বাংলাদেশ প্রথম ওয়ানডে খেলেছিল ১৯৮৬ সালে। এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই ম্যাচে ইমরান খান, ওয়াসিম আকরাম, আব্দুল কাদিরদের সামলে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান করেছিলেন শহীদুর রহমান। চট্টগ্রামের এই ব্যাটার সকাল সন্ধ্যার রাহেনুর ইসলামকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে শোনালেন ম্যাচটার গল্প। পাশাপাশি হতাশাও জানালেন চট্টগ্রামের ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থা নিয়ে।
সকাল সন্ধ্যা : চট্টগ্রামে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টে নেই চট্টগ্রামের কেউ। হতাশ নিশ্চয়ই।
শহীদুর রহমান : এটা নতুন কিছু না। এ বছর এটা চট্টগ্রামে দ্বিতীয় টেস্ট। এর আগে ২০২২ সালে সবশেষ খেলা টেস্টেও ছিল না চট্টগ্রামের কেউ। কখনও নাঈম হাসান তো কখনও শাহাদাত হোসেন দীপু সুযোগ পায়,-আর কাউকে তো দেখি না। চট্টগ্রামের ক্রিকেটার হিসেবে এটা পীড়া দেয়।
প্রশ্ন : ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডেতে খেলেছিলেন চট্টগ্রামের তিনজন-আপনি, মিনহাজুল আবেদিন নান্নু ও নুরুল আবেদিন নোবেল। এছাড়া আকরাম খান, তামিম ইকবালসহ আরও অনেক তারকা উঠে এসেছে চট্টগ্রাম থেকে। এখন সেভাবে আসছে না কেন?
শহীদুর রহমান : এই উল্টো ছবিটা আসলেই হতাশার। দুইটা টেস্ট ভেন্যু আছে আমাদের। এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে আর ক্রিকেট না হলেও জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম বিশ্বমানের। আমার জানা মতে ১০০’র বেশি ক্রিকেট একাডেমিও আছে চট্টগ্রামে। বিকেএসপি আছে। তবু ক্রিকেটার উঠে আসছে না। নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো কারণ আছে।
প্রশ্ন : সেটাই জানতে চাচ্ছি?
শহীদুর রহমান : অনেক কারণ আছে। আমি একটাই বলতে চাই। আমার মতে মেধা আর পরিশ্রমের সমন্বয়টা হচ্ছে না। আমরা অনেক বেশি পরিশ্রম করতাম। তখন টাকা ছিল না, চাহিদাও ছিল না। ঢাকার যে সব ক্লাবে খেলেছি তারা কেবল যাতায়াতের টাকা দিত। ঢাকায় গেলে থাকার ব্যবস্থা করত। তাতেই আনন্দ খুঁজে পেতাম। এখন পেশাদারিত্ব অনেক বেশি। তবে আমাদের সময়ের মতো ছেলেরা পরিশ্রম করে না। মেধাবী ছেলে অবশ্যই আছে। কিন্তু মেধাবীরা পরিশ্রম করছে না। আর যারা পরিশ্রমী তাদের অনেকে মেধাবী নয়। এই দুটোর সমন্বয় শুধু চট্টগ্রাম নয়, পুরো দেশের ক্রিকেটেই করতে হবে। তাহলে উন্নতি করতে পারব আমরা।
প্রশ্ন : সেটা কীভাবে?
শহীদুর রহমান : বর্তমান বোর্ড প্রেসিডেন্ট ফারুক আহমেদ আমার বন্ধু। আমরা একই সময়ে খেলা শুরু করেছি। আপনার মাধ্যমে তার কাছে একটা মেসেজ দিতে চাই, জাতীয় দল বা বয়স ভিত্তিক দলে কোনো ক্রিকেটারকে সুযোগ দেওয়ার আগে যেন আইকিউ টেস্ট নেওয়া হয়। ক্রিকেট শক্তির খেলা না ভাই, এটা বুদ্ধির খেলা। তাই মেধাবী না হলে সফল হওয়া কঠিন। ছোট ছোট জিনিস ক্রিকেটে পার্থক্য গড়ে দেয়। বলছি না যে, ক্রিকেটারদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে। তবে ক্রিকেটাররা যেন মেধাবী হয়, একজন গ্রামের ছেলেও মেধাবী হতে পারে। তাদের খুঁজে নিতে হবে।
প্রশ্ন : ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডেতে দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান করেছিলেন আপনি। ইনিংসটা মনে আছে নিশ্চয়ই।
শহীদুর রহমান : ম্যাচটা ভুলব কীভাবে? ওয়াসিম আকরামের বল লেগে পায়ে রক্তজমাট হয়ে আছে এখনও। ৩৮ বছর হয়ে গেল কিন্তু এটা সারেনি। কষ্ট হয়, সাথে গর্বও হয়। দেশের জন্য না হয় এইটুকু ব্যথা নিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিলাম। ইমরান খান, ওয়াসিম আকরামদের মতো কিংবদন্তিদের বিপক্ষে ৬০ বলে ৩৭ রান করেছিলাম। ওটাই ছিল আমাদের সর্বোচ্চ স্কোর। মাঠ ভেজা না থাকলে ৩৭ রানটা ৬০ হতে পারত। নিশ্চিত কয়েকটা বাউন্ডারি হয়নি ভেজা মাঠের জন্য। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৪ রান করেছিল রফিকুল আলম (৪৩ বলে) ও গোলাম ফারুক (১৪)। আমি আব্দুল কাদিরকে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে আউট হই। ওয়াসিমকে সামলালেও কাদিরের লেগব্রেক আর গুগলি মনে হচ্ছিল ধাঁধার মতো। অসাধারণ বোলার তিনি।
প্রশ্ন : ইনিংসটা খেলার পুরস্কার হিসেবে বিশেষ কোনো পুরস্কার পেয়েছিলেন?
শহীদুর রহমান : এশিয়া কাপের অ্যাপিয়ারেন্স মানি ৫০ হাজার ডলারের পুরোটা বোর্ড রেখে দেয়। আমাদের ভাগ দেওয়া হয়নি। তবে পাকিস্তানের বিপক্ষে ইনিংসটার জন্য তখনকার বোর্ড সভাপতি কে জেড ইসলাম দিয়েছিলেন ৩০০ ডলার। টাকাটা সবার মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলাম, অথবা সবাই মিলে খেয়েছিলাম-ঠিক মনে নেই।
প্রশ্ন : আপনি মাত্র দুটি ওয়ানডে খেলে অবসর নিয়েছেন। চাইলে কি আরও বেশি ম্যাচ খেলতে পারতেন না?
শহীদুর রহমান : এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে পরের ম্যাচে করেছিলাম ২৫ রান। ওটা ছিল সেই ম্যাচে বাংলাদেশের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্কোর। সবচেয়ে বেশি ৪০ করেছিলেন মিনহাজুল আবেদিন নান্নু। আসলে আমাদের সময় আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনেক কম হতো। সেই এশিয়া কাপ শেষে বাংলাদেশ ওয়ানডে খেলে আড়াই বছর পর। তখন তো তেমন টাকা পেতাম না আমরা। জীবিকার তাগিদেই আসলে ক্রিকেট ছেড়ে ব্যবসায় জড়াই।
প্রশ্ন : ক্রিকেট ছাড়ার পর কি করছেন এখন?
শহীদুর রহমান : এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে ‘রয়্যাল হাট’ নামে রেস্টুরেন্ট আছে আমার। চট্টগ্রামেরই ক্রিকেটার নুরুল আবেদিন নোবেলের সঙ্গে করেছি এটা। এছাড়া গার্মেন্টস এর ব্যবসাও আছে। সবমিলিয়ে ভালো আছি, দোয়ায় রাখবেন।