ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের ফেসবুক পেজে ঢুঁ মারলেই চোখে পড়বে ছবিটি। কলকাতা বিমান বন্দরে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে সানজিদা আক্তার। গলায় পরা লাল-হলুদ উত্তরীয়।
বুধবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ জাতীয় দলের উইঙ্গার সানজিদাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা দেন ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের নারী দলের ম্যানেজার ইন্দ্রানী সরকার। যে ফুলের তোড়া দিয়ে সানজিদাকে শুভেচ্ছা জানানো হলো সেই গোলাপগুলোতেও ছিল লাল-হলুদের সমারোহ!
ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের নারী ফুটবল দলের ইতিহাসে প্রথম বিদেশি সানজিদা। খেলবেন ভারতীয় নারী ফুটবল লিগে এবারের মৌসুমে। সাফজয়ী এই ফুটবলারের নাড়ি পোতা ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায়।
ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবে পা রেখে সানজিদা যেন ময়মনসিংহবাসীকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন পুরনো সেই দিনে! এক সময় অবিভক্ত ভারতে ময়মনসিংহ থেকে ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবে খেলেছেন বহু দিকপাল ফুটবলার।
এদেরই একজন মণিভূষণ দত্ত রায়। যাকে সবাই ভানু নামে চিনতেন। তিনি ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের দ্বিতীয় অধিনায়ক। মনিভূষণের হাতে অধিনায়কত্বের বাহুবন্ধনী ছিল ১৯২৩ সালে। ময়মনসিংহে জন্ম এই ডিফেন্ডার ১৯২১ থেকে ১৯৩৪ একটানা ১৪ বছর ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে খেলেছেন।
রাখাল মজুমদারের নামটি জড়িয়ে আছে ইস্ট বেঙ্গলের ফুটবল ইতিহাসে। ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব প্রথম আইএফএ শিল্ড চ্যাম্পিয়ন হয় ১৯৪৩ সালে রাখাল মজুমদারের অধিনায়কত্বেই। ময়মনসিংহে জন্ম বিখ্যাত এই ডিফেন্ডার ১৯৩৭ থেকে ১৯৫১ সাল, একটানা ১৫ বছর ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে খেলেছেন।
ভূপেন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত যাকে পাখি সেন নামেই চিনতেন সবাই। ময়মনসিংহে জন্ম এই ফরোয়ার্ড ১৯৩৭ সালে ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবে খেলেন। যদিও রেলওয়েতে চাকরির কারণে পরবর্তীতে আর ইস্ট বেঙ্গলের হয়ে খেলা সম্ভব হয় নি তার। পাখি সেন ছিলেন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র।
ইংল্যান্ডের একটি বিখ্যাত ফুটবল দল আইলিংটন কোরিন্থিয়ান দেশের বাইরে গিয়ে ফুটবলকে জনপ্রিয় করে তোলার প্রয়াস চালায় এক সময়। এরাই মূলত ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকায় ফুটবল নিয়ে যায়।
পেশাদার দল কোরিন্থিয়ান ঢাকায় ফুটবল ম্যাচে অংশ নেয় ১৯৩৭ সালের ২১ নভেম্বর। প্রতিপক্ষ ছিল ডিএসএ (ঢাকা একাদশ) দল।
ওই সময়ের অপ্রতিরোধ্য কোরিন্থিয়ান দলকে ১-০ গোলে হারিয়ে দেয় ঢাকা একাদশ। সেই ম্যাচের একমাত্র গোলটি ছিল পাখি সেনের। ওই দলটি তাদের ভারত সফরে ৩১ ম্যাচে ২৫ টিতে জয়ী হয়। ড্র হয়েছিল ৫ ম্যাচ। আর যে ১টি ম্যাচে হেরেছিল ওই ম্যাচের নায়ক ময়মনসিংহের পাখি সেন।
ম্যাচ শেষে কোরিন্থিয়ান অধিনায়ক পি বি ক্লার্ক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “বাংলার রয়েল বেঙ্গল টাইগারের নাম শুনেছিলাম। এবার চোখে দেখলাম।” কলকাতার ওয়ারী ক্লাবেরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন পাখি সেন।
ইস্ট বেঙ্গলের জন্মের ইতিহাসেও যে জড়িয়ে আছে ময়মনসিংহের নাম। ইস্ট বেঙ্গলের প্রতিষ্ঠাতা সুরেশ রায় চৌধুরীর বাড়ি তো তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহেই। বর্তমানে যেটি অবস্থিত টাঙ্গাইলের নাগরপুরে। সেই নাগরপুরের চৌধুরী বাড়ির সন্তান সুরেশ রায় ছিলেন অপেক্ষাকৃত পাশ্চাত্য সংস্কৃতিঘেষা। তিনি ছিলেন অনেকের চেয়ে সৌখিন। ছিলেন ক্রীড়ামোদী।
জমিদার উপেন্দ্র মোহন চৌধুরীর ছোট ছেলে সুরেশ রায় ছিলেন একটু এক রোখা ও জেদিও।
১৯২০ সালের আগস্ট মাস। নতুন ক্লাব তৈরি হয়ে গেছে । কিন্তু সেই ক্লাবকে পরিচিতি পেতে কোনও একটা প্রতিযোগিতায় খেলতেই হবে। এদিকে আগস্ট মাসে ময়দানে লিগের খেলা চলে। মাঝপথে সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনাই নেই। এদিকে নতুন তৈরি হওয়া দল এক বছর বসে থাকতে চায় না।
হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিলেন না সুরেশ রায়। তিনি আর রায়বাহাদুর তড়িৎভূষণ রায় ক্লাবের তখনকার যুগ্ম-সম্পাদক। নতুন ক্লাবে তাঁরা জড়ো করেছেন কলকাতার বিভিন্ন দলে খেলা পূর্ব বাংলার ফুটবলারদের। কলকাতার নানা ক্লাবে পূর্ব বাংলার ফুটবলার প্রকৃত সম্মান পান না বলেই তো নিলেন নতুন ক্লাব গড়ার সিদ্ধান্ত। কেবল পূর্ব বঙ্গের মানুষ বলেই জোড়াবাগান ক্লাব মোহনবাগানের সঙ্গে ম্যাচে বেঞ্চে বসিয়ে রাখেন শৈলেশ বসুর মতো ফুটবলারকে। সুরেশ রায় এরই প্রতিবাদে ছেড়ে দিয়েছিলেন জোড়াবাগান ক্লাবের সহ-সভাপতির পদ। ঠিক করেন নতুন দল গড়বেন। তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন অনেক বিত্তবান মানুষও। নতুন ক্লাবের নাম দেওয়া হয় ‘ইস্টবেঙ্গল। সেই নামের সঙ্গে মিশে থাকা এই বাংলার আবেগটাও কোথায় যেন কাজ করেছিল।
ময়মনসিংহের মেয়ে সানজিদা কি ইস্ট বেঙ্গলের জন্মের সেই ইতিহাসটা জানেন? জেনে থাকলে নিশ্চয় লাল-হলুদের জার্সিতে শতভাগের বেশিই উজাড় করে দিতে চাইবেন।