Beta
মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

জরায়ুমুখ ক্যান্সার : লক্ষ্যমাত্রা ৯০-৭০-৯০ কত দূর

hpv-vaccination-030224-02
Picture of জাকিয়া আহমেদ

জাকিয়া আহমেদ

ঢাকার মহাখালীর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে দেখা মিলল নরসিংদীর বেলাব থেকে আসা হালিমা খাতুনের সঙ্গে। সঙ্গে ছেলে আফসার, হাতে রাজ্যের ফাইলপত্র, মুখে উদ্বেগ। সেই ফাইলে দেখা যায়, হালিমা খাতুনের বয়স লেখা ৩২ বছর, যদিও শরীরে-পোশাকে দরিদ্রতার চিহ্ন তাকে আরও বয়সী করে তুলেছে।

আফসার জানান, তার মায়ের জরায়ুমুখ ক্যান্সার, চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকদিন ধরে। নরসিংদীর চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এখন রেডিওথেরাপি দরকার। সেজন্যই তিনি এখানে নিয়ে এসেছেন মাকে।

কতদিন থেকে এই রোগ- জানতে চাইলে হালিমা খাতুন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সময়-তারিখ মনে নাই। শইলডা খারাপ যাইতেছিল, ডাক্তারের কাছে গেলাম। কী কী জানি কইলো, ওষুধ বড়ি দিলো। তারপর এইখানে আইলাম।”

কত বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল, সেটা মনে নেই এই নারীর, তবে বিয়ের পরপরই মা হয়ে ওঠেন। এরপর থেকেই রোগের লক্ষণ দেখা দিলে স্বামীকে একবার বলেছিলেন, কিন্তু তিনি গা করেননি। লজ্জায় অন্য কাউকেও বলতে পারেননি। ফলে দেহে রোগ বাসা বানিয়ে থেকে যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য রোগ। কেবলমাত্র ভায়া (ভিজ্যুয়াল ইন্সপেকশন অব দ্য সারভিক্স উইথ অ্যাসিটিক অ্যাসিড) পরীক্ষার মাধ্যমে ঝুঁকি রয়েছে কি না, তা আগেভাগেই বোঝা সম্ভব। অথচ এই লজ্জা আর নারীর অসুখকে পরিবারের কিছু না মনে করা এবং নারীর নিজের সিদ্ধান্ত না নিতে পারার কারণেই এখন দেশের নারীদের ভুগতে হচ্ছে।

নারীরা বিশ্বজুড়ে যেসব ক্যান্সারে বেশি আক্রান্ত হন, তাদের মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের অবস্থান চতুর্থ। আর বাংলাদেশে দ্বিতীয়। এই রোগের মূলে রয়েছে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি)।

শনিবার ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের নিচতলায় বাম দিকে জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধের প্রথম ধাপ স্ক্রিনিংয়ের নির্দিষ্ট কক্ষগুলোতে ভিড় দেখা গেলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এখনও এ রোগ নিয়ে সচেতনতা নেই। শেষ দিকেই কেবল রোগীরা আসেন। জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে যে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে, তা শহুরে মানুষ যতটুকু জানে, গ্রামের মানুষ তেমন জানেই না।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল।

চিকিৎসকরা বলছেন, কম বয়সে বিয়ে, একাধিক এবং ঘনঘন সন্তান গ্রহণ, পুষ্টিহীন শরীর, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা না থাকা, একাধিক যৌনসঙ্গী নেওয়া জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার মূল কারণ। আর এর লক্ষণ হচ্ছে তলপেটে ব্যথা, অতিরিক্ত ও অনিয়মিত রক্তস্রাব এবং ঘন সাদা স্রাব।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ক্যান্সার গবেষণাবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইএআরসির ২০২০ সালের গ্লোবোক্যান প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্বে জরায়ুমুখের ক্যান্সারে আক্রান্তের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। দেশে প্রতিবছরে নতুন করে এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হন ৮ হাজার ২৬৮ জন নারী, মৃত্যু হয় ৪ হাজার ৯৭১ জনের।

এরপরও যে এনিয়ে সচেতনতা তেমন নেই, তা ফুটে ওঠে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান (নিপসম) ২০২০ সালে ‘ন্যাশনাল স্টেপস সার্ভে ফর নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ রিস্ক ফ্যাক্টরস ইন বাংলাদেশ ২০১৮’ শিরোনামের প্রতিবেদনে।

তাতে দেখা যায়, জরায়ুমুখের ক্যানসার আক্রান্ত কি না, তা জানতে জীবনে একবার পরীক্ষা করিয়েছেন ১৮ থেকে ৬৯ বছর বয়সী ৪ শতাংশের কিছু বেশি নারী।

ক্যান্সার হাসপাতালের গাইনি অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাহানা পারভীন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আগের চাইতে দেশে সচেতনতা বেড়েছে, তবে তা মহাসমুদ্রে এক বিন্দু শিশিরকণার মতো।

“এতে কিচ্ছু হবে না। আরও ম্যাসিভ সচেতনতা দরকার। শহুরে শিক্ষিত, ধনী শ্রেণির নারী পুরুষের মধ্যেই সচেতনতা নেই, গ্রামের অশিক্ষিত-দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের মধ্যে আমরা সেটা আশাই করি কী করে?”

তিনি বলেন, কেউ জরায়ুমুখ ক্যান্সারের ঝুঁকিতে রয়েছেন কি না, তা পরীক্ষা করে ক্যান্সার হওয়ার আগেই এর চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব। এজন্য স্ক্রিনিং সবচেয়ে জরুরি।

“২০০৫ সাল থেকে ভিআইএ অর্থাৎ ভায়া চালু রয়েছে। কিন্তু সেটা ঠিকমতো হচ্ছে না। বেশিরভাগ উপজেলায় এই ভায়া কার্যক্রম চালু থাকলেও শনাক্তকরণের কভারেজ হযেছে মাত্র ১৭ শতাংশ।”

জাতীয় জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, দেশে এখন পর্যন্ত ১৫ থেকে ৬০ বছর বয়সী মাত্র ২০ শতাংশ নারীকে ভায়া পরীক্ষার আওতায় আনা গেছে। এই কেন্দ্রের অধীন রয়েছে ‘ইলেকট্রনিক ডেটা ট্র্যাকিং উইথ পপুলেশন বেইজড সারভাইক্যাল অ্যান্ড ব্রেস্ট ক্যানসার স্ক্রিনিং কর্মসূচি’ প্রকল্প।

যারা পরীক্ষা করাতে আগ্রহী হচ্ছেন, কেবল তাদেরই কেবল পরীক্ষাটি হচ্ছে জানিয়ে ডা. সাহানা বলেন, “এটা হওয়া উচিৎ কমিউনিটিভিত্তিক। কিন্তু এখনও আমাদের দেশে কমিউনিটি বেইজড স্ক্রিনিং চালু হয়নি।”

জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে কিশোরীদের বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে টিকা।

টিকাদানের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৯০-৭০-৯০ অনুপাত হতে হবে। অর্থাৎ ৯০ শতাংশ নারীকে টিকা দিতে হবে, ৭০ শতাংশ নারীকে ৩৫ বছরে এবং ৪৫ বছরে দুইবার স্ক্রিনিং করাতে হবে এবং ৯০ শতাংশ নারীকে চিকিৎসা (অবস্থা বুঝে চিকিৎসা যেমন কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, পেলিয়েটিভ কেয়ার) দিতে হবে।

“আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। সারা দুনিয়াতে এ লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ হচ্ছে।”

কোভিড মহামারি মোকাবেলায় যেভাবে সবাইকে নিয়ে এলাকাভিত্তিক কাজ হয়েছে, এক্ষেত্রেও তেমন পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন অধ্যাপক সাহানা।

গ্রামের প্রতিটি ঘরে অন্তত একটি করে টিভি রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সেখানে প্রচারণার ব্যবস্থা করতে হবে। পোলিও যদি নির্মূল করা যায়, তাহলে প্রতিরোধযোগ্য এই ক্যান্সার কেন করা যাবে না?

“ক্যান্সার দিবস এলেই এ নিয়ে র‌্যালি, সভা, সেমিনার না করে বছরজুড়ে কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার। সেই কর্মসূচি লোক দেখানো নয়, কার্যকর কর্মসূচি যেন হয়।”

দেশজুড়ে ক্যান্সার বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে সারাদেশ ঘুরছেন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক, বর্তমানে গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক ক্যান্সার হাসপাতালের প্রকল্প সমন্বয়কারী অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখনও নারী নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারেন না, পুরুষের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। তাই বাড়ির পুরুষ সদস্যকে নারী সদস্যের দিকে নজর দিতে হবে, দায়িত্ব নিতে হবে। নয়ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্যমাত্রা আমরা অর্জন করতে পারব না।”

ফাইল ছবি

জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে দেশে কিশোরীদের এইচপিভি টিকা দেওয়া শুরু হয় গত বছরের ৪ অক্টোবর। বিনা মূল্যে দেওয়া এই টিকার আওতায় ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী এক কোটির বেশি কিশোরীকে আনার লক্ষ্য সরকারের।

কিন্তু এনিয়ে তেমন প্রচারণা নেই, যেমন রয়েছে সরকারের ইপিআই বা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে।

‘ইলেকট্রনিক ডেটা ট্র্যাকিং উইথ পপুলেশন বেইজড সারভাইক্যাল অ্যান্ড ব্রেস্ট ক্যানসার স্ক্রিনিং কর্মসূচি’র প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. আশরাফুন্নেসা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, কিশোরীদের টিকা দেওয়া সম্ভব হলে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে এই ক্যান্সার প্রতিরোধ হতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির পরিচালক ডা. মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন সকাল সন্ধ্যাকে জানান, সরকার সারাদেশে এক কোটি কিশোরীকে এই টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা নিলেও এখন মূলত ঢাকায় দেওয়া হচ্ছে। পরবর্তীকালে টিকা পাওয়া সাপেক্ষে অন্যান্য বিভাগে দেওয়া হবে।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, ঢাকা বিভাগে চার মাসে ১৫ থেকে ১৬ লাখ কিশোরীকে টিকা দেওয়া হয়েছে। এর বেশিরভাগই ঢাকা জেলার।

টিকা নিয়ে সচেতনতায় তৈরিতে এখনও পুরোপুরি সফল হননি স্বীকার করে ডা. নিজাম বলেন, কিছু কিছু মাদ্রাসায় সচেতনতা ছিল না। আমরা সেজন্য কাজ করছি।”

এই পুরো কাজে সরকারের সমন্বয়হীনতার অভিযোগ তুললেন অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ তালুকদার।

“দেশে জাতীয় প্রোগ্রাম নেই, সমন্বয় নেই, সরকারি মানুষরা বেসরকারিদের ডাকেন না। অথচ বেসরকারিভাবে কত মানুষ, কত সংগঠন সচেতনতা নিয়ে কাজ করছেন।”

তিনি বলেন, “কেবল তো স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম (শনাক্তকরণ কর্মসূচি), টিকাদান কর্মসুচি হাতে নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। সেখানে আসার জন্য তো মানুষকে বলতে হবে, তাদের মোটিভেট করতে হবে। কিন্তু এসব কিছু কি হয়েছে?”

বাংলাদেশ জাতীয় ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক মহিউদ্দিন ফারুকও সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে সরকারের উদ্যোগ ভালো। কিন্তু সে নিয়ে প্রচারণা নেই। তাহলে মানুষ জানবে কীভাবে? মানুষ যদি না জানে, তাহলে মানুষ কোথায় আসবে? কেন আসবে?”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত