ম্যাচ শুরুর আগে যখন ফিলিস্তিনের জাতীয় সঙ্গীত বাজতে থাকে, মোহাম্মেদ সালেহর দু চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে। শুধু শরীরটাই যেন মাঠে থাকে, এই ফিলিস্তিনি ফুটবলারের মনটা পড়ে থাকে গাজায়। সালেহর প্রিয় জন্মভূমিতে।
বিশ্বকাপ বাছাইয়ের অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলতে এখন ঢাকায় ফিলিস্তিন ফুটবল দল। ২৬ মার্চ বসুন্ধরা কিংস অ্যারিনায় বাংলাদেশের মুখোমুখি হবে ফিলিস্তিন। ২৩ সদস্যের দলের ফুটবলারদের মধ্যে জেরুজালেমে জন্ম ওদে দাব্বাঘের। এই ফরোয়ার্ড ২১ মার্চ কুয়েতে বাংলাদেশের বিপক্ষে হোম ম্যাচে করেছিলেন হ্যাটট্রিক। তার সতীর্থ জেয়িদ কুনবার, সামের জনডি, মুসা ফারাবি, সামের জুবাইদার বেড়ে ওঠা জেরুজালেমে। এই দলে রামাল্লার ফুটবলার মোহাম্মেদ খলিল, মোহাম্মেদ রশিদ, মাহদি আসি। এছাড়া নাবলুসের মাহমুদ আবু ওয়ারদা, আহমেদ সাওয়াফতাও খেলছেন এবারের ফিলিস্তিন দলে।
পুরো দলের মধ্যে গাজায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা একমাত্র ফুটবলার সালেহ। গাজার দক্ষিণাঞ্চলের রিমাল নামের স্থানে তার বাড়ি। গত বছর ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েল আক্রমণের পর সবেচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জনপদের নাম গাজা। যেখানে শিশু, নারী ও পুরুষ সবাই দুঃস্বপ্নে দিনাতিপাত করছে।
যে দুঃস্বপ্নের ঘেরাটোপে বন্দী সালেহর পরিবারও। রবিবার দুপুরে রাজধানীর এক পাঁচ তারকা হোটেলের লবিতে বসে কথা হচ্ছিল সালেহর সঙ্গে। পরিবারের খবরটা জানতে চাইলে সালেহর চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠে। গত জানুয়ারিতে কাতারে অনুষ্ঠিত এএফসি এশিয়ান কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরুর কয়েকদিন আগে ইসরায়েল সৈন্যদের বোমা হামলায় মারা গেছে সালেহর চাচা-চাচী ও চাচাতো ভাইবোনরা।
তিনি সেই দুঃখের ঘটনার বর্ণনা করছিলেন এভাবেই, “গাজায় প্রতিটি দিন আসে আগের দিনের চেয়েও খারাপ হয়ে। ভাগ্যক্রমে সেদিন আমার বাবা-মা বেঁচে গিয়েছিল। আমার পুরো পরিবার এক বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। অক্টোবর মাসের ওই ভয়াবহ আক্রমণের সময় খোলা তাবুর নিচে বেশ কিছুদিন কাটাতে হয়েছিল তাদের।”
সালেহ ফুটবল খেলার সুবাদে থাকেন মিশরে। সেখানকার ফুটবল ক্লাব আল ইত্তিহাদ আলেক্সান্দ্রিয়ায় খেলছেন তিনি। স্ত্রী এবং সাড়ে তিন বছরের কন্যাকে নিয়ে সেখানেই থাকেন এই ফিলিস্তিনি ডিফেন্ডার।
কিন্তু দেশের বাইরে থেকে পরিবারের এমন অসহনীয় দুর্দশা সহ্য করতে পারেন না। এই তো কদিন আগেও অবরূদ্ধ গাজা ভূখন্ডে ত্রাণের অপেক্ষায় থাকা ফিলিস্তিনের ভীড়ে নির্বিচারে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। এই খবরটাও শুনেছেন সালেহ। এই আক্রমণে মারা গেছে ২০ জন নিরীহ ফিলিস্তিনি।
টিভিতে এসব খবর দেখেন আর দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি, “এই মুহূর্তে আমার কতটা খারাপ লাগছে সেটা বলে বোঝানো কঠিন। এই রমজানেও তারা ক্ষুধায় কাতর। না খেয়ে মরছে। সেখানে যা হচ্ছে তা অবিশ্বাস্য। কিন্তু এই সব মানুষের বাড়ি ঘরে ফেরার জন্য আমাদের কিছু করতে হবে।”
সেই কিছু একটা করার জন্যই ফুটবল মাঠে সালেহ আওয়াজ তোলেন, “যুদ্ধ বন্ধ করো। গণহত্যা বন্ধ করো। আমার পুরো পরিবারই যে এখন ভয়াবহ যুদ্ধের শিকার।”
নিজের শৈশব, যুদ্ধবিধ্বস্ত ভূখন্ডে বেড়ে ওঠা, সেখানে ফুটবল খেলার স্মৃতিচারণা করছিলেন সালেহ, “গাজায় ফুটবলার হওয়া খুবই কঠিন। কিন্তু আমরা জানি যুদ্ধ আর ইসরায়েল দখলদারিত্বের থেকে মুক্তির একটাই উপায় ফুটবল। সেখানকার তরুণ ও শিশুরা ফুটবলের দিকেই বেশি ঝুকে পড়ে। কারণ তারা মনে করে এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় ফুটবল। একমাত্র ফুটবলই তাদের সব কষ্ট ভুলিয়ে রাখে।”
সালেহ ফুটবল খেলা শুরু করেন গাজার ইয়ারমুক স্টেডিয়ামে। গত বছর ডিসেম্বরে সেই স্টেডিয়াম গুড়িয়ে দেয় ইসরায়েলের সৈন্যরা। সেই কষ্টের কথা বলতে গিয়ে সালেহর চোখে মুখে ভেসে ওঠে ইসরায়েলে প্রতি ক্ষোভ, “ইয়ারমুক স্টেডিয়ামে আমার ফুটবলের হাতেখড়ি। এখন সেই স্টেডিয়াম বলতে শুধুই খোলা মাঠ। যেখানে শত শত শিশু, নারী, পুরুষকে দিনের পর দিন খালি গায়ে বেঁধে রেখেছিল। এই কষ্ট বর্ণনা করাও কঠিন। যুদ্ধে যেসব শিশু মারা গেছে ওদের মুখ আমি কিছুতেই ভুলতে পারিনা।”
এমন যন্ত্রণা বুকে নিয়েও ফিলিস্তিন ফুটবল দল মাঠে দুর্বার। কাতারে এশিয়ান কাপে দুর্দান্ত ফুটবল খেলে তারা প্রথমবার নক আউটে পৌঁছে। এখন বিশ্বকাপ বাছাইয়েও চমৎকার খেলছে তারা। ৩ ম্যাচে ১ জয়, ১ ড্র ও ১ হারে ৪ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের দ্বিতীয় স্থানে ফিলিস্তিন। ২১ মার্চ কুয়েতে বাংলাদেশকে ৫-০ গোলে হারিয়ে ওই একটি জয় পেয়েছে ফিলিস্তিন।
যুদ্ধে স্বজন হারানোর ব্যাথা নিয়ে মাঠে ফুটবল খেলাটা কঠিন। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের কাছে এই ফুটবলই যেন ধ্বংসস্তূপে বেঁচে থাকার অনুষঙ্গ। সালেহ এটা স্পষ্ট করেন এভাবে, “আমাদের এমন কয়েকজন ফুটবলার আছে যাদের পরিবার ক্যাম্পে থাকার সময় শহীদ হয়েছিল। কিন্তু আমরা যোদ্ধা। দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ। আমরা তাদের জন্য খেলি। গাজার মানুষের জন্য খেলি। এই দল আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক।”
গাজার খেলোয়াড়রা ইসরায়েলের দখল করা পশ্চিম তীরে ঢুকতে পারেন না। পশ্চিম তীরের খেলোয়াড়রাও গাজায় যেতে পারেন না। এ ছাড়া বাইরের কোনও খেলোয়াড়ও ফিলিস্তিনে যেতে পারেন না। এমন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ফিলিস্তিনের জাতীয় দলে সাড়া দিয়েছেন প্রবাসী ফিলিস্তিনিরাও। এভাবেই জাতীয় দলে অন্তর্ভূক্ত হয়েছেন সুইডেনের ফরোয়ার্ড মাইকেল তারমানিনি, মাহমুদ ধাধা ইদ, চিলির ক্যামিলিও সালদানা। কোনো না কোনোভাবে তাদের মূল প্রোথিত আছে ফিলিস্তিনে।
ফিলিস্তিনের মানুষের প্রতি বাড়তি আবেগ রয়েছে বাংলাদেশের দর্শকদেরও। গত বছর নভেম্বরে লেবাননের বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ম্যাচে ফিলিস্তিনের সমর্থনে পতাকা হাতে নিয়ে মাঠ ঘুরেছিলেন জাতীয় দলের ডিফেন্ডার বিশ্বনাথ ঘোষসহ অন্যরা। দর্শকেরাও সঙ্গে এনেছিলেন ফিলিস্তিনের পতাকা।
বাংলাদেশের মানুষের এই ভালোবাসার খবর অজানা নয় সালেহর, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমি সব খবর দেখি। অনেক বাংলাদেশি আমাকে খুদে বার্তা পাঠায়। বাংলাদেশসহ সব মুসলিমদের ধন্যবাদ আমাদের সমর্থন দেওয়ার জন্য।”
বারুদের গন্ধে যাদের ঘুম ভাঙে, মৃত্যু যাদের কাছে স্বাভাবিক ঘটনা সেই ফিলিস্তিনের মানুষের মুখে এত কষ্টের মাঝেও হাসি ফোটায় ফুটবল। বাংলাদেশের বিপক্ষে অ্যাওয়ে ম্যাচটি জিতে সালেহ আরও একবার যুদ্ধ বিধ্বস্ত জনপদের মানুষের জন্য বয়ে আনতে চান এক টুকরো হাসি।