মাগুরা শহরের ভেতরে কেশব মোড়ের নামটা হয়তো আর ক’দিন পর বদলেই যাবে। সাকিব মোড় হয়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সময় যদি মানুষকে বদলে দিতে পারে, এলাকার নামও হতে পারে নতুন।
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ন্যাশনাল হাইওয়ে ৭ ধরে মাগুরায় পৌঁছানো এখন খুব সহজ। শহরের ভায়না মোড়ে নামলেই দেখা যাবে বৈদ্যুতিক তারের সঙ্গে লড়াই করছে পোস্টারও। তাতে নির্বাচনী প্রচারণায় ছেয়ে আছে সাকিব আল হাসানের নাম। শহরের সবচেয়ে ব্যস্ত মোড় হওয়ায় এখানেই একটু পর পর মাইকিংও চলছে।
এই পোস্টার ও মাইকিং সবটাই যে নৌকা প্রতীকের তা আর বলে দিতে হয় না। মাগুরা-১ আসন থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া বাংলাদেশের ক্রিকেট তারকা সাকিব নির্বাচন করছেন এই এলাকা থেকে। মাগুরায় নৌকায় উঠেছেন তিনি।
ভায়না মোড় থেকে আনুমানিক তিন কিলোমিটার দূরের কেশব মোড় যেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। রিকশাওয়ালাকে সরাসরি সাকিবের বাড়ি যাব বললেই হয়।
সুনশান বাড়িতেও মানুষের আগ্রহ
ছোট রাস্তার পাশে চুন রঙের তিনতলা বাড়ির সামনে যেতেই নির্বাচনী আবহ টের পাওয়া গেল। লোহার তৈরি বড় সদর দরজার ওপরে ৭ ফুট লম্বা কাঠ-কাপড়ের নৌকা লাগানো। ভেতরের উঠোনে পুরোটা ঢেকে দেওয়া হয়েছে সাদা সামিয়ানায়। চারপাশে আছে রঙিন প্যান্ডেলও, তবে ওখানে সবসময় খুব জমায়েত হয় না মানুষের।
সেটা হয় বাড়ি থেকে এক মিনিটের হাঁটা পথ সাকিবের নির্বাচনী অফিসে। এই জায়গায় একসঙ্গে ৫০-৬০ জনের বসার ব্যবস্থা আছে। এখানেই প্রতিদিন দুবার আসতে হয় সাকিবকে। দিনের শুরুতে বেলা ১১টা নাগাদ আর রাতে ১০টার পরে। কর্মী, বন্ধু-আত্মীয়দের সঙ্গে পুরো দিনের নির্বাচনী কার্যক্রম নিয়ে আলাপ করতেন।
বাড়িতে সাকিব থাকলে এক-আধটু জটলা হয়। বাকি সময় সুনশান থাকলেও এই বাড়ির প্রতি মানুষের ব্যাপক আগ্রহ। পথ চলতি মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে বাড়িটাকে।
তারকা-খ্যাতিই বড় সম্বল
মাগুরাবাসী অবশ্য নতুন পরিচয়ের সাকিবকে সাদরেই গ্রহণ করেছেন। কখনও সামনে না দেখা নিজেদের ছেলে সাকিবকে কাছে পেয়ে তারা ভালোবাসা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। একবার ছুঁয়ে দেখছেন, কথা বলছেন। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও দাবি বিনিময়ের চেয়ে সেখানে তারকার সঙ্গে আলাপের পর্বই বেশি।
সাকিবের অবশ্য সেই আলাপের সময় নেই। তার রুটিন বদলে গেছে। ক্রিকেটের অনুশীলনের মতো এখন তাকে কাক ভোরে ছুটতে হচ্ছে জনতার দ্বারে দ্বারে। কখনো রাস্তার ধারে পিঠা খেতে হচ্ছে, কখনো-বা জমিতে গিয়ে চাষীদের ভাল-মন্দ জেনে নিচ্ছেন। তাদের সঙ্গে নাস্তা করছেন। এত সময় দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য তাদের ভোট নিশ্চিত করা। এমন তারকার সঙ্গে দু-চার কথা বলতে পেরে এই খেটে খাওয়া মানুষগুলোও বেশ খুশি।
এত বড় তারকা নিজের এলাকার হলেও হয়তো কখনো এত ঘনিষ্টভাবে মেশার সুযোগ হয়নি সাধারণের। তাই জনসভায় বের হলেই সেলফির আবদার থাকে আমজনতার। কোনো প্রচারণাতেই সাকিব ১-২ মিনিটের বেশি বক্তৃতা দেননি। থাকতেন বড়জোড় ৫ মিনিট। দুপুরের খাবার শেষে বেলা ৩টা থেকে মূল প্রচারণা শুরু করতেন তিনি।
নির্বাচনী প্রচারণার স্টেজে উঠে সবার উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলেন। এই সময় মানুষের আগ্রহটাই থাকে স্বচক্ষে দেখা সাকিবের আওয়াজ শোনা। শত্রুজিৎ ইউনিয়নের ৯নং স্কুল মাঠে হওয়া এক জনসভায় দুজন মাঝবয়সী একে অপরকে বলছিলেন, ‘‘সাকিব এখন কথা বলবে। তার আওয়াজ শুনে নিই আগে।’’
তার প্রচারণার একটি অংশ থাকতো টেনিস বল ছোঁড়া। প্রতি জনসভায় নিজের অটোগ্রাফ দেয়া ৬টি টেনিস বল নিয়ে যান সাকিব। স্টেজে ভাষণ শেষে তা ভিড়ের শেষদিকে ছুঁড়ে দেন। উড়ে আসা বল পেতে তরুণরা হুড়মুড় করে লড়াই করে।
এই পর্বে অবশ্য নেতা সাকিবের চেয়ে ক্রিকেট তারকা সাকিবকেই বেশি দেখা যায়। প্রায় প্রতিটা দোকানি বা উপস্থিত ক্রেতা থেকে শুরু করে। রাস্তায় চলাচল করা মানুষ সাকিবের কাছে ছুটে আসতেন শুভেচ্ছা জানাতে। সেই সঙ্গে একটা সেলফির আবদার তো থাকেই। লিফলেট বিতরণে নেমে তাই সেলফির আবদার মেটাতেই বেশি সময় যাচ্ছে সাকিবের।
তবে এখন সাকিবের মাঝে বিরক্তি নেই। যতই ভিড় থাকুক, ভক্তের আবদার বা সেলফির জন্য টানাটানি সব কিছুই সাকিব মেনে নিচ্ছেন হাসিমুখে। রাস্তার পাশের দোকানির দেয়া পুরি-পেঁয়াজুও খাচ্ছেন সানন্দে। ভোটের মাঠে নেমে কত কী করতে হচ্ছে তাকে!
মামাবাড়িতেই বেশি আদর
সাকিবকে দারুণ স্বাগত জানিয়েছিল সাকিবের মামাবাড়ি আলোকদিয়া ইউনিয়ন। তাকে দেখতে ইউনিয়নের স্কুল মাঠের সমাবেশে ৩-৪ হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন। একই গ্রাম থেকে ফেরার পথে একটি মাদ্রাসায় মাগরিবের নামাজের বিরতি নিয়েছিলেন। সেখানে তাকে দেখতে শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, আশেপাশের বাড়ির মহিলারাও ছুটে আসেন। গাড়ি থেকে বসে হাত মিলিয়ে সবার আবদার মিটিয়েছিলেন সাকিব।
নানা জনসভা শেষে মাগুরা শহরে ফিরতে সন্ধ্যা হয় সাকিবের গাড়ি বহরের। এরপর শহরের ভায়না মোড় থেকে রাস্তার যে কোন এক পাশের দোকান ধরে লিফলেট বিতরণ শুরু করেন। এভাবে প্রতি রাস্তায় কয়েক কিলোমিটার জুড়ে প্রতিদিন চলতো লিফলেট বিতরণ।
ভোটের মাঠে নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রচারণা শেষ করেছেন সাকিব আল হাসান। আগে মাঠে তিনি উইকেট নিতেন আর জেগে উঠতো সারা দেশ। জয়ধ্বনি হতো তার নামে। কিন্তু ভোটের হিসাব অন্য। সেই জয়ধ্বনি করা মানুষদের কাছে গিয়ে ভোট প্রার্থনা করতে হচ্ছে ক্রিকেট তারকাকে।