বিচারর বিভাগের পৃথকীকরণ কার্যকর করতে আইন মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব বন্ধের ওপর জোর দিলেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। তিনি মনে করেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে সুপ্রিম কোর্টের জন্য আলাদা সচিবালয় প্রয়োজন।
শনিবার সারাদেশের বিচারকদের উদ্দেশে দেওয়া অভিভাষণে এসব কথা বলেছেন তিনি।
বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিতে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন জরুরি মন্তব্য করে প্রধান বিচারপতি বলেন, “বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের বিচারকরা বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন বলে উল্লেখ রয়েছে।
“কিন্তু বিচারকদের প্রকৃত স্বাধীনতা ততদিন পর্যন্ত নিশ্চিত হবে না; যতদিন না বিচার বিভাগে দীর্ঘ দিন ধরে বিরাজমান দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা, অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অধীনে আলাদা সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটি হবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রথম ধাপ।”
নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এবং জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের মতো বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, শিগগিরৈই এটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টা ও আইন উপদেষ্টার দৃষ্টিও আকর্ষণ করেন তিনি।
নিরপেক্ষভাবে, স্বল্প সময় ও খরচে বিরোধের মীমাংসা নিশ্চিত করে জনগণ, সমাজ ও রাষ্ট্রকে সুরক্ষা দেওয়াই একটি ন্যায়ভিত্তিক বিচারব্যবস্থার কাজ বলে মনে করেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, এ জন্য বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা থেকে আলাদা ও স্বাধীন করা সবচেয়ে জরুরি। কেননা শাসকের আইন নয়, বরং আইনের শাসন নিশ্চিত করাই বিচার বিভাগের মূল দায়িত্ব।
বিগত বছরগুলোয় বিচার বিভাগের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, “শঠতা, বঞ্চনা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাতিয়ার হিসাবে বিচার বিভাগকে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছে। এতে বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।
“তাই নতুন এই বাংলাদেশে আমরা এমন একটি বিচার বিভাগ গড়তে চাই যেটি বিচার এবং সততা ও অধিকারবোধ এর নিশ্চয়তার একটি নিরাপদ দূর্গে পরিণত হবে।”
কেন বিচার বিভাগের ছন্দপতন হয়েছিল, এর পেছনে কোন বিষয়ের দায় ছিল সেসব চিহ্নিত করে জনমুখী আইন ব্যবস্থা ও বিচার কাঠামো বির্নিমাণে করণীয় সম্পর্কে একটি স্পষ্ট রোডম্যাপ তৈরির বিষয়ে মত দেন তিনি।
বিচার বিভাগের বিদ্যমান সমস্যার মূল কারণ হিসেবে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের আলাদা না হওয়ার কথাই বার বার উল্লেখ করলেন প্রধান বিচারপতি।
তিনি বলেন, “এর কুফল আমরা সবাই ভোগ করেছিলাম গত দেড় দশক ধরে। এছাড়াও আছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, মামলা অনুপাতে বিচারকের নিদারুণ স্বল্পতা, বার ও বেঞ্চের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাবের ঘাটতি, আদালতগুলোর অবকাঠামোগত সংকট, অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোন যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য নীতিমালা না থাকা, উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ, স্থায়ীকরণ ও উন্নীতকরণের ক্ষেত্রে কোন আইন না থাকা ও প্রথাগত জ্যেষ্ঠতার নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন ইত্যাদি বিষয়গুলো; যা আমাদের বার বার পিছিয়ে দিয়েছে।”
বিচার বিভাগ যেন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে তার জন্য জরুরি ভিত্তিতে বিচার বিভাগে কিছু সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
বলেন, “এই সংস্কারের উদ্দেশ্য হবে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে তা দ্রুত দূর করে একটি স্বাধীন, শক্তিশালী, আধুনিক, দক্ষ ও প্রগতিশীল বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা।”
এসময় বিচার বিভাগে যেকোনো প্রকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি।
অভিভাষণে বিচার বিভাগের জন্য একটি রোডম্যাপও তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের বিচারপতি, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান আপিল বিভাগের প্রাক্তন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম রব্বানী, সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার কর্মকর্তা ও সারাদেশ থেকে আসা দুই হাজার বিচারক উপস্থিত ছিলেন।
খবর বাসস।