সেনাশাসনে থাকা মিয়ানমারে উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কাছে একের পর এক এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে সরকারি বাহিনি। প্রতিবেশি দেশের এই গৃহযুদ্ধের আঁচ বাংলাদেশও টের পাচ্ছে। সীমান্ত পেরিয়ে আসছে বুলেট-গোলা, তাতে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। মিয়ানমার থেকে আসা ১৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গার ভার বাংলাদেশ বহন করছে বছরের পর বছর। সেখানে নতুন সংঘাতে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে সীমান্তে। এই পরিস্থিতি কতটা উদ্বেগের, বাংলাদেশের এখন করার কী রয়েছে, তা নিয়ে সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে কথা বলেছেন দ্য সেন্টার ফর বাংলাদেশ অ্যান্ড গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের (সিবিজিএ) প্রধান গবেষক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মো. শামসুদ্দীন।
প্রশ্ন : মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি কেমন দেখছেন?
হাসান মো. শামসুদ্দীন : ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক শাসক ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে মিয়ানমারের পরিস্থিতি অস্থির। এর আগেও মিয়ানমারে এরকম অস্থিরতা ছিল। তারপরও মিয়ানমার সেনাবাহিনী যেহেতু বামার ডমিনেটেড এবং তারাই যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেই বামাররাই মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে সাপোর্ট দিয়ে আসছিল।
এছাড়া সেনাবাহিনীকে আরেকটা গ্রুপ সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছিল, সেই গ্রুপটি হলো কট্টর বৌদ্ধ সংস্থা গ্রুপ। ২০২১ সালে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের পর সেই বৌদ্ধদের একাংশ সেনাবাহিনীর ওপর থেকে সমর্থন সরিয়ে নিয়েছে।
বামার জনগোষ্ঠির যে যুবকরা, যারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে নিয়মিত যোগদান করত, সেনাবাহিনীর জনবল স্বল্পতা পূরণ করত, ওরা এই বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। ওই যুবকরা সেখান থেকে চলে গেছে পাহাড়ে অর্থাৎ সীমান্ত এলাকায়। সেখানে তারা পিডিএফে (বিদ্রোহীদের মোর্চা) যোগদান করেছে। পরে তারা নিজেরাই জান্তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
অর্থাৎ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর যে জনসমর্থন ছিল, সেটা এখন আর তাদের নেই। মিয়ানমার জান্তা পূর্বে দমনপীড়নের মাধ্যমে যে নিয়ন্ত্রণ আনতে, এবার সেই কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে সারা মিয়ানমারেই একটা বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে এবং সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে বেশ কিছুদিন ধরে।
মিয়ানমার স্বাধীন হয়েছে বহু আগে, কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দিতে এসে মিয়ানমারের জনগণ প্রথম গণতন্ত্রের স্বাদ পেয়েছে। এই স্বাদ পাওয়ার পরই তাদের মধ্যে বিদ্রোহী মনোভাব গড়ে উঠেছে।
সর্বশেষ যে ধাক্কাটা লেগেছে, সেটা হলো গত অক্টোবরে। বিদ্রোহী গ্রুপগুলো থ্রি ব্রাদারহুড কোয়ালিশন বা ‘থ্রিবিএইচএ’ গঠনের পর যখন একসঙ্গে মিয়ানমারের চারদিকে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পগুলোতে আক্রমণ চালাল, তখনই কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দিশেহারা হয়ে গেলো। একে তো তাদের বামারদের সমর্থন চলে গেছে, ছাত্রদের সমর্থন চলে গেছে, যারা সেনাবাহিনীকে জনবল সরবরাহ করত। এরপর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সমর্থন চলে গেছে। এরপর ক্ষুদ্র যে বিদ্রোহী গ্রুপগুলো সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত, তাদের মধ্যে একতার যে অভাব ছিল, তারা সেটা দূর করে একীভূত হলো।
প্রশ্ন : সেখানে চীন ও ভারতের ভূমিকা কী দেখছেন?
হাসান মো. শামসুদ্দীন : সবকিছু মিলিয়ে জান্তা এমন একটা অবস্থায় পড়েছে যে তাদের আর কিছুই করার নেই। এই সংঘর্ষের ইফেক্ট প্রথম চীন সীমান্ত থেকে শুরু হয়েছে। সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর কিছু মানুষ চীনের ভেতরেও পালিয়ে গিয়েছিল। এরপর শুরু হয়েছে ভারতে। ভারতের মিজোরামেও কিছু মানুষ চলে গিয়েছিল। এমনকি মিয়ানমার সেনাবহিনী ও সীমান্তরক্ষীদের কিছু সদস্যও মিজোরামে চলে গিয়েছিল, পরবর্তীতে ভারত আবার বিমানযোগে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠায়। থাইল্যান্ড সীমান্তেও একই ঘটনা ঘটেছে। থাইল্যান্ডের মাইসটে শরণার্থী শিবিরে বহুবছর ধরে শরণার্থীরা আছে।
অর্থাৎ মিয়ানমারের প্রতিবেশী যেসব দেশ চীন, ভারত, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশও প্রত্যক্ষভাবে এই সমস্যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তবে এই অবস্থা মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার, কারণ তারা গণতন্ত্র চায়, তারা সামরিক শাসনের অবসান চায়। তারা স্বাধীন মিয়ানমারে নিঃশ্বাস নিতে চায়। এজনই তারা সংগ্রাম করে যাচ্ছে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।
এখন নিশ্চয়ই তারা সমর্থন পাচ্ছে কারও। একটি বড় সমর্থন পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের। এতে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে মদদ আছে চীনের। এরপর ভারতের মিজোরামে একটা গণ্ডগোল লেগে গেল। আগে মিয়ানমারের সঙ্গে মিজোরামের চমৎকার একটা যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল, মিয়ানমারের নাগরিকরা খুব সহজেই ভারতে যাতায়াত করতে পারত। এবিষয়ে ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তিও ছিল। কিন্তু মিজোরামের গণ্ডগোলের পর ভারত সেই চুক্তি বাতিল করে দিয়েছে। এছাড়াও ভারত মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারের নাগরিকরা সেটা পছন্দ করছে না।
এতদিন ধরে বাংলাদেশই একমাত্র রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে ভোগান্তিতে ছিল। ২০২২ সালে মিয়ানমার সীমান্তে সংঘর্ষের কারণে বাংলাদেশে গোলা এসে পড়েছিল। আমার মনে হয় সেসময় ভারত ও চীন তেমন একটা ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। এবার ভারত এবং চীন উভয় দেশই সমস্যাগ্রস্ত হয়েছে। এবং তারা চেষ্টা করছে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে। এছাড়াও থাইল্যান্ড আলাদাভাবে চেষ্টা করছে মানবিক কিছু বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আসার জন্য। চীন তাদের অর্থনৈতিক এবং ভুকৌশলগত অবস্থান নিরাপদ করার জন্য অবশ্যই রাখাইনে আসবে। ভারতেরও কিছু অর্থনৈতিক বিনিয়োগ মিয়ানমারে রয়েছে। তাই ভারতও চাইবে না মিয়ানমারে এ ধরনের অশান্ত পরিস্থিতি থাকুক। সুতরাং সবাই চাইবে মিয়ানমারে শান্তি ফিরে আসুক।
প্রশ্ন : বাংলাদেশ সীমান্তে এমন পরিস্থিতি কতদিন চলতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
হাসান মো. শামসুদ্দীন : মিয়ানমারের যে ধরনের সমস্যা, এই ধরনের সমস্যা সমাধানের কোনো ডেডলাইন দেওয়া যায় না। এখন মিয়ানমারের আর্মিকে যদি বাইরে থেকে সমর্থন দেওয়ার সুযোগ থাকে, তারা যদি নিজেদের আবার গুছিয়ে নিতে পারে, তাহলে এই সমস্যা অনেকদিন ধরে চলবে। একইসঙ্গে ‘থ্রিবিএইচ’ এরও একটি সক্ষমতার একটা বিষয় আছে যে তারা কতদিন এভাবে টেনে নিয়ে যেতে পারবে। তাই কেউ হিসেব করে বলতে পারবে না এমন পরিস্থিতি কতদিন চলতে পারে। এটা আক্রমণ ও প্রতি আক্রমণের ওপর ,উভয় পক্ষের অর্থনৈতিক ও অস্ত্রের জোগানের ওপর নির্ভর করে। এতদিন পর বিদ্রোহীরা যেহেতু একতা ও বেশি সক্ষমতা নিয়ে এগিয়ে এসেছে, তাই বলা চলে এটা আরও কিছুদিন চলবে।
প্রশ্ন : এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি কতটা?
হাসান মো. শামসুদ্দীন : রোহিঙ্গা আমাদের জন্য একটি সমস্যা। রোহিঙ্গাদের কারণে মাদক, মানবপাচার, অস্ত্র, সংঘর্ষের মতো সমস্যা চলছে আমাদের। এগুলো অবশ্যই বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এর পাশাপাশি যখন মিয়ানমারে অশান্ত পরিস্থিতি চলছে, এটা অবশ্যই আমাদের জন্য কিছুটা হুমকির সৃষ্টি করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ একটা অশান্ত প্রতিবেশী একটা শান্ত প্রতিবেশীর জন্য কিছুটা হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
প্রশ্ন : ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশের করণীয় কী?
হাসান মো. শামসুদ্দীন : আশা করি, বাংলাদেশ যে কোন ধরনের সমস্যা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। তবে এটা আশা করা যায় যে ও ধরণের সমস্যা বাংলাদেশের দিকে আসবে না। কারণ মিয়ানমার যখন বুঝতে পারবে এটা একটা ডেড রেঞ্জ, মিয়ানমার যখন বুঝতে পারবে বাংলাদেশ প্রস্তুত, তখন সে আর কিন্তু এখানে আসবে না।
আর বিদ্রোহী যারা আছে, ওরাও বাংলাদেশকে ডিস্টার্ব করবে না, কারণ ওরা যদি ক্ষমতায় যায়, বাংলাদেশই তাদের একমাত্র সাপোর্টের জায়গা হতে পারে। কারণ এখানেই বঙ্গপোসাগর রয়েছে, এখানেই কক্সবাজার রয়েছে, এখান থেকেই তারা চিকিৎসা, খাদ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি সব কিছুই তারা এখান থেকেই পেতে পারে, যেটা মূল মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের সম্ভব না। এটা তাদের যোগাযোগ এবং দুরত্বের কারণে খুবই ডিফিক্যাল্ট।
তাই আমার মনে হয় না, তারা বাংলাদেশের সঙ্গে কোনও সমস্যা সৃষ্টি করবে। উল্টো তাদেরই উচিৎ হবে, বাংলাদেশের সঙ্গে একটা ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা, ভবিষ্যতের জন্য, যদি তারা তাদের স্বপ্নের আরাকান বাস্তবায়ন করতে চায়।
প্রশ্ন : বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হবে কি না?
হাসান মো. শামসুদ্দীন : রোহিঙ্গা সংকট এরই মাঝে দীর্ঘমেয়াদি হয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে চীন চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত সেটা শুরু করা যায়নি। আর এখন তো পরিস্থিতি প্রচণ্ড রকমের অশান্ত। এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা কোনওভাবেই সম্ভব নয়।
প্রশ্ন : মিয়ানমার বাংলাদেশের ঘাড়ে যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে পারে কি না?
হাসান মো. শামসুদ্দীন : প্রতিটা যুদ্ধের একটা কারণ থাকে। ওই ধরনের কারণ এখনও সৃষ্টি হয়নি। আর এতগুলো ফ্রন্টে যুদ্ধ করার মতো সক্ষমতা মিয়ানমারের নেই। মিয়ানমার নিজেদের নাগরিকদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল এতদিন। আর পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য একটা প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। এখন ওরা নিজেরাই নিজেদের ঘর সামাল দিতে পারছে না। ওদের সীমান্তই এখন নিয়ন্ত্রণ করছে বিদ্রোহীরা। তাহলে সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধের চিন্তা করবে কীভাবে?
প্রশ্ন : আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ কী পদক্ষেপ চাইতে পারে?
হাসান মো. শামসুদ্দীন : বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদ জানিয়েছে। তাদের বিমান যেন কোনওভাবেই বাংলাদেশের আকাশ সীমায় না আসে, সে বিষয়ে হুঁশিয়ার করা হয়েছে। আশা করা যায়, এটা তারা করবেও না। আর বাংলাদেশে যেসব গোলা এসে পড়ছে, সেগুলো বিদ্রোহীদের বলে জানিয়েছে মিয়ানমার। তবে এর দায় অবশ্যই তাদের নিতে হবে। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ জাতিসংঘে যেতে পারে। এছাড়া বাংলাদেশে কাজ করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোকেও জানাতে পারে।