Beta
মঙ্গলবার, ২০ মে, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ২০ মে, ২০২৫

শশি ভূষণ পাল : বাংলার প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষার বিস্মৃত স্বপ্নদ্রষ্টা  

ছবির ফ্রেমে শশি ভূষণ পাল।
ছবির ফ্রেমে শশি ভূষণ পাল।
[publishpress_authors_box]

শশি ভূষণ পাল। বাংলাদেশের শিল্পকলায় পথিকৃৎ চিত্রশিল্পী, প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষার স্বপ্নদ্রষ্টা। তার উদ্যোগে এদেশের ভূ-সীমানায় প্রথম গড়ে উঠেছিল শিল্পশিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’।

তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের এই প্রতিষ্ঠান কালের পরিক্রমায় এখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট। কিন্তু শশির প্রচেষ্টায় গড়া পুরনো, জীর্ণ ভবনটির ধ্বংস ঠেকাতে নেই উদ্যোগ। গুণী এই শিল্পীও আজ বিস্মৃত।

শশির প্রচেষ্টায় গড়া পুরনো, জীর্ণ ভবনটির ধ্বংস ঠেকাতে নেই উদ্যোগ।

খুলনার মহেশ্বরপাশা গ্রামের পাল পাড়া। সেখানে ১৮৭৮ সালে জন্ম হয় শশির। পিতা শ্রীমন্ত পাল ছিলেন কবি ও শিল্পী। ছোট থেকেই শশির শিল্পকলার চর্চা মেলে। নেওয়া হয়নি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। তুলির আঁচড়ই তার জাত চেনায়। বড় হয়ে শিল্পশিক্ষার প্রসারের স্বপ্নে ছিলেন বিভোর।

শশি এঁকেছেন রাজদরবার, কীর্তিমান বাঙালী, সাধু-দরবেশ, ইংরেজ সাহেব ও দেশি বাঙালীর ছবি, ল্যান্টস্কেপ, যুদ্ধবিগ্রহ, মানুষের অবয়বসহ নানা ঘটনার প্রতিকৃতি।

তার চিত্রকর্মগুলো সাড়া ফেলে দেশে-বিদেশে। গ্লাসগো ও প্যারিসে প্রদর্শনের পর পুরস্কৃতও হয়। ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে মেলে ৪০টির বেশি স্বর্ণপদক, রৌপ্যপদক ও সম্মানসূচক প্রশংসাপত্র।

শশি ভূষণের চিত্রকর্ম।

১৯২৫ সালে তৎকালীন সরকার গুণী এই শিল্পীকে ‘রায় সাহেব’ উপাধিতে ভূষিত করেন। গভর্নমেন্ট হাউসে সনদটি তার হাতে তু্লে দেন লর্ড লিটন।

বর্তমান যশোর রোডের পূর্ব পাশে ১৯০৪ সালে শশি ভূষণ নিজ বাড়িতে ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’ নামে অঙ্কন বিদ্যাপীঠটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি জেলা বোর্ড ও সরকারি অনুদান পেতে শুরু করে।

১৯২৯ সালে বর্ধমানের মহারাজধিরাজের পৃষ্ঠপোষকতায় শশি ভূষণ পালের বাড়ির অন্যপাশে সরকারিভাবে এই ভবনটি নির্মাণ করা হয়। এখানেই ৪১ বছর অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন শশি ভূষণ পাল। সেই বিদ্যায়তনটি খুলনার গল্লামারী এলাকায় স্থানান্তরিত করে ১৯৮৩ সালে প্রথমে শশি ভূষণ আর্ট কলেজ, পরে খুলনা আর্ট কলেজে রূপান্তরিত হয়। ২০০৯ সালে সেটি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মীকৃত হয়ে চারুকলা ইনস্টিটিউট হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ২০১৮ সালে এটি চারুকলা অনুষদ হয়।

১৯৮০ সালে এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় একটি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৯৯১ সালে সেখানে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করা হয়। ওই দুটি প্রতিষ্ঠানসহ বর্তমানে এখানে রয়েছে তিনটি প্রতিষ্ঠান। আর পরিত্যক্ত ভবনটিতে প্রথমে শিক্ষার্থীদের পাঠ দান করা হলেও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠায় তা বন্ধ করা হয়।

২০১৬ সাল থেকে শুরু হয় অপসারণ প্রক্রিয়া। ২০২১ সালে ভবনটি অপসারণের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়। সে সময় সাংস্কৃতিক কর্মীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে অপসারণ প্রক্রিয়া বন্ধ হলেও। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংস হচ্ছে শশীর ভবন।

বিস্মৃতিতে চলে যাওয়া শশি ভূষণ পালকে ধারণ করতে পারেনি তারই প্রতিষ্ঠিত ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’ এর বর্তমান রূপ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট। নিজস্ব ভবনের অভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে না তার আঁকা ছবিগুলো। তার সংগ্রহে থাকা কষ্টি পাথরগুলো দেওয়া হয়েছে বিভাগীয় জাদুঘরে। তবে চারুকলা ইনস্টিটিউটের নতুন ভবন আশা জাগাচ্ছে পূর্ণাঙ্গ শশি ভূষণ আর্ট গ্যালারির, যা সবার জন্য তুলে ধরবে শশীকে।  

প্রথম বারের মতো চিত্রশিল্পী শশি ভূষণ পালের জন্মবার্ষিকীতে শশিমেলা আয়োজন করা হয়েছে

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট খুলনার সভাপতি হুমায়ুন কবীর ববির সঙ্গে কথা হয় সকাল সন্ধ্যার। তিনি বলেন, ‘‘ইতিমধ্যে ওখানে উন্নয়নের নামে স্কুলের ভবন তৈরি কাজ শুরু করা হয়। সেই ভবন তৈরি করার কাজের সময় অত্যন্ত সুকৌশলে সেই (পুরোনো) ভবনটির পিছনের অংশটি ভেঙে ফেলা হয়।

‘‘যদিও প্রশ্ন করা হলে দাবি করা হয়, মাটির টানে ভেঙে গেছে। এবং পরবর্তীতে আমরা পর্যবেক্ষণ করি, যতটুকু দেখেছি, এখনও ইচ্ছে করলে, কর্তৃপক্ষ যদি চান, এটা সংরক্ষণ করা সম্ভব।”

শশির প্রচেষ্টায় গড়া শিল্পকলা ভবন টেকাতে উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এটি সংরক্ষণ করা আমাদের এই অঞ্চলের শুধু নয়, বাংলাদেশের শিল্পকলা- চারু শিল্পকলার ক্ষেত্রে বড় ইতিহাস হয়ে থাকবে, যা হয়তো বহুদিন টিকে থাকবে।

“এবং আমাদের অনুপ্রাণিত করবে শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে। এমন একজন শিল্পী যিনি ওইসময় যখন এখানে লেখাপড়াই শুরু হয়নি তেমন, তখন তিনি চারুকলার মতো একটি বিষয়কে শিক্ষার অংশ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। এবং তার জন্য তিনি নিরন্তরভাবে কাজ করে গেছেন।”

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন ড. নিহার রঞ্জন সিংহ বলেন, দেরিতে হলেও শশি ভূষণ পালকে নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের গবেষণা করার সুযোগ করে দিচ্ছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। এ বছর প্রথমবারের মতো গুণী এই চিত্রশিল্পীর জন্মবার্ষিকীতে আয়োজন করা হয়েছে ‘শশিমেলা’র। সেখানে তাকে নিয়ে গবেষণা করার জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের দেওয়া হচ্ছে এককালীন বৃত্তি।

নিহার রঞ্জন সিংহ বলেন, “এটার যোগসূত্র বা কন্টিনিউইটি রাখতে গেলে একটা স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রয়োজন। তবে দুর্ভাগ্য যে সেটা এখানে কখনও ছিল না। এখন আমরা নিজস্ব জায়গা বরাদ্দ পাওয়ায় চারুকলা অনুষদের কাজ এগিয়ে নিতে পারব।”

তবে তিনি জানান, প্রথমবারের মতো শশি ভূষণ পদক দেওয়া হলো একুশেপদকপ্রাপ্ত চিত্র শিল্পী অধ্যাপক জামাল উদ্দিন আহমেদকে। নতুন প্রজন্মের কাছে শশি ভূষণ পালকে তুলে ধরার জন্য এই আয়োজন বলছে তারা।

শশিমেলার আহ্বায়ক মো. তরিকত ইসলাম বলেন, “বিস্মৃতিতে চলে গেছেন শশি ভূষণ পাল। আমরা তাকে তুলে ধরতে চাই। নতুন প্রজন্ম সেইভাবে জানে না। শশি ভূষণ পালকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরতে চাই আমরা। তাই প্রথম বারের মতো মেলা আয়োজন করা হলো।”

অতীতকে মুছে ফেলে সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়া যায় না মন্তব্য করে তিনি বলেন, এজন্য গবেষণাসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া দরকার, পাশাপাশি তার প্রতিষ্ঠিত ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’ ও তার চিত্রকর্ম সংরক্ষণ করতে হবে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত