই কর্মকর্তা শাহদাত বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, “সগিরা মোর্শেদ যেহেতু ছিনতাইকারীকে চিনতে পেরেছেন এবং তার পরপরই তাকে হত্যা করা হয়েছে, এর অর্থ খুনিদের কেউ তার পরিচিত হবেন। এবং তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।”
এরপর রিকশাচালকের দেওয়া শারীরিক বর্ণনা ধরে শাহীনের ভাই রেজওয়ান ও মারুফ রেজাকে চিহ্নিত করে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
পরে হাসান ও তার স্ত্রী শাহিনকেও গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের কাছে রেজওয়ান স্বীকার করেন, বোন ও ভগ্নিপতির পরিকল্পনায় তিনি ও মারুফ রেজা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন।