Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

কলাম

ষষ্ঠ শ্রেণিতে যৌনস্বাস্থ্য শিক্ষায় সমস্যা কী

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এর ষষ্ঠ শ্রেণির ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বইয়ে ব্যবহৃত ইলাস্ট্রেশন।

কেস-১:

দীপা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। সে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে নিয়মিত আসত। বরাবরই সে বার্ষিক পরীক্ষায় ভালো ফল করত। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর থেকেই দেখা গেল প্রতি মাসেই সে একটি নির্দিষ্ট সময়ে কয়েক দিন স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। এই সময়ে বাড়িতে অবস্থান করে। এ কারণে শ্রেণির কাজে অংশ নিতে পারে না। এতে করে তার পড়াশোনার মারাত্মক ক্ষতি হয়। একদিকে তার পড়াশোনার ক্ষতি অন্য দিকে জীবনের এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। কি করবে ভেবে পায় না। সারাক্ষণই সে মনমরা হয়ে থাকে। এ বিষয়ে কারও সঙ্গে কথা বলতে সে লজ্জাবোধ করে। একা থাকতে চায়, সবার সামনে আসতে চায় না। এ বছর সাময়িক পরীক্ষাতে সে আশানুরূপ ফল করতে পারে নি।

কেস-২:

রানা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। সে নিয়মিত স্কুলে যায়। শিক্ষকের কথা মেনে চলে। বন্ধুরা তাকে ভালোবাসে। তার প্রতিবেশী, পরিবারের সবার কাছেই সে স্নেহের পাত্র। কিন্ত কিছু দিন থেকে সে কারও সঙ্গে খেলাধুলা করে না। স্কুলেও নিয়মিত যায় না। মাঝে মাঝে অস্থির হয়ে ওঠে। সে তার এই অস্থিরতার কারণ কাউকে খুলে বলতে পারে না। তার মা খেয়াল করলেন, সে তার ঘরে কাউকে আসতে দেয় না। সে নিজের কাপড় চোপড়ও কাউকে ধরতে দেয় না। হঠাৎ করেই রেগে যায়। কিছু বলতে গেলে সে কখনো সংকোচ বা লজ্জাবোধ করে।

বয়ঃসন্ধি পেরোচ্ছে এমন দুজন কিশোর কিশোরীর শারিরীক ও মানসিক বিপর্যস্ততার খানিক আভাস আছে ওপরের কেস দুটোতে। আজকাল এসব সমস্যা নিয়ে পত্র পত্রিকায় বেশ লেখালেখি হয়, নানা রকম চিঠিপত্র ছাপা হয়, সাথে উত্তরও। টেলিভিশনে বা অনলাইনেও নানা রকম আলোচনা হয় এসব নিয়ে। মেন্টাল হেলথ এবং রিপ্রোডাকটিভ হেলথ এক্সপার্টরা প্রায়ই নানা রকম পরামর্শ দেন অনলাইন অফলাইনে, প্রিন্ট বা ভিস্যুয়াল মিডিয়ায়; এবং আমরা এতে সাধুবাদও জানাই। আজকাল অনেকেরই অভিমত এই যে বয়ঃসন্ধি, প্রজনন স্বাস্থ্য, বা সেক্স এডুকেশন নিয়ে কথা বলার দরকার আছে। এই সব ট্যাবু ভাঙার সময় এসেছে। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় এমন সব মন্তব্য প্রায়ই দেখি। কিন্তু যদি বলি ওপরের কেইস দুটো হুবহু তুলে দেওয়া হয়েছে আমাদের ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড’-এর ‘ষষ্ঠ শ্রেণি’র ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বই থেকে (পৃষ্ঠা ৪৪ ও ৪৫), তাহলে এদেরই অনেকে নড়েচড়ে বসবেন। কেউ কেউ বলবেন-একেবারে পাঠ্য বইয়ে এসবের কি আসলেই দরকার ছিল? মানে স্কুলে এসব খোলামেলা কথাবার্তা…, এসব ব্যাপার তো বাচ্চারা পরিবার থেকে এমনিতেই শিখে যায়….আর ক্লাস সিক্সেই বা এসব কেন? নাহ, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না কি?

বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের শারীরিক-মানসিক পরিবর্তন নিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বইয়ে পাঠ সহযোগী ইলাস্ট্রেশন।

যারা ট্যাবু ভাঙার, আধুনিক হবার কথা বলেন, যারা সারাক্ষণ ফেইসবুকে আধুনিকতার কথা বলেন, পশ্চিমা মুক্তচিন্তার বন্দনা গান, কিংবা বিদেশের লেখাপড়া কত ভালো সেই তুলনা করেন, তাদেরও দেখছি পাঠ্যপুস্তকে বয়ঃসন্ধির শারিরীক ও সেক্সুয়াল পরিবর্তন অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিচ্ছেন। বলছেন সত্যি কি এসবের দরকার ছিল আমাদের দেশে? তাও আবার এত ছোট বালক বালিকাদের ক্লাসে? এখনও কি সেই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সমাজে?

বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের শারীরিক-মানসিক পরিবর্তন নিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বইয়ে পাঠ সহযোগী ইলাস্ট্রেশন।

আগের কালে জানাবোঝার ধরণ কেমন ছিল?

স্কুলে পড়তে ‘পিরিয়ড’ বা ‘মাসিক’ সম্বন্ধে প্রথম শুনেছিলাম এক বান্ধবীর কাছে। ধরা যাক তার নাম শিলা। একটু আগেভাগেই সে রজস্বলা হয়েছিল। তিনতলায় ওঠার সিঁড়ির কোণে দাঁড়িয়ে একদিন তার কাছে যে জ্ঞান লাভ করেছিলাম তা এরকম:

১. এই ঘটনার মানে হলো সে এখন বড় হয়ে গেছে। ২. যেহেতু সে বড় হয়ে গেছে তাই  যখন তখন তার বাচ্চা হয়ে যেতে পারে। ৩. এই দিনগুলোতে সে আমাদের সাথে  টিফিন টাইমে বেশি ছোটাছুটি বা খেলাধুলা করতে পারবে না। ৪. এই সময় বাসায় হুজুরের কাছে বা স্কুলে ধর্ম ক্লাসে পড়তে পারবে না কারণ এ সময় মেয়েরা ‘অপবিত্র’ থাকে।

বিষয়টা ছিল খুবই আতঙ্কের। কারণ আমাদের বাকিদের ধারণা হয়েছিল যে প্রতি মাসে এমন রক্তপাত হতে থাকলে আমরা সবাই এক সময় রক্তশূন্য হয়ে মারা যাব। আর বাচ্চা হবার সম্ভাবনা তো আরও ভয়ংকর। কারণ তার দুদিন পর সন্তানসম্ভবা চাচী বেড়াতে এসেছিলেন বাসায়, তাঁর বেঢপ উঁচু পেট আর কষ্টকর চলাফেরা দেখে রীতিমত ভয়ে কান্না পেয়ে যাচ্ছিল, তার ওপর শিগগিরই নাকি হাসপাতালে নিয়ে পেট কেটে সেই বাচ্চা বের করা হবে শুনে তো ভয়ে আধমরা। আর এটাও বেশ বুঝতে পারা যাচ্ছিল যে ছেলেরা আর আমরা এক নই, ওরা যখন তখন খেলতে যেতে পারে, যা খুশি তাই করতে পারে, ওদের এসব শারিরীক পরিবর্তনের ঝুট ঝামেলা নেই! আহা ছেলেদের জীবন কত সুন্দর! কেন আমরা ছেলে হয়ে জন্ম নিলাম না সেই দুঃখে সবার মন খারাপ। এদিকে বাড়িতে মা বা অন্য কেউ এসব নিয়ে কখনও কিছু বলেননি। জিজ্ঞেস করার সাহসও নেই। স্কুলে গার্হস্থ্য বিজ্ঞান বইয়ে কীসব জানি একটু লেখা ছিল, মিস না পড়িয়ে বলেছেন ওইটুকু বাড়িতে পড়ে নিও। একবার ছুটিতে নানা বাড়ি গেলে নানু ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বালেগ হয়েছি কিনা’। শুনে কেঁদে কেটে দৌড়! 

ফলে ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের দীপাকে বুঝতে আমার একটুও কষ্ট হচ্ছে না। বেশ অনুভব করতে পারছি তার সমস্যাটা। কারণ এই রহস্যময় বিব্রতকর আজব সময়টা তো আমরা সবাই কম বেশি পার হয়ে এসেছি। কিন্তু রানা?

‘‘আমি কারও সাথে নিরাপদ ও স্বস্তিবোধ করছি কি না বোঝার অন্যতম উপায় হলো তারা আমাকে
কীভাবে স্পর্শ করে। দুই ধরনের স্পর্শ রয়েছে: নিরাপদ স্পর্শ ও অনিরাপদ স্পর্শ।” ষষ্ঠ শ্রেণির ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বইয়ে পাঠ সহযোগী ইলাস্ট্রেশনে এমন অনেক কিছু সহজে বুঝিয়ে বলা হয়েছে।

খুবই আশ্চর্যের বিষয় হলো বিগত ১৫-২০ বছরে আমাদের দেশের মেয়েরা তাদের শরীর, পিরিয়ড, প্রজনন স্বাস্থ্য, বিবাহ ও সেক্স, এবিউস বা যৌন নির্যাতন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করতে অনেকটা দ্বিধামুক্ত হয়েছে, আজকাল অনেক মেয়েই এসব নিয়ে নিঃশঙ্কচিত্তে কথা বলতে শিখেছে, টেলিভিশনে সারাক্ষণ স্যানিটারি প্যাডের বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে কেউ তাতে বিব্রত হচ্ছে না, কিন্তু আমাদের দেশের ছেলেরা এখনও এসব বিষয়ে রয়ে গেছে ভীষণ রকম রক্ষণশীল। বয়ঃসন্ধিকালীন শারিরীক পরিবর্তন, লোম বা দাড়ি গোঁফ গজানো, ইরেকশন, বীর্যপাত, মাস্টারবেশন— আমি আজ পর্যন্ত কোনও কাছের কিশোর তরুণ বা পুরুষকে এসব বিষয় শেয়ার করতে শুনিনি কারও সাথে।

একবার একটি লেখা তৈরি করার জন্য চাইল্ডহুড সেক্সুয়াল এবিউজ নিয়ে বেশ কজন পুরুষকে আলাদা আলাদা কিছু প্রশ্ন করেছিলাম, প্রায় সকলেই গম্ভীর হয়ে এড়িয়ে গেছেন, কেউ মুখ খুলতে চাননি। ব্যাপারটা আমাকে সত্যি অবাক করে। হরমোন বিশেষজ্ঞ হবার সুবাদে আমার কাছে বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোর কিশোরীদের নানা রকম সমস্যা নিয়ে প্রায়ই অভিভাবকরা আসেন, সেখানেও মেয়েরা যতটা খোলামনে সমস্যার কথা বলতে পারে, আলোচনা করে বা প্রশ্ন করে, দেখেছি ছেলেরা ততটাই মুখ লুকিয়ে থাকে, পালিয়ে বাঁচতে চায়। নিজের শরীর নিয়ে কথা বলতে তাদের প্রচণ্ড অনীহা ও লজ্জা। তাই রানার সমস্যাটা আমি ঠিক অনুভব করতে পারছিলাম না। তবে নিশ্চয় প্রায় প্রতিটি কিশোর তার বয়ঃসন্ধিতে এ ধরনের সমস্যায় পড়ে, তখন তারা কার সাথে আলাপ করে, কীভাবে সামাল দেয়, কার সাহায্য নেয়-বিষয়টা সত্যিই আমাদের জানা উচিত।

আমাদের সমাজে বিষয়টি স্পর্শকাতর বলে আমাদের শিক্ষকদের হয়ত এ বিষয়টি পড়ানোর জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হতে পারে। কিন্তু তাই বলে বিষয়টির গুরুত্ব ও পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।

তাহলে তারা কীভাবে জানে?

পিউবারটাল বা কৈশোরজনিত নানা সমস্যা নিয়ে অনেকেই আমাদের কাছে পরামর্শ নিতে আসে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পিউবারটি সম্পর্কে তাদের পরিস্কার কোনও ধারণা নেই। আরও ভয়ঙ্কর কথা, তাদের বাবা মায়েদেরও নেই। যেমন মায়েদের ধারণা কিশোরীর অনেক বেশি বয়সে বা অনেক কম বয়সে শুরু হওয়া পিরিয়ড, অনিয়মিত পিরিয়ড, তীব্র ব্যথাযুক্ত পিরিয়ড, মাসের পর মাস বন্ধ থাকা পিরিয়ড ইত্যাদি স্বাভাবিক ব্যাপার। এগুলো বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে। কোনও কোনও অভিভাবকের ধারণা তাদের ছেলে সন্তানের লিঙ্গ যথেষ্ট বড় হচ্ছে না, তারা প্রায়ই প্যান্ট খুলে দেখেন কত বড় হলো! এটা যে সন্তানের জন্য কতটা অপমানজনক তা বোঝেন না। ‘পিসিওএস’ নাকি বাচ্চা নিলে সেরে যাবে, কারণ পরে আর বাচ্চা হবে না— এই ধারণা বেশির ভাগ মায়েদের। তো স্রেফ কৌতুহল থেকেই এসব বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আসা কিশোর কিশোরীদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, পিরিয়ড ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে তারা প্রথম কীভাবে জেনেছে?

‘‘আমার শরীরের চারপাশে ব্যক্তিগত সীমানা ঘিরে থাকা বাবলে কে প্রবেশ করতে পারবে এবং কে পারবে না তা নির্ধারণ করার সম্পূর্ণ অধিকার আমার।’’ ষষ্ঠ শ্রেণির ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বইয়ে পাঠ সহযোগী ইলাস্ট্রেশনে এমন অনেক কিছু সহজে বুঝিয়ে বলা হয়েছে।

বেশির ভাগ কিশোরী বলেছে মায়েরা এ নিয়ে প্রথম আলাপ করেছেন পিরিয়ড শুরু হয়ে যাবার পর, আগে নয়। আর তার বেশিটাই কিভাবে প্যাড ব্যবহার করতে ও ডিসপোজ করতে হবে— আলোচনা সেটাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এর বেশি খোলাসা করে বা ব্যাখ্যা করে কেউ কিছু বলার দরকার মনে করেনি। কেউ কেউ নানী দাদীর কাছে কিছুটা জেনেছে, এমনকি কেউ কেউ জেনেছে বাড়ির গৃহকর্মী বা কেয়ারগিভারদের কাছ থেকে। তবে অনেকেই তার আগেই বন্ধু বান্ধব ও গুগলের সাহায্য নিয়ে বিষয়টা জানতে চেষ্টা করেছে। কিশোরদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও নাজুক। তাদের সঙ্গে মা বা বাবা কেউ এসব নিয়ে কোনওদিন কোনও আলাপই করেননি। ছেলেদের জন্য খুব কাছের কোনও বন্ধু বা ইন্টারনেটই একমাত্র ভরসা।

এবার আরেকটু কৌতুহলী হয়ে আমি ইন্টারনেট বা গুগল ঘেঁটে দেখতে চেষ্টা করলাম কী ধরণের তথ্য আছে ওখানে! প্রথমেই এল উইকিপিডিয়া। পড়ে মাথা গুলিয়ে গেল। একটা উদাহরণ দিই। উইকিপিডিয়ার বক্তব্য অনুযায়ী “রজঃস্রাব (ইংরেজি: Menstruation) হলো উচ্চতর প্রাইমেট বর্গের স্তন্যপায়ী স্তরী- একটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া যা প্রজননের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রতি মাসে এটি হয় বলে এটিকে বাংলায় সচরাচর ‘মাসিক’ বলে অভিহিত করা হয়।’’

এই তথ্য পড়ে কে কী বুঝবে বুঝলাম না। গুগলে এর পর এল কিছু পত্র পত্রিকার ফিচার। তাতে এ বিষয়ে হালকা পাতলা কিছু আলোচনা আছে। তার পর এল মাসিকের সময় কী করণীয় তা নিয়ে প্রচুর আলাপ। এ সময় গৃহকর্ম ও ব্যায়াম করা যাবে কিনা, স্বামীর সাথে দৈহিক মিলন করা যাবে কিনা, স্বামী যদি চায় তাহলে কী করতে হবে, কীভাবে পাক পবিত্র হতে হবে, রোজা রাখার নিয়ম কী ইত্যাদি অনেক কিছু আছে অর্ন্তজালে।

‘‘ আমার শরীরের চারপাশে ব্যক্তিগত সীমানা ঘিরে থাকা বাবলে কে প্রবেশ করতে পারবে এবং কে পারবে না তা নির্ধারণ করার সম্পূর্ণ অধিকার আমার। ষষ্ঠ শ্রেণির ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বইয়ে পাঠ সহযোগী ইলাস্ট্রেশনে এমন অনেক কিছুই সহজে বুঝিয়ে বলা হয়েছে।

যদিও মাসিক চলাকালীন হাইজিন, পুষ্টি ইত্যাদি নিয়ে কথা কম। কেন এবং কী ধরণের হরমোনজনিত শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের কারণে একটা মেয়ে রজস্বলা হয়, এর অস্বাভাবিকতাগুলো কী বা করণীয় কী সে সম্পর্কে কোনও কথাবার্তা নেই। ছেলেদের বীর্যপাত নিয়ে সার্চ করার ফল হলো ভয়াবহ। মনে হলো এক বিশাল অশ্লীল পর্নো জগতে ঢুকে পড়েছি। ওয়েবসাইটে, অনলাইনে প্রচুর অবৈজ্ঞানিক, অর্থহীন, অপ্রোয়জনীয় কথাবার্তা। কিছু কিছু সাইট বেশ ভয় দেখানো। অন্তর্জালের সরবরাহ করা তথ্য ও জ্ঞানের ধরণ দেখে মাথা রীতিমত ঘুরতে থাকল। তাহলে এই হলো অবস্থা! আমাদের ছেলেমেয়েরা তাহলে এভাবেই জানে ও বোঝে! এছাড়া তাদের আর কোনও উপায় নেই।

শিক্ষার যে দুটো প্রধান মাধ্যম আমাদের— পরিবার এবং শিক্ষক— তারা যে এ বিষয়গুলো নিয়ে মুখে কুলুপ এটেঁছেন। ওদিকে বাচ্চারা টিকটক, গুগল, কে ড্রামা, ওটিটি দেখে সব কিছু অতিরিক্ত জেনে বসে আছে গোপনে। বিশ্বাস করুন, বিদেশি এক টিভি সিরিজে দুই বান্ধবী যে আসলে ‘ফ্রেন্ড’ নয়, ‘পার্টনার’— এই কথার অর্থ কী, তা আমি এ বয়সে প্রথম জেনেছি আমার এক টিনএজার ভাগনির কাছ থেকে। এবং ফ্রেন্ড আর পার্টনার এর পার্থক্য বুঝি না বলে সে আমাকে নিয়ে ব্যাপক হাসাহাসি করেছে!

কী আছে পাঠ্য বইয়ে?

এবার আবার আসা যাক ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্য বইয়ের পাতায়। দুটো চমৎকার টেবিল করা হয়েছে বইয়ের ৪৮ নং পৃষ্ঠায়। বয়ঃসন্ধি সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ধারণা এবং সঠিক তথ্য। টেবিল দুটো এখানে তুলে দেওয়া হলো:

ষষ্ঠ শ্রেণির ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বইয়ের ৪৮ পৃষ্ঠায় মাসিক সম্পর্কে ভুল ধারণা ও সঠিক তথ্যের উপস্থাপন।
ষষ্ঠ শ্রেণির ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বইয়ের ৪৮ পৃষ্ঠায় বীর্যপাত সম্পর্কে ভুল ধারণা ও সঠিক তথ্যের উপস্থাপন।

এর বাইরেও আছে কীভাবে বয়ঃসন্ধিকালে নিজের যত্ন নিতে হবে, মনের যত্ন নিতে হবে, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে ইত্যাদি। এই বইয়ের শেষে আছে নিরাপদ ও অনিরাপদ স্পর্শ, আন্তসম্পর্কের ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ, কোন সেবা প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নেবে (হেলপলাইন ও কলসেন্টারের নম্বরও দেওয়া আছে) ইত্যাদি বিষয় নিয়ে অনুচ্ছেদ যে বিষয়গুলোর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব প্রতিটি অভিভাবকই জানেন।  

যৌনস্বাস্থ্য শিক্ষা কেন পাঠ্য বইয়ে দরকার?

কম্পিটেন্সি বেইজড এডুকেশন আমাদের জন্য ফলপ্রসূ বা প্রযোজ্য কিনা, এখনই আমরা এর জন্য তৈরি কিনা, আমাদের শিক্ষকরা যথেষ্ট প্রশিক্ষিত কিনা এসব বিষয় নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাই না। কারণ আমি শিক্ষা বা কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ নই। তবে একজন হরমোন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে এবং চিকিৎসক হিসেবে আমি নিশ্চয় চাই যেন স্কুলের পাঠ্যবইয়ে সহজ, সাধারণ ভাষায় বয়ঃসন্ধি ও এর সমস্যাগুলো নিয়ে বৈজ্ঞানিক ও প্রয়োজনীয় আলাপটুকু করা হয়, খানিকটা যৌনস্বাস্থ্য শিক্ষা বা সেক্স এডুকেশনও যেন দেওয়া হয়, যাতে কিশোর কিশোরীরা বিভিন্ন অবৈজ্ঞানিক উৎস থেকে অপব্যাখ্যা জেনে বিভ্রান্ত না হয়, কুসংস্কারমুক্ত থাকে এবং শরীরের আর পাঁচটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মতো প্রজনন অঙ্গগুলোরও সুস্বাস্থ্য ও যত্ন জরুরি তা যেন জানতে পারে। তাই হৃদপিণ্ড ও রক্তসংবহনতন্ত্র বা পরিপাকতন্ত্র বা হজমপ্রক্রিয়া যেভাবে পাঠ্যবইয়ে পড়ানো হয় সেভাবে প্রজনন স্বাস্থ্যও পড়াতে হবে। প্রজনন অঙ্গ শরীরের বাইরের কিছু নয়, এগুলোও শরীরের অংশ।

অনেকে বলবেন, তাই বলে ক্লাস সিক্সের ছোট ছোট শিশুদের কেন এসব ‘বড়দের’ বিষয় বলতে হবে? তাদের উদ্দেশ্যে বলছি একটি ছেলে বা মেয়ের পিউবারটি বা কৈশোর শুরু হয় ৯ থেকে ১২ বছর বয়সে। কারও কারও ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত গড়ায়। এটা সেই সময় যখন তার শরীরে সেক্স হরমোনগুলোর মাত্রা বাড়তে থাকে, শরীরে দেখা দেয় নানা বিব্রতকর পরিবর্তন, মেয়েদের মেনস্ট্রুয়েশন শুরু হয়, ছেলেদের শুরু হয় ইরেকশন। একই সাথে তাদের মনোজগতে গভীর পরিবর্তন আসে, তারা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। তাই ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীরাই এ ধরনের শিক্ষার জন্য  সবচেয়ে উপযুক্ত। আমাদের সমাজে বিষয়টি স্পর্শকাতর বলে আমাদের শিক্ষকদের হয়ত এ বিষয়টি পড়ানোর জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হতে পারে। কিন্তু তাই বলে বিষয়টির গুরুত্ব ও পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।

লেখক: চিকিৎসক ও সহযোগী অধ্যাপক, হরমোন বিশেষজ্ঞ।

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত