এক সময় ছাত্রলীগে যুক্ত থাকলেও এখন আর নেই দাবি করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেছেন, তার পুরনো কিছু ছবি সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের মধ্যে ব্যাপক-সহিংসতার মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা যখন চাপে রয়েছেন, তখন সারজিসের ছাত্রলীগ সম্পৃক্ততা নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় আলোচনা চলছে। কারও কারও লেখায় সারজিসকে সরকারের চর হিসাবেও চিহ্নিত করা হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে শুক্রবার এক ফেইসবুক পোস্টে সারজিস নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। তিনি ২০২২ সালেই ছাত্রলীগ ছেড়েছিলেন এবং কোটা সংস্কারের দাবিতে এবার আন্দোলনের শুরু থেকেই তিনি সক্রিয়।
পঞ্চগড়ের ছেলে সারজিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি অমর একুশে হলের আবাসিক ছাত্র।
ছাত্রলীগে যুক্ত হওয়া যেভাবে
ছাত্রলীগে যুক্ত হওয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে সারজিস লিখেছেন, “২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১ম বর্ষে থাকা অবস্থায় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হলে উঠি ৷ ঢাবির ছেলেদের হলে উঠার একমাত্র উপায় হচ্ছে পলিটিক্যালি ওঠা ৷ হলের সিটের ব্যাপারে প্রশাসনের তেমন কোনও হাত নেই ৷ আপনি যে আদর্শে বিশ্বাস করেন না কেন, বর্তমানে ঢাবির হলে থাকতে হলে অন্তত ১ম, ২য়, ৩য় বর্ষে আপনাকে ছাত্রলীগ করতে হবে ৷ ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম, গেস্টরুম করতে হবে ৷ এটা বাধ্যতামূলক ৷ নাহলে হলে থাকতে পারবেন না।”
২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে হল ছাত্র সংসদে সদস্য পদে নির্বাচন করেছিলেন সারজিস, জয়ীও হন।
তিনি লিখেছেন, “আমি ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে হল সংসদে ইলেকশন করি। ছাত্রলীগের প্যানেলের ১৩ জনের মধ্যে ৭ জন নির্বাচিত হয়েছিলো ৷ ৬ জন স্বতন্ত্র থেকে ছিল ৷ স্টুডেন্টদের কাছে যাদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল, তারাই নির্বাচিত হয়েছিল।
“সদস্যদের মধ্যে আমি সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিলাম ৷ ইভেন ভিপি-জিএসের চেয়েও বেশি ভোট পেয়েছিলাম। একুশে হল আর এফএইচ হলে যে সবচেয়ে সুন্দর ও স্বচ্ছ ভোট হয়েছিল, সেটা তখনকার কাউকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন।”
ছাত্রলীগ ছাড়ার ২ কারণ
পরিবার আওয়ামী লীগঘোঁষা হলেও ২০২২ সালের এপ্রিলে ছাত্রলীগ ছেড়েছিলেন জানিয়ে সারজিস বলছেন, দুটি কারণে তার ওই সিদ্ধান্ত।
ফেইসবুকে তিনি লিখেছেন, “প্রথমত, তখন হল প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারির থেকে আমার মাধ্যমে জুনিয়দের জন্য যে নির্দেশ আসত, সেটা আমার কাছেই অযৌক্তিক, অন্যায় ও জুলুম মনে হতো। যেটা আমার কাছেই অযৌক্তিক, সেটা আমি কখনও আমার জুনিয়রদের উপর চাপিয়ে দিতে পারি না। সে জায়গা থেকে নিজের বিবেকবোধকে প্রায়োরিটি দিয়ে আমি ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে সরে যাই ৷
“দ্বিতীয়ত, যারা ১ বছর বা তার বেশি সময় ধরে আমার সাথে ফেইসবুকে যুক্ত আছেন, তারা জানেন আমি বিভিন্ন ইস্যুতে সরকার ও ছাত্রলীগ নিয়ে সরকারবিরোধীদের চেয়ে কঠোরভাবে যৌক্তিক সমালোচনা করার চেষ্টা করি। আমার টাইমলাইন ঘাঁটলেই তা পাওয়া যাবে ৷
“সে জায়গা থেকে হল ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি আমাকে অনেকবার রুমে এবং গেস্টরুমে ডেকে এসব লেখালেখির জন্য সতর্ক করে ৷ কিন্তু কাজ হয়নি ৷ সবশেষে হল ছাত্রলীগের কমিটি হওয়ার পূর্বে আমাকে একটি অপশন বেছে নিতে বলা হয় ৷ লেখালিখি করব অথবা ছাত্রলীগ করব। আমি নির্দ্বিধায় আমার লেখালিখিকে বেছে নিই। ফলে ছাত্রলীগের কোনও কমিটিতে আমার কোনও পোস্ট (পদ) নেই।”
আওয়ামী লীগের সঙ্গে দূরত্বের ব্যাখ্যায় সারজিস আরও লিখেছেন, “আমার বাবা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। আমার কাছে দলের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ইথিকস, ব্যক্তিত্ব, আদর্শ ৷
“সেদিক দিয়ে আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষমতাসীন দলগুলোর এত সমালোচনা করার পরও বাবা আমাকে কখনও কিছু বলেনি ৷ আমাকে আমার বিবেকবোধ দিয়ে চিন্তা করার সুযোগ দিয়েছে। ইভেন এই নির্বাচনে আমি বাড়িতে থাকার পরও যখন ভোট দিতে যাইনি, তখনও কিছু বলেনি।”
ছবির ব্যাখ্যা
ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে সারজিসের একটি এবং ছাত্রলীগের এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার আরেকটি ছবি ঘুরছে ফেইসবুকে। যার ভিত্তিতে বলা হচ্ছে, সারজিস আসলে ছাত্রলীগে যুক্ত।
সেই ছবিগুলো নিয়ে সারজিস লিখেছেন, “একটা ২০১৯ সালে হল ছাত্রলীগের কোনও প্রোগ্রামের। হলের টিভি রুমে ডায়াসের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার ভঙ্গিতে তোলা। তখনকার সময় অনুযায়ী জুনিয়র হিসেবে এসব শখ করে তোলা। সবাই তোলে।
“অন্য ছবিটি ক্রিকেট টুর্নামেন্টের ম্যান অব দ্য সিরিজ ট্রফি নেওয়ার সময়। ঢাবি-পঞ্চগড় অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ওই প্রতিযোগিতায় সাদ্দাম ভাই অতিথি ছিল। যেহেতু তার বাড়ি পঞ্চগড়ে এবং তখন তিনি ডাকসুর এজিএস ও ঢাবির সেক্রেটারি।”
“আপনারা যারা কিছু না জেনে ২-৩টা ছবি দেখে মনমতো অনেক কিছু বলে ফেলছেন, আপনাদের সাথে ক্ষমতাসীন দলের অন্ধ ভক্তদের কোনও পার্থক্য নেই। ক্ষমতায় আসলে আপনিও তাদের মতো হবেন, তাতে সন্দেহ নেই,” লিখেছেন সারজিস।
যেভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলনে
২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে নিয়োগে কোটা তুলে নিয়েছিল। কিন্তু গত মাসে হাইকোর্টের এক রায়ে তা পুনর্বহাল হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
কোটা সংস্কারের জন্য সরকারের কাছে দাবি রেখে গড়ে ওঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। জুলাইয়ে তারা রাজপথে কর্মসূচি নিয়ে নামে।
শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র হিসাবে নানা কর্মসূচি দিয়ে আসছিলেন। এরপর নাহিদের পাশাপাশি আরও কয়েকজন সমন্বয়ক পরিচয়ে সামনে আসেন। তাদের মধ্যে সারজিসের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী আসিফ মাহমুদও রয়েছেন। পরে তারা জানান, সারাদেশে মোট ৬৫ জন এই আন্দোলনে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছেন।
এই আন্দোলনে নিজের সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়ে সারজিস লিখেছেন, “২০২৪ এর কোটা আন্দোলনে আমি যুক্ত হই ঢাবি সাইন্স লাইব্রেরির প্রতিনিধি হিসেবে। পরবর্তীতে যখন এটি ব্যাপক আকার ধারণ করে, তখন মনে হয়েছিল, এমন একটি জাতীয় আন্দোলনের অংশ হতে পারাও সৌভাগ্যের বিষয় ৷
“আন্দোলনে প্রথম ধাক্কা আমার ওপরই আসে। সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করার কারণে ছাত্রলীগ হল থেকে বের করে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু সেদিন আমার হল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইয়েরা সে বাধায় প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।”
আন্দেোলনের সমন্বয়ক হিসাবে নানা কর্মসূচি নিয়ে শাহবাগে নিয়মিতই আসতেন সারজিস। গত ১৪ জুলাই রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি দিতে বঙ্গভবনে যে প্রতিনিধি দলটি গিয়েছিল, সেখানেও সারজিসও ছিলেন।
১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীরা ছাত্রলীগের হামলার শিকার হওয়ার পরদিন থেকে এই আন্দোলন সংঘাতে গড়ায় সারাদেশে। সরকার প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়।
তবে তার পর ১৯ জুলাই থেকে পরবর্তী চারদিন সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতা হয়, তাতে দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে সরকার।
এরমধ্যে আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ও আসিফকে তুলে নিয়ে নির্যাতন চালানোর অভিযোগ ওঠে। উল্টো দিকে সারজিসসহ কয়েকজনকে দেখা যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় গিয়ে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। তা নিয়ে সমালোচনার ওঠার পর সারজিস ব্যাখ্যা দেন, তারা আলোচনা করতে যাননি, কেবল দাবিগুলো জানাতে গিয়েছিলেন।
তার এই অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন ওঠার প্রেক্ষাপটে সারজিস লিখেছেন, “যারা এসব করছে, তারা চায় এভাবে একজন একজন করে প্রশ্নবিদ্ধ করে আমাদের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করার, আন্দোলনটাকে নষ্ট করে ফেলার। তাছাড়া অনেকের অনেক অসৎ উদ্দেশ্য আছে। যেগুলোতে আমাকে বাধা মনে করলে তারা এসব প্রোপাগান্ডা করে।”
নিজের সামগ্রিক অবস্থান ব্যাখ্যা করে এই শিক্ষার্থী বলছেন, “আমি মানুষ। আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে, অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধতা আছে। ভুলভ্রান্তি আছে। কিন্তু আমি নিজেকে সংশোধন করতে, ভুল থেকে শিক্ষা নিতে সবসময় প্রস্তুত।
“আমি জানি আমাদের সাথে পুরো দেশের মানুষ রয়েছেন। নানা মতের, নানা দলের, বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের। সবার চাওয়া ব্যক্তি, দল বা আদর্শ অনুযায়ী ভিন্ন। আমি জানি, সবার চাওয়া আমার দ্বারা পূরণ করা সম্ভব না, সেই আশাও করি না, সেই চেষ্টা করাও বৃথা।
“কিন্তু আমি এটুকু নিশ্চিত জানি- আমার উদ্দেশ্য কী, আমার কী করা উচিৎ, আমার কোথায় গিয়ে থামতে হবে। এখন পর্যন্ত যা করেছি, তা এই বিষয়গুলোকে সামনে রেখেই করেছি। বিবেকের সাথে বিন্দুমাত্র আপস করে নয়।”