আদালতে যখন নেওয়া হলো, তখন বরাবরের মতোই হাসিমুখে ছিলেন শাজাহান খান; কিন্তু কাঠগড়ায় যখন উঠলেন তখন বন্দি ছেলের কথা তুলে কান্নায় ভেঙে পড়লেন প্রবীণ এই রাজনীতিক।
গত বছরের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ঢাকার বাড্ডায় রফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি নিহত হওয়ার মামলার রিমান্ড শুনানিতে সোমবার ঢাকার আদালতে হাজির করা হয়েছিল শাজাহান খানকে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এই সদস্য, সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হওয়ার পর অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডকেন্দ্রিক বেশ কয়েকটি মামলায় তাকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।
বরাবরই হাস্যোজ্জ্বল শাজাহান খানকে গত ৫ মার্চ যখন আরেকটি মামলায় ঢাকার আদালতে হাজির করা হয়েছিল, তখন তিনি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে বলেছিলেন, “আমি সব সময় হাসি, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হাসতে থাকব।”
সোমবারও যখন তাকে কারাগার থেকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে নেওয়া হয়, তখনও তার মুখে ছিল হাসি। কাঠগড়ায় তোলার পর আইনজীবীর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শও করেন তিনি।
সকাল ১০টার পর আদালতের বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয় হাকিম এম এ আজহারুল ইসলাম আসন নেওয়ার পর।
শুরুতেই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক শফিউল আলম আসামি শাজাহান খানকে ৫ দিনের জন্য রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী শুনানি করেন। আসামিপক্ষে মিজানুর রহমান রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন।
রিমান্ড শুনানিকালে শাজাহান খান বলেন, “মাননীয় আদালত, আমাকে একটু কথা বলার সময় দিন, আমি কথা বলতে চাই।”
এরপর আদালতের অনুমতি নিয়ে তিনি বলেন, “পিপি সাহেব বলেছেন, আন্দোলনে পুলিশ গুলি করেছে। সে অর্ডার তো দিতে পারে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। গুলি চালানোর অর্ডার তো আমি দিতে পারি না।
“আমি জড়িত না। কেন আমার বিরুদ্ধে এই মামলা হলো? শুধু আমার বিরুদ্ধে না, আমার বড় ছেলে আসিবুর রহমানকে আসামি করা হয়েছে। সে এখন জেলে।”
এই পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন শাজাহান খান। টিস্যু দিয়ে দুই চোখ বার বার মুছতে থাকেন তিনি।
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, “আমার ছেলের সঙ্গে পাঁচ মাস আমার দেখা নেই। আমি ঢাকায় থাকলে ছেলে মাদারীপুরে। আপনি এখনই চেক করতে পারেন। প্রশ্ন- আমার ছেলে কী করেছে?”
জুলাই আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিকায় কয়েকশ মানুষ প্রাণ হারায়। রক্তাক্ত সেই পথ পেরিয়ে তা অভ্যুত্থানে রূপ নিলে গত বছরের ৫ আগস্ট পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের।
এরপর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়, গ্রেপ্তার করা হয় আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, এমপিসহ দলটির বহু নেতাকে। জুলাই অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন মামলায় তারা এখন আসামি।
যে মামলায় শাজাহান খানকে রিমান্ডে পাঠানো হলো, বাড্ডা থানার সেই মামলার অভিযোগে বলা হয়, গত বছরের ১৯ জুলাই উত্তর বাড্ডা বিসমিল্লাহ হোটেলের পাশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন রফিকুল ইসলাম। সেখানে গুলিতে আহত হন তিনি। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পরের মাস সেপ্টেম্বরের ২৭ তারিখে নিহতের মামা পরিচয়ে লুৎফুর রহমান নামে এক ব্যক্তি বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় মামলাটি করেন।
সোমবার শুনানিতে শাজাহান খানের আইনজীবীরা আদালতে বলেন, মামলার বাদীকে চেনেন না নিহতের মা ও স্ত্রী। তাকে দেখেনও নাই। তাদের বাড়ি মাদারীপুরে শাজাহান খানের নির্বাচনী এলাকায়। বাদী লুৎফুর রহমানের শ্বশুর ওই এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম।
সিরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে কয়েকটি হত্যা মামলার কথা উল্লেখ করে আইনজীবীরা বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় ওই চেয়ারম্যান শাজাহান খানের কাছে গিয়েছিল তাকে মামলামুক্ত করার জন্য। কিন্তু শাজাহান খান আইনের বাইরে কিছু করতে রাজি না হওয়ায় এখন তার প্রতিশোধ হিসাবে তাকে ও তার ছেলেকে এই মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।
এরপর শাজাহান খানও আদালতে বলেন, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এই মামলা দেওয়া হয়েছে।
“উনারা (আইনজীবী) ভালোভাবে বিষয়টা বলতে পারেননি। চেয়ারম্যান (সিরাজুল) ৬টা হত্যা মামলার আসামি। আমি তার পক্ষে ছিলাম না। তাই ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এই মামলা দিয়েছে।”
শুনানি শেষে হাকিম আজহারুল ইসলাম আসামি শাজাহান খানের জামিন আবেদন নাকচ করে তাকে চার দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।
এরপর হেলমেট, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ও হাতকড়া পরিয়ে আদালত থেকে শাজাহান খানকে বের করা হয়। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা তাকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করলে তিনি বলে ওঠেন, “কথা বলা নিষেধ? কথা তো বলতে হবে। গণতান্ত্রিক দেশ।”
আদালত থেকে হাজতখানার নেওয়ার পথে শাজাহান খান আবার বলেন, “এদেশের মায়েরা, বোনেরা এখন রাস্তায় নামছে উপদেষ্টার পদত্যাগের জন্য।”
তখন দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা তাকে দ্রুত হাজতখানায় নিয়ে যান।
এক সময় জাসদ করে আসা শাজাহান খান ১৯৮৬ সালে মাদারীপুর-২ (রাজৈর উপজেলা ও সদর উপজেলার একাংশ) আসনে যখন প্রথম সংসদ সদস্য হন। সেবার তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে প্রতিবারই সংসদ সদস্য হয়ে আসছেন ওই আসন থেকে।
দেশে পরিবহন শ্রমিকদের অন্যতম শীর্ষনেতা শাজাহান খানকে ২০০৯ সালে মন্ত্রী করেন শেখ হাসিনা। তারপর ২০১৮ সাল পর্যন্ত মন্ত্রিসভায় ছিলেন তিনি। এরপর মন্ত্রী আর না করলেও তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য করা হয়।