Beta
মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

কলাম

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ইতিহাস, শিল্প ও সংস্কৃতি আক্রান্ত কেন?

ঢাকায় শিশু একাডেমির সামনে শিল্পী সুলতানুল ইসলাম নির্মিত ভাস্কর্য ‘দুরন্ত’ ভেঙ্গে ফেলার আগে ও পরে।

ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী এক অক্লান্ত গণঅভুত্থানের ময়দানে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। আমাদের ধমণীতে রূপান্তর ও সংস্কারের টগবগে স্রোত। এমন একটি রাষ্ট্র আমরা চাইছি যা সর্বজনের, সর্বপ্রাণের হবে। এ চাওয়া নতুন নয়, ইতিহাস থেকে ইতিহাসে এ চাওয়ার বহু রক্তদাগ লেগে আছে। হুল, উলগুলান, খাসি বা চাকমা বিদ্রোহ, হাতিখেদা, টংক, নানকার, তেভাগা, ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম বা মুক্তিযুদ্ধে জনে জনে জনতা প্রবল কর্তৃত্ববাদ আর জুলুমকে প্রশ্ন করেছে।

তবে, ২০২৪ সালের রক্তাক্ত জুলাই কিংবা আগস্ট বিপ্লব বহু সংগ্রামী আখ্যানকে নানাভাবে অতিক্রম করেছে। বিশেষ করে স্বল্পবয়সী নেটিজেন শিক্ষার্থীদের ঐক্য সবাইকে বেহুঁশ ও সজাগ করে দিয়েছে। রাতে না ঘুমানো এই প্রজন্ম যে বুকের ভেতর বারুদ ও বীক্ষা নিয়ে বড় হচ্ছিল বড়রা তা পাঠ করতে পারে নাই। এই প্রজন্ম নিজেদের গানে, স্লোগানে, শক্তিতে ফ্যাসিবাদী বাহাদুরির বিরুদ্ধে লড়েছে। জান দিয়েছে, কিন্তু জবান মজবুত রেখেছে রাষ্ট্র মেরামতের। আমরা গণঅভ্যুত্থানের সাক্ষী। আমাদের স্মৃতি ও কলিজায় বারুদ ও রক্তের ক্ষত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে ভাস্কর শামীম শিকদারের ভাস্কর্য পার্কটিতে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়

কিন্তু, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দেশব্যাপী বিচ্ছিন্ন কিংবা হয়ত অবিচ্ছিন্ন লুটপাট, ভাংচুর, হামলা ও সহিংসতা ঘটেছে। আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণের জানমাল ও মানসিক নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। নিদারুণভাবে দেশের বহু ভাস্কর্য, স্থাপনা, শিল্পকর্ম, সংস্কৃতিকেন্দ্র, পাঠাগার, জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, সংগ্রহশালা, ভৌগলিক নির্দেশনা আক্রান্ত হয়েছে। এই ধরনের রূপকল্প আমাদের সামনে বহু ‘অমীমাংসিত প্রশ্ন’ ছলছল করে ওঠে। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি লণ্ডভণ্ড করে যখন শিল্পী সুলতানুল ইসলামের বহুল পরিচিত ভাস্কর্য ‘দুরন্তকে’ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় তখন আমরা কী বুঝব? এর আগেও আরেকবার ‘দুরন্ত’ চুরমার হয়েছিল শিশুপার্কের সামনে। গণভবন, ধানমণ্ডি ৩২ নাম্বার, বিচারপতির বাসভবন বা সালমান এফ রহমানের বাড়িতে হামলার সময় বহু শিল্পকর্ম লুট হয়েছে। শিল্পী শাহাবুদ্দিনের বহু চিত্রকর্ম সেখানে ছিল।

চুরমার হওয়া এসব ভাস্কর্য, প্রত্নবন্তু, ঐতিহাসিক নথি, দুষ্প্রাপ্য বই কিংবা শিল্পকর্ম আমাদের জাতীয় ইতিহাস এবং আত্মপরিচয় বিকাশের অংশ। আমরা যখন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়ছি, তখন আমাদের ইতিহাসের স্মারকে ‘চোরাগোপ্তা’ আরেক ফ্যাসিবাদী হামলাকে অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। কোনওভাবেই বাইনারি ন্যারেটিভ, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব বা বিপ্লব পরবর্তী সময়ে এমন অস্থিরতা হয়ে থাকে বলে সবকিছু দাবিয়ে রাখা যাবে না।

রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিতে উত্তাল ছাত্ররা নিজেরা কোনওভাবেই কোনও সহিংস হামলা বা লুটপাটে জড়িত নয়। কিন্তু অভুত্থানের মধ্যেই বহু নির্মম সহিংসতা আর সীমাহীন লুটপাট হয়েছে। ছাত্র-জনতার অনেকে জানবাজি রেখে এসব হামলা ও সহিংসতা রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টাও করেছে। কিন্তু আমরা সর্বত্র পারিনি। চুরমার হওয়া এসব ভাস্কর্য, প্রত্নবন্তু, ঐতিহাসিক নথি, দুষ্প্রাপ্য বই কিংবা শিল্পকর্ম আমাদের জাতীয় ইতিহাস এবং আত্মপরিচয় বিকাশের অংশ। আমরা যখন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়ছি, তখন আমাদের ইতিহাসের স্মারকে ‘চোরাগোপ্তা’ আরেক ফ্যাসিবাদী হামলাকে অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। কোনওভাবেই বাইনারি ন্যারেটিভ, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব বা বিপ্লব পরবর্তী সময়ে এমন অস্থিরতা হয়ে থাকে বলে সবকিছু দাবিয়ে রাখা যাবে না।

কেবল ভাস্কর্যই ভাঙচুর হয়নি, নানা স্থানে হামলা হয়েছে আর আক্রান্ত হয়েছে মন্দির ও মাজারও।

গণমাধ্যমসহ সবাই বলছে ‘দুর্বৃত্তরা’ এসব করছে। এই দুর্বৃত্ত কারা? এদেশে ভাস্কর্য গড়ার প্রকাশ্য বিরোধিতা যেমন আমরা দেখেছি তেমনি হুমকি দিয়ে প্রকাশ্যে ভাস্কর্য ভাঙ্গার খেলাও আমরা দেখেছি। কিন্তু ছাত্র-জনতা রাষ্ট্র-সংস্কারের যে স্বপ্ন আমাদের সামনে হাজির করছে, আশা করি সেখানে এসব ‘দুবৃর্ত্তপনার’ বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট সংস্কারের রূপরেখা তৈরি হবে। আমরা যেমন প্রতিটি গণহত্যা এবং নিপীড়নের ন্যায়বিচার চাই, একইসাথে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও লুন্ঠিত শিল্পকেন্দ্র ও শিল্পকর্মের সামগ্রিক সুরক্ষা চাই।

হুল আর তেভাগার ভাস্কর্য চুরমার
আমাদের ইতিহাসের নায়ক কে? ইতিহাস সর্বদা অধিপতিরা বয়ান করে বলে আমরা আমাদের কৃষক, জেলে, মজুর, আদিবাসী নায়কদের চিনি না। আমাদের জানতে দেওয়া হয় না। আমরাও আগ্রহী না নিম্নবর্গের বয়ান ও বিবরণ জানতে। সচরাচর অধিপতি ক্ষমতাবানদের স্মৃতিআলেখ্যই ধরে রাখে আমাদের বাহাদুরি উপস্থাপনব্যবস্থা। তাই আমরা কৃষক, মজুর, নারী, আদিবাসী, মেহনতি মানুষের অবদানের স্বীকৃতি ভাস্কর্য কিংবা অন্য মাধ্যমেও খুব একটা দেখি না।

ভেঙ্গে ফেলার আগে ও পরে সিধু-কানুর ভাস্কর্য । শিল্পী প্রদ্যোত কুমার ও মানবেন্দ্র ঘোষ কৃষক মজুর মেহনতি জনতার এই ভাস্কর্য নির্মাণ করেছিলেন।

দিনাজপুরের কাহারোলে তেভাগা চত্বরে নির্মিত হয় দেশের প্রথম সাঁওতাল বিদ্রোহ ও তেভাগা আন্দোলনের স্মৃতিতে স্মারক ভাস্কর্য। মুক্তিযুদ্ধে চাবাগানের আদিবাসী গণহত্যা স্মরণে নির্মিত কিছু স্থানীয় স্মৃতিস্মারক ছাড়া কাহারোলের এই ভাস্কর্যই দেশের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসকে প্রবলভাবে তুলে ধরেছে। আগষ্ট অভ্যুত্থানের পর গরিব কৃষক মজুরের এই ইতিহাস সাক্ষ্য কীভাবে নৈরাজ্যকারীর নিশানা হলো? তেভাগার এই স্মৃতিস্মারকে নির্মম হামলা হয়েছে। চুরমার করে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে হুলের নায়ক সিধু ও কানহু মুরমুর ভাস্কর্য। সাঁওতাল বিদ্রোহের পাশাপাশি একই উপস্থাপনায় তেভাগার বিপ্লবীদের উপস্থাপনও ছিল। ইলা মিত্র এবং হাজী মোহাম্মদ দানেশদের।

দিনাজপুরের কাহারোলে তেভাগা চত্বরে নির্মিত হয় দেশের প্রথম সাঁওতাল বিদ্রোহ ও তেভাগা আন্দোলনের স্মৃতিতে স্মারক ভাস্কর্য। মুক্তিযুদ্ধে চাবাগানের আদিবাসী গণহত্যা স্মরণে নির্মিত কিছু স্থানীয় স্মৃতিস্মারক ছাড়া কাহারোলের এই ভাস্কর্যই দেশের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসকে প্রবলভাবে তুলে ধরেছে। আগষ্ট অভ্যুত্থানের পর গরিব কৃষক মজুরের এই ইতিহাস সাক্ষ্য কীভাবে নৈরাজ্যকারীর নিশানা হলো? তেভাগার এই স্মৃতিস্মারকে নির্মম হামলা হয়েছে। চুরমার করে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে হুলের নায়ক সিধু ও কানহু মুরমুর ভাস্কর্য।

শিল্পী প্রদ্যোত কুমার ও মানবেন্দ্র ঘোষ কৃষক মজুর মেহনতি জনতার এই ভাস্কর্য নির্মাণ করেছিলেন। হুল বা সাঁওতাল বিদ্রোহ উপনিবেশ, ফ্যাসিবাদ এবং প্রবল কর্তৃত্ববাদী জুলুমের বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়াতে শিখিয়েছে। হুলের উত্তরাধিকার হিসেবে আজকের ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান কোনওভাবেই তা অস্বীকার করতে পারে না।

ফুলমুনি ও ঝানো মুরমু তাদের চার ভাই সিধু-কানহু-চাঁদ-ভায়রোদের নিয়ে কৃষক মজুর জনতাকে সংগঠিত করে ঐতিহাসিক হুল সংগঠিত করেন। বাংলাদেশের মতো এক জাত্যাভিমানী অধিপতি নয়াউদারবাদী রাষ্ট্রে কৃষক মজুরের সংগ্রামের দলিলায়ন কিংবা উপস্থাপন খুবই দুরূহ জটিল এক কাজ। একটিমাত্র স্মৃতিস্মারক ভাস্কর্য তাও খণ্ডবিখণ্ড করা হলো।

আগষ্ট গণঅভ্যুত্থানের পর বীরচন্দ্র পাঠাগার নৃশংসভাবে চুরমার করা হয়েছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বইয়ের আলমিরা ও তাক। লুট হয়েছে বহু দুষ্প্রাপ্য বই।

বীরচন্দ্র পাঠাগারের লুট হওয়া বই
বাংলাদেশে প্রাচীন পাঠাগার ও নথি সংগ্রহশালাগুলো খুব বেশি সচল নেই। ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈলের রাজা টংকনাথ কিংবা ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদার বাড়িতে দুষ্প্রাপ্র্য বইয়ের সংগ্রহশালা ছিল, যা রাষ্ট্রের নানা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ধ্বংস হয়ে যায়। ১৮৫৪ সালের দিকে যশোর, বগুড়া, রংপুর, বরিশালে কিছু গণগ্রন্থাগার তৈরি হয়। এর ভেতর ‘যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি’ সক্রিয় আছে। বগুড়ার ‘উডবার্ণ লাইব্রেরি’ এক বিরল কাঠের স্থাপনা। এখানে পনের শতকের দুর্লভ পুঁথি আছে। উনিশ শতকের শেষভাগে রামমোহন রায়ের নামে ঢাকায় শুরু হয় প্রথম পাবলিক গ্রন্থাগার। ১৯৪৬ সালে নওগাঁর পোরশাতে স্থাপিত হয় ‘আল জামিয়া আল আরাবিয়া দারুল হিদায়া মাদ্রাসা’, এখানেও প্রাচীন পুস্তকের দুর্লভ সংগ্রহ আছে। ১৯১২ সালে সমাজসেবী মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য ইশ্বর পাঠশালা টোলের গ্রন্থাগারকে সংস্কার করে কুমিল্লা ‘রামমালা গ্রন্থাগারটি’ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। এই পাঠাগারে প্রায় ৯ হাজার দুর্লভ পুঁথি ও পাণ্ডুলিপি আছে।

কুমিল্লার আরেক প্রাচীন পাঠাগার হলো বীরচন্দ্র গ্রন্থাগার। ১৮৫৫ সালে ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের দান করা জমিতে এটি গড়ে তোলা হয়। ২০০ বছরের প্রাচীন দুষ্প্রাপ্য বইসহ প্রায় ২৫ হাজার বইয়ের এক সংগ্রহ ছিল এই পাঠাগারে। শাহনামা কিংবা রাজমালার প্রথম সংস্করণের কপিও ছিল এখানে। আগষ্ট গণঅভ্যুত্থানের পর বীরচন্দ্র পাঠাগার নৃশংসভাবে চুরমার করা হয়েছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বইয়ের আলমিরা ও তাক। লুট হয়েছে বহু দুষ্প্রাপ্য বই।

কুমিল্লার আরেক প্রাচীন পাঠাগার হলো বীরচন্দ্র গ্রন্থাগার। ১৮৫৫ সালে ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের দান করা জমিতে এটি গড়ে তোলা হয়। ২০০ বছরের প্রাচীন দুষ্প্রাপ্য বইসহ প্রায় ২৫ হাজার বইয়ের এক সংগ্রহ ছিল এই পাঠাগারে। শাহনামা কিংবা রাজমালার প্রথম সংস্করণের কপিও ছিল এখানে। আগষ্ট গণঅভ্যুত্থানের পর বীরচন্দ্র পাঠাগার নৃশংসভাবে চুরমার করা হয়েছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বইয়ের আলমিরা ও তাক। লুট হয়েছে বহু দুষ্প্রাপ্য বই।

ভেঙ্গে ফেলার আগে শশীলজের ভেনাস (বামে)। ভাঙ্গার পর ভেনাসের মাথাটি নিখোঁজ হয়ে যায়।

শশীলজের ভেনাসের নিখোঁজ মাথা
ব্রিটিশ উপনিবেশ সময়ের উন্মুক্ত ভাস্কর্য দেশে খুব বেশি নেই। এর ভেতর সর্বাধিক পরিচিত ময়মনসিংহের শশীলজের ভেনাস। মহারাজা শশীকান্ত আচার্যের এই বাড়ি ১৯৫২ সাল থেকে মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। ২০১৫ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর একে জাদুঘর হিসেবে অধিগ্রহণ করে। যদিও এই জাদুঘরে নিতান্ত অবহেলা ও দায়সারাভাবে প্রত্নবস্তু রাখা হয়েছে এবং বিশৃংখলভাবে ইতিহাস উপস্থাপন করা হয়েছে। অনলাইন মুক্তবিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া লিখেছে, ‘‘…২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর জনগণের বিজয় উল্লাসের সময় দুর্বৃত্তরা ভেনাস ভেঙে ফেলে’’। ভেনাস ধ্বংসের যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে, তা আমাদের কী বার্তা দেয়? জনসম্পদ ও সৃষ্টিশীল শিল্পকর্মের ওপর এই ধরনের ফ্যাসিবাদী হামলার প্রবণতা প্রশ্নহীন কর্তৃত্ববাদ ও দুর্ধর্ষ দ্বেষকে প্রতিষ্ঠিত করে।

ময়মনসিংহে জয়নুল সংগ্রহশালার সামনে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের আবক্ষ ভাস্কর্যটির নাক ভেঙ্গে ফেলার পর সেটি রেস্টোরেশনের কাজ করছেন শিল্পীরা।


শিল্পাচার্যের নাক-ভাঙা
দেশে শিল্পাচার্য একজনই, জয়নুল আবেদীন। জয়নুল-কামরুল-সুলতান এই ত্রয়ী শিল্পী আমাদের কাঠামোগত সৃষ্টিশীলতার কেন্দ্রবিন্দু। ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্রের তীরে জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালা। ১৩৮২ বাংলার পয়লা বৈশাখ সংগ্রহশালাটি উদ্বোধন করা হয়, তখন বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে পয়লা বৈশাখ হিসাব হতো। সংগ্রহশালাতে জয়নুলের শিল্পকর্ম অনাদরে কোনও উপযুক্ত পরিকল্পনা ছাড়াই প্রদর্শিত হয়। ১৯৯২ সালের ২ মে এখান থেকে ১৭টি শিল্পকর্ম ডাকাতি হয়। ২০১৫ সালে সংগ্রহশালার সামনে জয়নুলের একটি আবক্ষ ভাস্কর্য বানানো হয়। আগস্ট গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী আনন্দ মিছিল শুরু হলে কিছু লোক এসে এই ভাস্কর্যটি ভাংতে শুরু করে। ছাত্ররা এসে জয়নুলকে বাঁচায়, কিন্তু জয়নুলের নাক ভেঙে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। জয়নুলের কী দোষ, কেন তার নাক ভাঙা হলো? দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকে তিনি তৎকালীন বাংলার কাঠামোগত বৈষম্যের প্রমাণ হাজির করেছেন বলে নাকি পাকিস্থানের দেওয়া হিলাল-ই-ইমতিয়াজ উপাধি বর্জন করেছেন বলে? মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে মজলুম জননেতা ভাসানীর ডাকে আয়োজিত ময়মনসিংহের জনসভায় শিল্পী এই উপাধি বর্জন করেন।

রোকেয়াকে অস্বীকৃতি
বেগম রোকেয়াকে নারী ও শিক্ষা জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে উচ্চারণ করে অধিপতি ব্যবস্থা। তবে রাষ্ট্রের কাঠামোগত মনোজগতে রোকেয়া সর্বতোভাবে স্বীকৃত নন। বিচ্ছিন্নভাবে রোকেয়ার নামে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সরণী, স্মৃতিকেন্দ্র, পদক কিংবা কিছু ভাস্কর্য হয়েছে। রংপুর সংগ্রামী চেতনার ভূমি, বঞ্চনাকে প্রশ্ন করবার ইতিহাস এই মাটির পরতে পরতে। তেভাগা থেকে নূরুল দীন, মুক্তিযুদ্ধে তীর-ধনুক নিয়ে সেনাক্যাম্প দখলকারী আদিবাসী বাহিনী থেকে ২০২৪ এর রক্তাক্ত জুলাইয়ের শহীদ আবু সাঈদ। ইতিহাস থেকে ইতিহাসে এই বাস্তুতন্ত্র কর্তৃত্ববাদ বিরোধী। কিন্তু আগষ্ট অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বিদ্রোহী রংপুরে নিদারুণভাবে রোকেয়ার ভাস্কর্য এবং ম্যুরালেও হামলা হয়েছে। নিজ ভূমিতেই রোকেয়ার ভাস্কর্য অরক্ষিত। ২০২৩ সালে ভাস্কর অনীক রেজার বাসাতেও দুর্বৃত্তরা হামলা করে রোকেয়ার ভাস্কর্য ভেঙে ফেলে। রংপুর শহরে ২০১৭ সালে স্থাপিত রোকেয়া-ভাস্কর্য ‘আলোকবর্তিকার’ ভাস্কর তিনি। রোকেয়া আমাদের বঞ্চনা, বৈষম্য এবং কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে সাহসী প্রশ্ন করতে শেখান। রোকেয়ার ভূমিতে ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে সাঈদ বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শহীদের রক্তপিছল ময়দানকে আড়াল করে আজ দুর্বৃত্তরা যখন রোকেয়াকে হামলা করে তখন বহু প্রশ্নহীন সমীকরণ, গুঞ্জন, গুজব কিংবা রহস্য বিমূর্ত হয়ে ওঠে আমাদের চারধারে।

এখন আমাদের কাজ কী?
এইরকম একটি পরিস্থিতিতে আমরা নিশ্চয়ই ভাস্কর্যের ভাঙা টুকরা কিংবা লুট হওয়া বইয়ের স্মৃতি নিয়ে বসে থাকতে পারি না। সংগ্রামী ছাত্র-জনতা বসে থাকেনি, থাকছে না। ময়মনসিংহ বিভাগীয় চারুশিল্প পর্ষদ দ্রুত জয়নুলের ভাস্কর্যটি রেস্টোরেশনের দায়িত্ব নেয়। চারুশিল্পী হোসাইন ফারুক ও মো. রাজন মূল শিল্পী হিসেবে এটি রেস্টোরেশন করেন। ভেনাসের ভাস্কর্যটি পুনঃস্থাপনের জন্য শিল্পীরা তৎপর হচ্ছেন, কিন্তু ভেনাসের মাথা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দেশে যারা মার্বেল পাথরের কাজ জানেন আশা করি তারা এক্ষেত্রে এগিয়ে আসবেন। বীরচন্দ্র পাঠাগারের লুট হওয়া বই খুঁজতে অনেকে সক্রিয় আছেন।

এখন আমাদের প্রথম কাজ হবে দেশব্যাপী ক্ষতিগ্রস্থ সকল স্থাপনা ও শিল্পকর্মের তালিকা ও পূর্ণাঙ্গ বিবরণ তৈরি করা। প্রতিটি ভাস্কর্য ও শিল্পকর্ম পুনঃস্থাপন এবং অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্থ স্থাপনার মেরামত এবং রেস্টোরশেনের জন্য অভিজ্ঞ ও দক্ষ মানুষদের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করা জরুরি। যাতে একসাথে কাজ করা যায় এবং পরস্পর সহযোগিতা অব্যাহত থাকে। জনসম্পদ রেস্টোরেশন এবং পুনঃস্থাপনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা করবে এবং অন্যক্ষেত্রে গণচাঁদা সংগ্রহের মাধ্যমে করা যেতে পারে।

এখন আমাদের প্রথম কাজ হবে দেশব্যাপী ক্ষতিগ্রস্থ সকল স্থাপনা ও শিল্পকর্মের তালিকা ও পূর্ণাঙ্গ বিবরণ তৈরি করা। প্রতিটি ভাস্কর্য ও শিল্পকর্ম পুনঃস্থাপন এবং অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্থ স্থাপনার মেরামত এবং রেস্টোরশেনের জন্য অভিজ্ঞ ও দক্ষ মানুষদের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করা জরুরি। যাতে একসাথে কাজ করা যায় এবং পরস্পর সহযোগিতা অব্যাহত থাকে। জনসম্পদ রেস্টোরেশন এবং পুনঃস্থাপনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা করবে এবং অন্যক্ষেত্রে গণচাঁদা সংগ্রহের মাধ্যমে করা যেতে পারে।

এই সময়ে লুট হওয়া শিল্পকর্ম, নথি, বইপুস্তক খুঁজে বের করতে সরকারকে গণপ্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। আমরা আশা করব সরকার ক্ষতিগ্রস্ত জনসম্পদ ও শিল্পকর্মের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনা এবং ভাস্কর্য পুনঃস্থাপনে অংশীজনদের নিয়ে দ্রুত সক্রিয় হবে।

৫ আগস্ট ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের দিনই ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে ব্যাপক লুটপাট হয় এবং বাড়িটি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

আগষ্ট অভ্যুত্থানের পর কেবল সারা দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যই ভাঙ্গা হয়নি, মেহেরপুরের মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ কিংবা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর’ আজ শূন্য। আশা করি অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোকে সকল রকমের দলীয় রাজনীতিকরণের বাইরে এনে জনগণের কাছ থেকে ছিনতাই হওয়া জনইতিহাসকে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিবে। শিল্পকলা একাডেমী, থিয়েটার, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর চর্চাকেন্দ্র, মন্দির, মাজার কিংবা ব্যক্তিগত সংগ্রহশালাগুলোর নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় সরকারের নিরাপত্তা বিভাগসহ ছাত্র-জনতাকে যুক্ত করে রাষ্ট্রকে জনগণের অংশীদারিত্বে নতুন নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলতে হবে।

আগষ্ট অভ্যুত্থানের পর কেবল সারা দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যই ভাঙ্গা হয়নি, মেহেরপুরের মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ কিংবা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর’ আজ শূন্য। আশা করি অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোকে সকল রকমের দলীয় রাজনীতিকরণের বাইরে এনে জনগণের কাছ থেকে ছিনতাই হওয়া জনইতিহাসকে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিবে।

জামদানি বা টাঙ্গাইল শাড়ি কিংবা সুন্দরবনের মধুর ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) তর্ক আমরা ভারতের বিরুদ্ধে তুলেছি। কিন্তু এসব জিআই পণ্য কারিগরদের জানমাল ও সম্পদের সুরক্ষা কে নিশ্চিত করবে? আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর নেত্রকোণার ঐতিহ্যবাহী জিআই পণ্য বালিশ মিষ্টির কারিগর গয়ানাথের দোকান দিনেদুপুরে লুটপাট হয়েছে। জিআই কারিগরদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে কী কোনওভাবেই দেশের সাংস্কৃতিক সম্পদগুলো বিকশিত হতে পারবে? রাষ্ট্রসংস্কারের প্রশ্নে নিম্নবর্গের এসব মৌলিক বয়ানকে বিবেচনায় আনতে হবে। 

রাজধানীর বিজয় সরণীর মোড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া হয়।

চারধারে রক্তদাগের ভেতর এমন অস্থির সময়ে মিশরের ‘বিবলিওথেকা আলেকজান্দ্রিনার’ কথা মনে পড়ল। বিশ্বের প্রাচীন সেই আলেকজান্দ্রিয়া পাঠাগারও জ্বলিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে আবার আলেকজান্দ্রিয়া পাঠাগার পুনর্গঠনের চিন্তা শুরু হয়। এগিয়ে আসে ইউনেস্কো। পুড়িয়ে দেওয়া আলেকজান্দ্রিয়া পাঠাগারের স্মরণে পুর্নগঠিত ‘বিবলিওথেকা আলেকজান্দ্রিনাতেও’ দেখেছি বহু প্রাচীন নথি, হাতে তৈরি পুস্তক আর বই প্রাচীন বই সবার ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। প্রতিদিন বহু পাঠক, গবেষক, বিদ্যার্থী এই পাঠাগারে আসেন গবেষণা, দর্শন ও বিদ্যার্জনের জন্য। বিশ্বাস রাখি আমরাও পারব।

ছাত্র-জনতা আমাদের ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহসী করেছে, আমরা কোনওভাবেই চাই না কোনও দুর্বৃত্তের ফ্যাসিবাদী হামলায় আমাদের ইতিহাস ও শিল্পঐতিহ্য কোনওভাবে আবারও আক্রান্ত হোক।

লেখক: গবেষক ও লেখক।
ইমেইল: [email protected]

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত