অসুস্থ কোনও আত্মীয়-স্বজন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এলেই ডাক পড়তো রেদুয়ান হোসেন সাগরের। হাসপাতালে দৌঁড়ঝাপের কাজটা সাগর করতো বেশ ভালোবেসে।
কোটা সংস্কারের দাবিতে গত ১৯ জুলাই যখন সারাদেশ উত্তাল, সেদিনও এমনই একজনকে সহযোগিতার কথা বলে হাসপাতালে যান ২৪ বছর বয়সী সাগর। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা পেরোয়, সাগর বাড়ি ফেরে না। দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে পরিবারের সদস্যদের কপালে।
সাগরের বাবা মো আসাদুজ্জামান বলেন, “তার ফোনে কল দিই, রিসিভ করে না। হঠাৎ তার ফোন থেকে অপরিচিত একজন কল করে জানায়, গুলিবিদ্ধ হয়ে সাগর হাসপাতালে আছে। শুনেই আমার ছোট ভাই আকরামুজ্জামান হাসপাতালে ছুটে যায়। গিয়ে দেখে, সাগর আর নেই।”
২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে কোটা তুলে দিয়েছিল সরকার। তবে হাইকোর্টের এক রায়ে কোটা পুনর্বহাল হলে তার প্রতিক্রিয়ায় এই মাসের শুরুতে পুনরায় আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা।
আন্দোলন শুরুতে অহিংস থাকলেও ১৪ জুলাই তা সহিংস আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৬ জুলাই সারাদেশে ৬ শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেলে রাতেই দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজসহ স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে এসব পদক্ষেপ সত্ত্বেও পুলিশ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। তাতে অনেকে হতাহত হয়।
এর মধ্যে ১৯ জুলাই হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বের হলে সাগরের বুকের বাম ও ডান পাশে গুলি লাগে। সেদিনই রাত ৮টার দিকে কয়েকজন অ্যাম্বুলেন্সে করে মরদেহ বাসায় পৌঁছে দেয়। পরদিন সকাল ১০টায় জানাজা শেষে ময়মনসিংহের মাদ্রাসা কোয়ার্টার কবরস্থানে দাফন করা হয় সাগরকে।
ময়মনসিংহ নগরীর চৌরঙ্গীমোড় এলাকায় মো. আসাদুজ্জামানের ছেলে রেদুয়ান হোসেন সাগর। শত দুঃখ কষ্টের মাঝেও এক ছেলে এবং মেয়েকে নিয়ে ভালোই চলছিল আসাদুজ্জামান ও রহিমা খাতুন দম্পত্তির সংসার। হঠাৎ কোটা আন্দোলনের ঝড়ে থমকে গেল তাদের জীবন চলার গতি।
শুক্রবার চৌরঙ্গীমোড়ে সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে কথা হয় নিহত সাগরের বাবা আসাদুজ্জামানের। ছেলের মৃত্যু শোক সামলে উঠতে পারেননি।
তিনি বলেন, “আমার ছেলেটা অত্যন্ত নম্র-ভদ্র ছিল। কোনও দিন কারও সঙ্গে বেয়াদবি করেনি। কারও দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। তার এমন মৃত্যুতে কষ্ট আছে, কিন্তু দুঃখ করি না। সব আল্লাহর ইচ্ছা। সে দিয়েছে আবার ভালো মনে করে নিয়ে গেছে।”
সাগরের মৃত্যুকে ‘কপালের লিখন’ বলেই মেনে নিয়েছেন এই বাবা। তিনি বলেন, “এ ঘটনায় কাউকে দায়ী করি না। পুলিশ এসে আমাদের খোঁজখবর নিয়েছে, তারা বলেছে কোনও অভিযোগ থাকলে করার জন্য। কিন্তু আমরা কোনও অভিযোগ করতে চাই না। তবে আর কোনও আন্দোলনে যেন কোনও বাবা-মায়ের কোল এভাবে খালি না হয়। দেশে শান্তি ফিরে আসুক।”
পেশায় ব্যবসায়ী আসাদুজ্জামান ও রহিমা খাতুন দম্পত্তির দুই ছেলে মেয়ের মধ্যে বড় রেদুয়ান হোসেন সাগর। ফুলবাড়িয়া ডিগ্রী কলেজে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে অনার্স চতুর্থ বর্ষে পড়তেন তিনি। সাগরের মা রহিমা খাতুন আট বছর ধরে ক্যান্সার আক্রান্ত।
সাগরকে বাবার স্নেহ দিয়েছেন চাচা মো আশরাফুজ্জামান। জন্মের পর থেকে তাকে সাগর ডেকেছেন বাবা বলেই। জলভরা চোখে তিনি বলেন, “সাগরের কোনও প্রয়োজন হলে আমার কাছেই আবদার করত। সে আমাদের বংশের বড় সন্তান। আমিও তাকে সন্তানের মতো মানুষ করেছি।”
আইটিতে সাগরের খুব দক্ষতা ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “সে সবসময় ব্যতিক্রম কিছু করার চেষ্টা করত। ছেলেটা আমাদের এভাবে ছেড়ে যাবে বুঝতে পারিনি। এক বছর আগে তার বাবা বাড়ি করেছে। যার জন্য করেছে সেই তো আজ নেই।”
সাগর কোনও রাজনীতি করতেন না বলেও জানান তিনি।
ময়মনসিংহ কোতোয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মাঈন উদ্দিন বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে সদরে সাগর নামে এক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। তবে নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় কেউ কোনও অভিযোগ করেনি। তারপরও বিষয়টি খতিয়ে দেখে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।