Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪

১৪ মার্চ: কাকতালের ফাঁকতালে বিজ্ঞান ও তিন মনীষী

pi day coincidence final
[publishpress_authors_box]

রিডার্স ডাইজেস্ট জানাচ্ছে, গত শতকের সবচেয়ে কাকতালীয় ঘটনা হচ্ছে দু্টি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ থেকে জাপানি নাগরিক সুতোমো ইয়ামাগুচির বেঁচে যাওয়া।  

১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট, যুক্তরাষ্ট্র যথাক্রমে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে যে দুইটি পারমাণবিক বোমা ফেলে তাতে ৯০ হাজার মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে মারা যান। পরে তেজস্ক্রিয়তায় মারা যান আরও অনেকে, শত শত মানুষ হন পঙ্গু। ২০০৯ সালে, জাপানি সরকার নিশ্চিত করে যে বোমা হামলার দিন দুটি শহরেই অন্তত একজন মানুষ ছিলেন, যিনি বেঁচে গিয়েছিলেন, অক্ষত অবস্থাতেই দুইবারই। তার নামই শুরুতে বলেছি।   

৬ আগস্ট ইয়ামাগুচি ব্যবসায়িক ভ্রমণে হিরোশিমায় ছিলেন। আর ৯ আগস্টের মধ্যে তিনি নাগাসাকিতে নিজ বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন। দুইবার তেজষ্ক্রিয় বোমা বিস্ফোরণের মধ্যে পরেও, ইয়ামাগুচি ৯৩ বছর বেঁচে ছিলেন। তিনি ২০১০ সালে পেটের ক্যান্সারে মারা যান।

তবে বিজ্ঞানের জগতে ৪টি ভিন্ন ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ১৪ মার্চ ঘটেছে। এরচেয়ে বড় কাকতাল মনে হয় না আর রয়েছে।

‘ঈশ্বরের পাশা খেলা’ ইজ ইকুয়াল্টু কাকতাল!

বিজ্ঞান কি এমন কাকতাল মেনে নেয়! ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে নিশ্চয়ই। কার্যকারণ অনুসন্ধানই তো বিজ্ঞান। কিন্তু ১৪ মার্চ দিনটি যে খোদ বিজ্ঞানের জগতেই কাকতালের দিন। 

আবার যদি ফিরে যাই ১৯৪৫ সালে। সেখানেই একটি কাকতাল নজরে আসবে। ওই বছরই আইনস্টাইন কোয়ান্টাম ফিজিক্স নিয়ে কথা বলতে গিয়ে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন- “ঈশ্বর জগতের সঙ্গে পাশা খেলেন না।” চিঠিতে তিনি আরও লিখেছিলেন, “ঈশ্বর নিরলসভাবে তার নিজের নির্ধারিত আইনের অধীনে পাশা খেলেন।”

কে জানে ‘ঈশ্বরের ওই নির্ধারিত আইন’ই হয়তো কাকতাল। নতুবা আধুনিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে প্রভাবশালী বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের জন্মদিনেই কেন এই শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের মৃত্যু হবে! মহাবিশ্ব নিয়ে হকিংয়ের চিন্তা ও গবেষণা একবিংশ শতাব্দীতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় এখনকার দুনিয়ায়।

বিজ্ঞানকে পাশে রেখেই বিজ্ঞানের সীমা ছাড়িয়ে আইনস্টাইন এবং হকিং দুইজনেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে তো বটেই, সারাবিশ্বের মানুষের কাছে ফিলানথ্রপিস্ট।  

অবশ্য কাকতালের এখানেই শেষ নয়। গত দেড়শ বছর পৃথিবীর ইতিহাসের আরেক আলোচিত ব্যক্তিও কিন্তু হকিংয়ের মৃত্যুর দিন মারা গেছেন। তার নাম কার্ল মার্ক্স। হকিং যেমন মহাবিশ্বের স্বরূপ নিয়ে  হাজির হয়েছিলেন- বিগ ব্যাং থেকে ব্লাকহোল ব্যাখ্যা করেছেন, তেমনি কার্ল মার্ক্সও পুঁজির বিস্ফোরণ এবং এর অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া নিয়ে প্রথম ভিন্ন দৃষ্টিতে বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। 

অর্থনীতিবিদ (নাকি সমাজবিজ্ঞানী বলবো!) কার্ল মার্ক্স নিজের সত্তাকে ছাড়িয়ে আধুনিক সমাজবিজ্ঞান, পুঁজির বিজ্ঞানকে খণ্ডেছেন গণিতের ভাষাতেই। তাহলে দাঁড়ালো কী? 

গত দুইশ বছরে পৃথিবীকে বদলে দেওয়া তিনজন বিজ্ঞানী কাকতালে জড়িয়ে রয়েছেন ১৪ মার্চ দিনটির সঙ্গে। 

কেবল গুণীরা নন সংখ্যাও সামিল কাকতালে 

এবারের কাকতালটা পিলে চমকানোর মতো। বলা হয়, বিজ্ঞানের ভাষা নাকি গণিত। মহাবিশ্বও কথা বলে এই ভাষাতেই। উপরের তিনজনের মধ্যে মার্ক্স ও আইনস্টাইনের মাতৃভাষা জার্মান এবং হকিংয়ের মাতৃভাষা ইংরেজি হলেও, এদের সবার আসল ভাষা গণিত। 

আর এই গণিত শাস্ত্রের সবচেয়ে রহস্যময় একটি ধ্রুবক হচ্ছে ‘পাই’ (π)। যার মান অসীম। ভগ্নাংশের পর ‘পাই’ এর মান বের করতে যে সংখ্যাগুলো বসে তা কখনোই পুন:পৌণিক নয়; অর্থাৎ আগের কোনও সংখ্যার সঙ্গে মিল না রেখেই চলতেই থাকে, অসীমের পথে, মহাবিশ্বের মতোই। 

‘পাই’ এর বহুল ব্যবহৃত মানটি হচ্ছে- ৩.১৪১৫৯…।  বৃত্ত-উপবৃত্তের ক্ষেত্রফল, অসীম সিরিজের যোগফল, পরিসংখ্যানের স্বাভাবিক বণ্টন, পদার্থবিদ্যার তরঙ্গ সমীকরণ, অনিশ্চয়তার নীতি, রসায়ন, প্রকৌশল ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও পাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে দিনকেদিন। 

বিজ্ঞানীদের একটি বড় অংশ মনে করেন, প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করা যায় ফিবোনাচ্চি রাশিমালা দ্বারা। রাশিমালাটি মনে করিয়ে দিই একটু- ০,১,১,২,৩,৫,৮…। অর্থাৎ আগের দুুটি সংখ্যা যোগ করে তৃতীয় সংখ্যা হচ্ছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যা যোগ করে চতুর্থ সংখ্যা। 

ফুলের পাঁপড়ি সংখ্যা কত হবে, খরগোশের বাচ্চা হওয়া, কিংবা উড়তে থাকা পাখির ঝাঁকে কয়টা পাখি থাকে- এ সবই নাকি এই ফিবোনাচ্চি রাশিমালার সংখ্যা অনুযায়ী হয়। 

‘পাই’ সেই ফিবোনাচ্চি রাশিমালারও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সেসব কঠিন বিজ্ঞানের আলোচনা বরং তোলা থাক। 

তো এই গুরুত্বপূর্ণ ও রহস্যময় ‘পাই’ নিয়ে একটি দিবস রয়েছে। সেটি করা হয়েছে পাইয়ের মানের প্রথম তিনটি অংক অনুযায়ী। ইংরেজিতে মার্চ হচ্ছে তৃতীয় মাস অর্থাৎ ৩ এবং এর ১৪ তারিখ= পাইয়ের মান ৩.১৪।

আগেই বলেছি পাইয়ের মান অসীম। তো ১৪ মার্চের দুপুর ১টা ৫৯ মিনিটের ২৬ সেকেন্ডকে ‘পাই সেকেন্ড’ বলা হয়। অর্থাৎ পাইয়ের মানে ধরলে ৩.১৪১৫৯২৬। ‘পাই’ সেকেন্ডেই ‘পাই’ দিবস পূর্ণতা পায়। 

১৯৮৮ সালে সান ফ্রান্সিকোর বিজ্ঞান জাদুঘরের কর্মকর্তা ও পদার্থবিদ ল্যারি শ এ দিবসটি পালন করেন প্রথম। 

ওরা তিনজন এবং আরও কিছু কাকতাল

কার্ল মার্ক্স বিয়ে করেছিলেন তার ছোট বেলার প্রেমিকা জেনিকে। এখানেও একটা মিল রয়েছে স্টিফেন হকিংয়ের সঙ্গে। হকিংয়ের দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম ‘জ’ দিয়েই- জেন হকিং। আবার সন্তান-সন্ততির দিক থেকে হকিংয়ের সঙ্গে মিল রয়েছে আইনস্টাইনের। এই দুই পদার্থবিজ্ঞানীরই দুই ছেলে, এক মেয়ে- অর্থাৎ তিনটি করে সন্তান। 

ধর্মের দিক থেকে কার্ল মার্ক্স ও আইনস্টাইন দুইজনেই ইহুদী বংশোদ্ভুত হলেও, শেষ পর্যন্ত সেই বিশ্বাসে ছিলেন না কেউই। 

আইনস্টাইন তো বলেই ছিলেন- তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন। তবে সেটি হলো ‘স্পিনোজার ঈশ্বর’।  অর্থাৎ জগতের মধ্যেই রয়েছেন ঈশ্বর। একই সঙ্গে হেঁয়ালি করেছেন কখনও নিজেকে ‘আস্তিক’ ও আবার কখনও ‘অজ্ঞেয়বাদী’ বলেও।

 ওদিকে স্টিফেন হকিং তার ঈশ্বরভাবনা ব্যক্ত করেছেন এভাবে যে, 

“শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, আমার মতো প্রতিবন্ধী মানুষদের মনে করা হতো ঈশ্বরের অভিশাপেই আমরা এ দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছি। এটা হতেই পারে যে ওপরওয়ালাকে আমি কোনও কারণে রুষ্ট করেছি, কিন্তু আমি মনে করি সবকিছুকে অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়, প্রকৃতির নিয়মের মাধ্যমে। আপনি যদি বিজ্ঞানে আস্থা রাখেন, ঠিক আমার মতো, তাহলে আপনাকে মনে রাখতে সবসময় কিছু নিয়ম আছে প্রকৃতির যেটিকে মেনে চলতে হয়। আপনি চাইলে বলতেই পারেন এই নিয়মগুলোই তৈরি করেছেন ঈশ্বর। কিন্তু এটা ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণের চেয়ে ‘ঈশ্বর কাকে বলে’ সেই সংজ্ঞাই দেওয়া হবে বরং।” 

অন্যদিকে মার্ক্স ঈশ্বর সম্পর্কে সরাসরি কিছু বলেননি। আক্রমণ করেছেন ধর্মকে। তিনি মনে করতেন ধর্ম ‘মানুষের জন্য আফিম’, আবার একইসঙ্গে ‘নিষ্ঠুর জগতের হৃদয়’ও বটে।

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, মানুষ শ্রমের মধ্য দিয়েই পূর্ণতা লাভ করে। আমরা পৃথিবী থেকে সৃষ্ট – আমরা ‘প্রকৃতির অংশ’।  ১৮৪৪ সালের তার ‘অর্থনৈতিক এবং দার্শনিক পাণ্ডুলিপি’তে এমনটাই তিনি লিখেছিলেন।

একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে- তিন গ্রেটের ঈশ্বর ভাবনায় কোথায় যেন মিল রয়েছে! 

রাজনৈতিক অবস্থান এবং প্রসঙ্গ ইসরায়েল

কার্ল মার্ক্স শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির কথা বলেছেন, লিখেছেন ম্যানিফেস্টো। বলেছেন- সোশালিজমের কথা। সাম্যবাদী সমাজের কথা।

আইনস্টাইন জীবনের শেষদিকে এসে পুঁজিবাদের ক্লেদাক্ত ও বিভৎসতা দেখে সেই সোশালিজমেরই সমর্থক হয়ে উঠেছিলেন। স্টিফেন হকিংও রাজনৈতিকভাবে লেবার পার্টি সমর্থন করতেন। অর্থাৎ এরা তিনজনই ছিলেন শ্রমিক শ্রেণির অধিকারের পক্ষের লোক। 

শুরুতে ইহুদীদের ফিলিস্তিনে পুনর্বাসনের ব্যাপারে ব্রিটেনের পরিকল্পনাকে সমর্থন করলেও আইনস্টাইন ইহুদী জাতীয়তাবাদী কিংবা জায়নবাদী আলাদা রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। 

১৯৪৮ সালে ইহুদী সন্ত্রাসবাদীরা ফিলিস্তিনের একটি গ্রামে নৃশংস হামলা চালিয়ে কয়েক শ নিরীহ নারী, পুরুষ, শিশু হত্যা করে। খবর পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই আইনস্টাইন এর প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠি লিখেছেন সেইসময়ে ফিলিস্তিনের থেকে ইসরায়েলকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা সংগঠন ‘আমেরিকান ফ্রেন্ডস অব দ্য ফাইটারস ফর দ্য ফ্রিডম অব ইসরায়েল’ এর প্রেসিডেন্টকে। 

ইসরায়েলকে সহ্য করতে না পারার দৃষ্টান্ত আইনস্টাইন আরেকবার রেখেছেন। ঘটনাটি অবশ্য মজারও। ১৯৫২ সালে ইসরায়েলের প্রথম প্রেসিডেন্ট হায়েম উইজম্যান মারা যাওয়ার পর আইনস্টাইনকে দেশটির প্রেসিডেন্ট পদ সেধেছিলেন তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেনগুরিয়ানের নেতৃত্বাধীন সরকার। 

আইনস্টাইন সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। বিজ্ঞানীর প্রত্যাখানে অবশ্য বেনগুরিয়ান হাঁপ বাঁচেন। তিনি এক সহকারীকে বলেছিলেন- আমি নাকি ওই পদের প্রস্তাব দিয়েছিলাম না পারতে, উনি রাজি হলেই আমরা বিপদে পড়বো। 

যদিও ইসরায়েলির প্রেসিডেন্ট পদ তখন থেকেই আলঙ্কারিক একটি পদ ছিল মাত্র,কিছু রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া ছাড়া বিশেষ কোনও কাজও নেই দেশটির প্রেসিডেন্টের।  

ওদিকে আরেক জিনিয়াস স্টিফেন হকিংও জীবনের শেষদিকে এসে ইসরায়েলের বিপক্ষে অবস্থান নেন। ২০০৬ সাল পর্যন্ত অন্তত চারবার ইসরায়েলে বিভিন্ন আমন্ত্রণে গিয়েছেন হকিং। কিন্তু ২০১৩ সালে এসেই বিগড়ে গেলেন। জায়নিস্ট ইসরায়েলি নেতা শিমন পেরেসের ৯০ তম জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত ‘হাই প্রোফাইল’ বিজ্ঞান কনফারেন্সে দাওয়াত কবুল করেও অংশ নিলেন না। 

প্রথমে জানা গেল, তিনি অসুস্থ বলে যাচ্ছেন না। পরে জানা গেল, ফিলিস্তিনের বিজ্ঞানীদের ইসরায়েল বয়কটের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেই যাননি হকিং। এমনকি শেষদিকে ফিলিস্তিনিদের জন্য ফেইসবুকে অর্থ সংগ্রহের আহ্বানেও সামিল হয়েছেন এই বিজ্ঞানী। 

প্রথমে ইসরায়েলের সমর্থক, পরে বিরোধিতা- হকিং ও আইনস্টাইন যেন এ আচরণেও একই সূত্রে গাঁথা।   

একটু বলেই শেষ করবো

হকিং, আইনস্টাইন, মার্কস, পাই- এগুলো তো খটোমটো বিষয়, উচ্চমার্গীয়-গুরুগম্ভীরও বটে। তবে আমির খানের ভক্তরাও দাবি করতে পারেন- তাদের প্রিয় বলিউড অভিনেতা ঠিক ওই মাপেরই কেউ,  কেননা ১৪ মার্চ তারও জন্মদিন যে!

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত