গ্রামীণ ব্যাংক ও এর পরিচালিত সাতটি প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক টাকা পাচার হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছেন ব্যাংকটির পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম সাইফুল মজিদ। তিনি দাবি করেন, আইন মেনেই গ্রামীণের সাতটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কোনও মালিকানা নেই।
শনিবার বিকালে রাজধানীর মিরপুরে গ্রামীণ ব্যাংক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমন দাবি করেন।
গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, ‘‘আমি সচেতনভাবে বলেছি আমরা আলামত পেয়েছি। পূর্ণ আলামত আমরা সংগ্রহ করেছি। আমাদের অনেক টাকা সরে গেছে।
‘‘সেটা আমরা অনুসন্ধান করেছি। আমদের অডিট চলছে। পূর্ণ তথ্য না পাওয়ার আগে কাউকে দোষারোপ করতে চাচ্ছি না। আমরা আরও প্রমাণসাপেক্ষে ফরেনসিক অডিট করার চেষ্টা করছি।’’
গ্রামীণ ব্যাংকের আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মাসুদ আকতার বলেন, ‘‘অডিটের মাধ্যমে অনেক তথ্য আমরা পেয়েছি। যেখানে মানি লন্ডারিংয়ের উপাদান পেয়েছি। দালিলিক প্রমাণ আছে।’’
অন্যদিকে নিজের প্রতিষ্ঠিত আটটি প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক দখল করে নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, তাদের আটটি প্রতিষ্ঠান জবরদখল করেছে গ্রামীণ ব্যাংক। দখল করে নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান তারা তাদের মতো করে চালাচ্ছে। এ বিষয়ে পুলিশের কাছে প্রতিকার চাইলেও কোনও সহযোগিতা পাননি।
‘জবরদখল’ হওয়া আট প্রতিষ্ঠানের একটি গ্রামীণ টেলিকম যার চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত বৃহস্পতিবার সকালে টেলিকম ভবনের নিচতলায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করেন তিনি।
এ সময় তিনি বলেন, “আমরা জীবনে বহু দুর্যোগ দেখেছি। এমন দুর্যোগ আর কখনও দেখিনি।” গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল ইসলাম, গ্রামীণ কল্যাণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম মঈনুদ্দিন চৌধুরী এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক না দাবি করে শনিবার সংবাদ সম্মেলনে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুল মজিদ বলেন, “আমরাও মালিক না। আমরা শুধু নেমেছি গ্রামীণের যে আইনগত অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে সেটাকে ফিরিয়ে আনার জন্য।
“বেআইনি কিছু করতে চাই না। আইনিভাবে চলব। ওখানে যারা আসছিলেন তারা কিন্তু গ্রামীণের সাথে সম্পর্কিত না। আমরা গ্রামীণের যারা মালিক, তাদের তরফ থেকে কথা বলছি।’’
গ্রামীণ টেলিকম পরিচালনা পরিষদের ৩৭তম সভায় তৈরি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘গ্রামীণফোনের অনুমোদন দিয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ। উনিও সংবাদ সম্মেলন করছে। আমরাও করছি আমাদের বক্তব্য দেওয়ার জন্য।
“ওনাদের কারও কোনও মালিকানা কোনও প্রতিষ্ঠানে নেই। ওনাদের কোনও শেয়ারও নেই। তারা পূর্ণকালীন কর্মকর্তা।’’
আপনারা মালিক কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমরা বলছি না, আমারা মালিক। গ্রামীণ একটা অঙ্গসংগঠন গ্রামীণ ব্যাংকের। নতুন মনোনয়ন গেলে আগে যিনি ছিলেন তার চেয়ারম্যানশিপ শেষ হয়ে গেছে। বাতিল বলব না।’’
নোবেল পুরস্কার দুই ভাগে দেওয়া হয়েছিল
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দুই ভাগে দেওয়া হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান। সাইফুল মজিদ বলেন, ‘‘৫০ শতাংশ ড. ইউনূসের জন্য। আর ৫০ শতাংশ গ্রামীণ ব্যাংকের জন্য। আমি বলব যৌথভাবে গ্রামীণ ব্যাংক এবং অধ্যাপক ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরস্কারটি পেয়েছিল।’’
গ্রামীণ টেলিকম ভবনে তালা দিয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তারা
জবরদস্তি করে দখল নয়, দাপ্তরিক কাজপত্র সুরক্ষা ও ভবনের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে আলাপ করেই গ্রামীণ টেলিকম ভবনে তালা দিয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তারা, এ কথা সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
সাইফুল মজিদ বলেন, ‘‘অত্যন্ত দুঃখের সাথে আমরা লক্ষ্য করেছি, যাদের হাতে এ আইন সৃষ্টি তারা সবকিছু জেনেও একটি সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়াকে ‘জবর দখল’ এর মতো শব্দ ব্যবহার করে নোবেল বিজয়ী এ প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে চাইছে। তারা বিষয়টি আদালত পর্যন্ত নেওয়ারও হুমকি দিয়েছে।’’
গ্রামীণ পরিবারের মধ্যে সৌহার্দ্য বজায় রেখে আন্তরিকভাবে বিষয়গুলো সমাধান করাই গ্রামীণ ব্যাংকের লক্ষ্য ছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘‘কারণ আমরা এটা বিশ্বাস করতে চাই যে, আজকে যারা গ্রামীণ ব্যাংক সৃষ্ট ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যুক্ত তারাও গ্রামীণ দরিদ্র ভূমিহীন সদস্যদের তাদের প্রাপ্য ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে আমাদের মতোই আন্তরিক। যাতে আমরা গ্রামীণ ব্যাংকের ১ কোটি ৫ লাখ দরিদ্র ভূমিহীন ঋণগ্রহীতা সদস্যদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারি।’’
গ্রামীণ টেলিকম ভবনে থাকা গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ ফান্ড, গ্রামীণ মৎস ফাউন্ডেশান, গ্রামীণ উদ্যোগ, গ্রামীণ সামগ্রী ও গ্রামীণ শক্তি নামের মোট ৭টি প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সভার অনুমোদনে এবং গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় সৃষ্টি হয়েছে বলে উল্লেখ করেন সাইফুল মজিদ।
আইন মেনেই গ্রামীণের সাতটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘‘ওই ৭টি প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃক সৃষ্টি হয়েছে, এবং আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান ও নির্দিষ্ট সংখ্যক পরিচালক মনোনয়নে গ্রামীণ ব্যাংক আইনগত অধিকার রাখে।’’
সংবাদ সম্মেলনে গ্রামীণ ব্যাংকের আইন বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মাসুদ আক্তার বলেন, ভবনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই প্রতিষ্ঠানগুলোতে তালা দেওয়া হয়েছে।
শ্রম আইনের একটি মামলায় ইউনূসের সাজা এবং আরেক মামলায় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযোগপত্র অনুমোদন নিয়ে দেশে-বিদেশে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা ও বিচার
১৯৮৩ সালে সরকারি অধ্যাদেশে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে ড. ইউনূসকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অপসারণ করে ২০১১ সালের মার্চ মাসে।
২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা করেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগের শ্রম পরিদর্শক (সাধারণ) এসএম আরিফুজ্জামান। মামলার নথি অনুসারে, আইএফইডি কর্মকর্তারা ২০২১ সালের ১৬ আগস্ট ঢাকার মিরপুরে গ্রামীণ টেলিকমের অফিস পরিদর্শন করে শ্রম আইনের বেশকিছু লঙ্ঘন খুঁজে পান।
গত ১ জানুয়ারি ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান শেখ মেরিনা সুলতানা এক মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. ইউনূস এবং এর পরিচালক আশরাফুল হাসান, নুরজাহান বেগম ও এম শাহজাহানকে ৬ মাসের কারাদণ্ড দেন। একইসঙ্গে তাদের ৪ জনকেই ৩০ হাজার টাকা করে জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও ২৫ দিন কারাদণ্ড দেয় আদালত। রায়ের পর আলাদা আলাদা জামিন আবেদন করলে তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ৪ জনকেই জামিন দেন আদালত।
গত ২৮ জানুয়ারি আদালতে উপস্থিত হয়ে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় শ্রম আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেন ড. ইউনূস ও গ্রামীণ টেলিকমের অন্য ৩ শীর্ষ কর্মকর্তা।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি ড. ইউনূসের আবেদন খারিজ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্টকে ৫০ কোটি টাকা জমা দিয়ে ২০১১ থেকে ১৩ করবর্ষের আয়কর আপিল ফাইল করার রায় দিয়েছে হাইকোর্ট।
এদিকে গত ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মিরপুরের চিড়িয়াখানা রোডে গ্রামীণ টেলিকম ভবন দখল চেষ্টার অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি সামনে এনে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারকে প্রশ্ন করেন একজন সাংবাদিক। তার জবাবে ইউনূসের বিচার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তুলে ধরেন মিলার।
মিলার বলেন, “আমরা উদ্বিগ্ন, শ্রম ও দুর্নীতি দমন আইনের অপব্যবহারের যে ধারণা তৈরি হচ্ছে, সেটা আইনের শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং ভবিষ্যতের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ প্রাপ্তিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।”