Beta
বৃহস্পতিবার, ১ মে, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ১ মে, ২০২৫

সনজীদা খাতুন : সাঙ্গ হলো শেকড় অন্বেষীর জীবন ভ্রমণ

সনজীদা খাতুন।
সনজীদা খাতুন।
[publishpress_authors_box]

জাতি হিসাবে বাঙালির আত্মপরিচয়ের শেকড় সন্ধানে যাদের ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে, তাদের একজন সনজীদা খাতুন চিরবিদায় নিলেন।

ঢাকার বেসরকারি একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার তার জীবনাবসান ঘটে। তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।

ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ জানিয়েছেন, সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় ঢাকার ধানমণ্ডির ছায়ানট ভবনে সনজীদা খাতুনের মরদেহ রাখা হবে।

গত শতকের ষাটের দশকে বাঙালির স্বাধিকারের দাবি স্বাধিনতার চেতনায় রূপায়নের ক্ষেত্রে যে ছায়ানটের ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, ১৯৬১ সালে তা গড়ে তোলার অন্যতম কারিগর ছিলেন সনজীদা খাতুন।

আমৃত্যু ছায়নটের সভাপতি ছিলেন সনজীদা খাতুন। তার তার মৃত্যুতে ছায়ানট শোক জানিয়ে বার্তা দিয়েছে তাদের ফেইসবুক পাতায়।

সন্‌জীদা খাতুনের জীবনের জীবন ভ্রমণ নিয়ে কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, “গান তার জীবিকা নয়, গান তার জীবন, চারপাশের মানুষজনের সঙ্গে মিশে যাওয়া এক জীবন।

“ধর্মতলা স্ট্রিটের প্রথম পরিচয়ে জেনেছিলাম যে দেশের আত্মপরিচয় খুঁজছেন তিনি রবীন্দ্রনাথের গানে, আর আজ জানি যে সে-গানে তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন নিজেরই আত্মপরিচয়।”

আবুল আহসান চৌধুরী ও পিয়াস মজিদের সম্পাদনায় ‘বড়ো বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে: সন্‌জীদা খাতুন সম্মাননা’ স্মারক গ্রন্থে শঙ্খ ঘোষের এই লেখাটি প্রকাশিত হয় ।

সন্‌জীদা খাতুনের চিন্তার-লেখার বড় অংশজুড়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ব্যাপক পরিসরে জনমানসে কবিগুরুকে পৌঁছে দেওয়ার কাজে ঐতিহাসিক ভূমিকায় ছিলেন তিনি।

গত কয়েক বছর ধরেই বাধর্ক্যজনিত নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন সনজীদা খাতুন। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। তার কিডনিরও সমস্যা ছিল।

অবস্থার অবনতি ঘটায় ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে গত ১৯ মার্চ তাকে পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। জটিল অবস্থার কারণে তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছিল।

সনজিদা খাতুনের স্বামী লেখক, গবেষক ওয়াহিদুল হক ২০০৭ সালে মারা যান। তাদের ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ, মেয়ে রুচিরা তাবাসসুম নভেদ। আরেক মেয়ে অপালা ফারহদ নবেদ অকালে মারা যান।

সনজীদা একাধারে ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, শিক্ষক, লেখক, গবেষক, সংগঠক, সঙ্গীতজ্ঞ। দেশে একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারের পাশাপাশি ভারত সরকারের বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’ খেতাবে ভূষিত ছিলেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কারেও ভূষিত তিনি।

সনজীদা খাতুন ১৬টি গ্রন্থের রচয়িতা। ছায়ানটের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘নালন্দা বিদ্যালয়’র সভাপতিও ছিলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের মেয়ে সন্‌জীদার জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল।

তার পড়াশোনার শুরু কামরুন্নেসা স্কুলে। পরে পড়েছেন ইডেন কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শান্তি নিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে ১৯৭৮ সালে সেখান থেকেই তিনি পিএইচডি করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা শেষে অবসর নেওয়ার পর ছায়ানট নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন সন্‌জীদা খাতুন। তার ডাক নাম ছিল মিনু, সবার কাছে তখন ‘মিনু আপা’ নামে পরিচিতই না কেবল, ভরসার স্থানও ছিলেন তিনি।

শৈশবেই গানের সঙ্গে মিতালী পাতান সনজীদা। গানের সুর আর ছন্দে বাল্যকালেই মোহিত ছিলেন জানিয়ে নিজের জন্মদিনের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “শেষ বিকেলে দক্ষিণের বারান্দায় পাটি পেতে বড়দি গান গাইতে বসতেন। নানা ধরনের গান। আমার আকর্ষণ ছিল একটি গানে, তৃষ্ণার জল এসো এসো হে। অপেক্ষা করতাম বড়দি কতক্ষণে গাইবেন – এসো এসো হে তৃষ্ণার জল, কলকল ছলছল / ভেদ করো কঠিনের ক্রুর বক্ষতল কলকল ছলছল। এসো এসো উৎসস্রোতে গূঢ় অন্ধকার হতে এসো হে নির্মল কলকল ছলছল।

“বছর পাঁচেক বয়সে বড়দির ওস্তাদজি প্রসিদ্ধ ঠুমরি গায়ক মহম্মদ হোসেন দাদুর কাছে গানের হাতেখড়ি হয়েছিল। ক্রমে গান শিখলাম, গাইলাম। রেডিওতে, পরে টেলিভিশনে।”

সানজীদা খাতুনের ভাই কাজী আনোয়ার হোসেন ‘মাসুদ রানা’র স্রষ্টা হিসাবে ব্যাপক পরিচিত হলেও তিনিও গান গাইতেন। তাদের বোন ফাহমিদা খাতুনও গান গাইতেন।

জন্মবার্ষিকীর সেই অনুষ্ঠানে ছায়ানট প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সন্‌জীদা খাতুন বলেছিলেন, “ছায়ানটের ‘শ্রোতার আসর’ করতে গিয়ে দেশে সংগীতশিল্পীর অভাব টের পেলাম। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ‘ছায়ানট সঙ্গীতবিদ্যায়তন শুরু হলে তার সঙ্গে যুক্ত হলাম। গানের শিক্ষা, সাধনা আর প্রসারের কাজে আগাপাশতলা সম্পৃক্ত হয়ে গেলাম।

“এ আন্দোলনের আনন্দ জীবনের সব চাওয়া-পাওয়াকে ছাড়িয়ে গেল। এই ধারাতেই আরো একটি আন্দোলনের সূত্রপাত হল কিছুকাল পরে ‘জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ’ এর অন্তত ত্রিশ/পঁয়ত্রিশটি শাখায় ঘুরে ঘুরে, কখনো বা ঢাকাতে শাখা প্রতিনিধিদের ডেকে এনে সংগীতশিক্ষার আয়োজন করা হয়েছিল। এতে সঙ্গীতের সম্প্রসারণ ঝটিকাগতি পেল।”

পাকিস্তান আমলে যখন রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধের আয়োজন চলছিল, তখন ছায়ানটের উদ্যোক্তারাই তার প্রতিবাদ তুলেছিলেন। বাঙালির শেকড় অন্বেষায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান দিয়েছিল দিশা।

এটি এখন পহেলা বৈশাখ বরণের অনুষঙ্গই শুধু না, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনার জয়গানও গাইছে এই আয়োজন। সেই কারণে ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুও হয় ছায়ানট।

২০০১ সালে রমনায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার পর নতুন এক ভাবনায় ছায়ানটের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসাবে নালন্দা বিদ্যালয় গড়ে তোলেন সনজীদা ও ওয়াহিদুল হক মিলে।

তার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সনজীদা বলেছিলেন, “২০০১ অর্থাৎ ১৪০৮ সালের পয়লা বৈশাখে বটমূলে বোমা হামলার পর সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সুফল নিয়ে আমাদের আত্মসন্তোষ বিরাট ধাক্কা খেল। বোঝা গেল, পূর্ণাঙ্গ মানুষ গড়ে তুলবার উপযোগী শিক্ষার অভাব অতি প্রকট।

“তখন আঁকা-গড়া, নাচ-গান, আবৃত্তি-অভিনয়ের আনন্দময় শিক্ষার মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ মানুষ তৈরি করবার নতুন আন্দোলন দানা বাঁধে। সর্বাঙ্গসুন্দর শিশুশিক্ষার কাজে প্রতিষ্ঠা করা গেল ‘নালন্দা’ বিদ্যালয়’। ”

কর্মময় এক জীবন পেরিয়ে ২০২৩ সালে নিজের ৯০ বছর পূর্তিতে ছায়ানট আয়োজিত অনুষ্ঠানে সনজীদা বলেছিলেন, “অল্পে তুষ্ট সহজ সরল জীবনের এই সার্থকতায় আমি ধন্য হয়েছি।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত