Beta
শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫

সাগর-রুনি খুন : অজ্ঞাত দুজনেই আটকে আছে তদন্ত

মেহেরুন রুনি ও সাগর সরওয়ার।
মেহেরুন রুনি ও সাগর সরওয়ার।
[publishpress_authors_box]

৪৮ ঘণ্টার ঘোষণা থেকে ১২ বছরে গড়াল, এখনও জানা গেল না কীভাবে নিজের ঘরে খুন হলেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি।

থানা পুলিশ থেকে তদন্ত ভার গিয়েছিল ডিবির হাতে, তাদের ব্যর্থতা স্বীকারের পর এক যুগ ধরে তদন্ত চালিয়ে আসছে র‌্যাব, কিন্তু এখনও কূলের সন্ধান পায়নি তারা। অভিযোগপত্র দিতে আদালতের কাছে তাদের শতাধিক বার সময়ও নেওয়া হয়ে গেছে।

সাংবাদিকদের ক্ষোভ, নিহতদের স্বজনদের অসন্তোষের মধ্যে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তকর্তাদের কাছে সকাল সন্ধ্যার পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হলেও কেউ মুখ খুলছেন না।

তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আগের মতোই বলেছেন, তারা ‘সর্বোচ্চ গুরুত্ব’ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।

তদন্তের গতি কোথায় গিয়ে থমকে আছে- খুঁজতে গেলে জানা যায়, এক যুগ আগে যেখানে ছিল, সেখানেই আটকে আছে তদন্ত।

শুরুর দিকে তদন্তে যুক্ত ছিলেন, এমন একজন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আলামত বিশ্লেষণ ও তথ্য পর্যালোচনায় প্রাথমিক পর্যায়েই গুরুত্বপূর্ণ ধারণা মিলেছিল।

“তবে সাক্ষ্য ও প্রমাণ সংগ্রহের সময় বাধে বিপত্তি। নানা বাধা আসে, সাংবাদিক মহল থেকেও আসে। তারপর তদন্ত সঠিক পথে এগোতে পারেনি। মূলত তখনই গন্তব্য ও গতি হারায় তদন্ত।”

তদন্তের প্রয়োজনে গ্রেপ্তার বিভিন্ন জনের পাশাপাশি আরও অনেকের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। সাগর-রুনির ঘরে পাওয়া বিভিন্ন নমুনার সঙ্গে তার মিল খুঁজতে আলামত পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে।

এরপর বলা হয়েছিল, ঘটনাস্থলে দুজন ব্যক্তির ডিএনএ পাওয়া গেছে, যাদের সঙ্গে অন্য কারও নমুনা মিলছে না।

অজ্ঞাত সেই ব্যক্তিরা এখনও অজ্ঞাতই রয়েছেন। সেখানেই আটকে আছে তদন্ত।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। ফাইল ছবি

এনিয়ে শনিবার সকাল সন্ধ্যার প্রশ্নে র‌্যাব মুখপাত্র আল মঈন বলেন, “সন্দেহভাজন আসামিসহ ২৫ জনের সোয়াবসহ নানা আলামত ডিএনএ পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আইএফএস (ইনডিপেনডেন্ট ফরেনসিক সার্ভিস) পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছিল। ওই পরীক্ষাগার থেকে পাওয়া প্রতিবেদনে দুজন অজ্ঞাত ব্যক্তির ডিএনএ পাওয়া যায়। ওই অজ্ঞাত ব্যক্তিদের এখনও আমরা শনাক্ত করতে পারিনি।”

মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রুনি তাদের একমাত্র সন্তানকে নিয়ে থাকতেন ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারের একটি ফ্ল্যাটে।

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সকালে সেই ফ্ল্যাটেই তাদের রক্তাক্ত লাশ পাওয়া যায়। তখন শুধু তাদের পাঁচ বছরের ছেলেটিই শুধু ঘরে ছিল।

সাগরের দেহে ধারাল অস্ত্রের কয়েক ডজন আঘাতের চিহ্ন ছিল। যা দেখে পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছিলেন, যেন খুনির সবটুকু ক্ষোভ ছিল তার উপর।

হাত ও পা বাঁধা সাগরের দেহে বাঁটবিহীন দুটি ছুরি বিঁধে ছিল, ঘরে পাওয়া গিয়েছিল রক্তমাখা একটি বটি। রুনির পেটে ও পাঁজরে ছিল ধারা অস্ত্রের দুটি আঘাতের চিহ্ন।

খুনিরা অপেশাদার, তাদের দেহের ক্ষতচিহ্ন দেখে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা বলেছিলেন তখন। খুনিরা পূর্ব পরিচিত বলে সন্দেহের কথা জানিয়েছিলেন পুলিশ কর্মকর্তারা।  

মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব শুরুতে পেয়েছিলেন শেরেবাংলা নগর থানার এসআই জহুরুল ইসলাম। তার কাছ থেকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ডিবির পরিদর্শক রবিউল আলমকে।

তদন্তকালে নজর রেখেছেন, ডিবির এমন এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “একই ঘরে ও একই ঘটনায় দুজনের মৃত্যু হলেও ভিন্নতা আছে ধরনে।

“দীর্ঘ সময় ধরে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে সাগরকে। তার শরীরে ২৮টি আঘাতের চিহ্ন ইঙ্গিত করে, তিনি চরম প্রতিহিংসা ও ক্ষোভের শিকার। হাত-পা ও মুখ বেঁধে তাকে রান্নাঘরের বটি দিয়ে কোপানো হয়েছে, ব্যবহার হয়েছে ফল কাটার দুটি চাকু। ফরেনসিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাগর ‍ও রুনির মৃত্যুর ব্যবধান ন্যূনতম দুই ঘণ্টা।”

সেই রাতে কর্মস্থল থেকে মধ্যরাতে ঘরে ফিরেছিলেন সাগর। সন্তানসহ রুনি বাড়িতেই ছিলেন। সকালে তাদের লাশ উদ্ধার হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিবির ওই কর্মকর্তা বলেন, “ভিন্ন সংস্থার তদন্তে ভিন্ন কিছু আসতে পারে। সময়ে অনেক ধারণা পুরো উল্টে যায়, আবার প্রাথমিক ধারণা প্রতিষ্ঠায় শক্ত প্রমাণও জুটে যায়। এক্ষেত্রে কী ঘটেছে, তা শুধু সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা বলতে পারেন।”

হত্যাকাণ্ডের তদন্তে আসা ডিবি ৬২ দিন পর আদালতের কাছে ব্যর্থতা স্বীকার করলে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল তদন্তের দায়িত্বে আসে র‌্যাব। তারপর র‌্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা বদলালেও তদন্তের অগ্রগতির আর খবর মেলেনি। বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা কয়েক মাস হলো মামলাটি হাতে পেয়েছেন।

তদন্তের দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে র‌্যাবের মুখপাত্র বলেন, “প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করতে সময় লাগছে। নির্দোষ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন, সেদিকটা দেখতে হচ্ছে। এসব কারণে অভিযোগপত্র দিতে দেরি হচ্ছে।”

কবে নাগাদ তদন্ত শেষ হতে পারে- জানতে চাইলে তার উত্তর আসে, “এখনই তা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।”

তদন্ত শেষ করতে র‌্যাবের ১০৭ বার সময় নেওয়ার প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি সংসদে এক প্রশ্নে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, “৫০ বছর সময় লাগলেও তা তদন্তকারীদের দিতে হবে।”

সহকর্মীর খুনিদের গ্রেপ্তার করতে প্রতি বছরই সাংবাদিকরা পালন করেন কর্মসূচি।

হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু খুনি চিহ্নিত হওয়ার আগেই তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়তে হয়েছিল।

ঘটনার এক সপ্তাহ পর তৎকালীন পুলিশ প্রধান হাসান মাহমুদ খন্দকার তদন্তে ‘প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি’র খবর দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই অগ্রগতিও দেখা যায়নি।

পেশাগত বিরোধ, সম্পত্তি ও ব্যক্তিগত শত্রুতা- এই তিনটি বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেছিলেন তখনকার পুলিশ কর্মকর্তারা।

কয়েকদিন পর ডিএমপির তৎকালীন মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম বলেছিলেন, ডাকাতি-চুরিসহ ছয়টি কারণকে সামনে রেখে তদন্ত চলছে।

একটি ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, স্বর্ণালঙ্কার ও ১১শ ইউরো খোয়া যাওয়ার কথাও বলেছিলেন তিনি।

এক সময় এক দল গ্রিল কাটা চোরকে ধরে তারাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল দাবি করে কয়েক মাস পর ঘটা করে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন সাহারার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়া মহীউদ্দীন খান আলমগীর।

তখন রুনির বন্ধু তানভীর রহমানসহ সন্দেহভাজন আটজনকে আটকের খবর দিয়েছিলেন মন্ত্রী। অন্য সন্দেহভাজন আসামিরা হলেন- এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবির, রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু ওরফে মাসুম মিন্টু, কামরুল হাসান অরুণ, আবু সাঈদ এবং বাড়ির দারোয়ান পলাশ রুদ্র পাল। এদের অধিকাংশই বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণ চন্দ্র দত্ত হত্যামামলার আসামি।

ডাকাতি-চুরির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে সাগর-রুনির ফ্ল্যাটের ১ ফুট ৮ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের গ্রিল কাটা অংশ দিয়ে মানুষ ঢোকানোর মহড়াও চালিয়েছিল পুলিশ। ছোট শিশু ছাড়া সেই ফাঁক দিয়ে কাউকে ঢোকানো সম্ভবপর হয়নি।

ফলে সেদিকেও তদন্ত আর এগোয়নি। এখনও উপসংহারে পৌঁছতে পারেননি তদন্ত কর্মকর্তারা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত