Beta
রবিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
রবিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫

উত্তম ঋত্বিক ভানু : তিন মহারথী এক শাশ্বতে

উত্তম ঋত্বিক ভানু : তিন মহারথী এক শাশ্বতে
[publishpress_authors_box]

আপনাকে বাংলাদেশে স্বাগতম। এটা তো আপনার প্রথমবার বাংলাদেশে আসা?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: হ্যাঁ, শুনতে খুবই বিস্ময়ের ব্যাপারটা, এতো বছরে এই প্রথমবার বাংলাদেশে আসা!

কেমন লাগছে বাংলাদেশের মানুষ?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: খুবই আন্তরিক মানুষজন। মানে আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে … যা ফেইস করে আসছি এখন অব্দি… প্রত্যেকেই খুবই মুক্ত হস্তে…মানে… গ্রহণ করেছেন আমাকে এবং খুবই উচ্ছ্বসিত। তো খুবই ভালো লাগছে। 

গুলমোহর’ ওয়েব সিরিজে আপনার চরিত্রটি কেমন লেগেছে?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: খুবই ইন্টারেস্টিং চরিত্র। চরিত্রটার বিল্ডআপটাই খুব রহস্যজনকভাবে করা। কে এই লোকটা? কেন এই লোকটা? সবই শেষে গিয়ে বোঝা যায়। এবং যদিও খুব কম সময়ের জন্য সে আসে কিন্তু অত্যন্ত ইমপ্যাক্টফুল। যে কারণে আমাকে অনিন্দ্য ব্যানার্জি, এখন চরকি যে প্ল্যাটফর্মটা তার ক্রিয়েটিভ হেড, অনিন্দ্য আমার বহুদিনের বন্ধু । মানে আমার প্রথম মেগা সিরিয়াল রূপকথা যখন করি তখন যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে ও প্রোডাকশন ম্যানেজার হয়ে ঢুকলো ইন্ডাস্ট্রিতে।

সেই সময় থেকে অনিন্দ্যর সঙ্গে আলাপ, বহু বছর ধরে কাজ করেছি। তো অনিন্দ্য আমায় ফোনে বলে যে এরাও চাইছেন খুব … পরিচালকও চাইছেন । তারপরে এই কথাবার্তা হতে হতে … ভিসাটাই যা একটু আটকে যাচ্ছিলো … হ্যাঁ! তারপর শেষে পেলাম। এবং প্রথম এই বাংলাদেশে আসা গুলমোহরের সুবাদে।

কাজ করে কেমন লাগছে?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: ভীষণ আন্তরিক এবং প্রচণ্ড পাংচুয়াল সব কিছু এবং সবাই কিন্তু কাজের মধ্যে আছে। মানে লোকবল কম, অর্থ কম, কিন্তু একটা সদিচ্ছা আছে যে একটা এমন কিছু তৈরি করবো, যেটা মানুষ দেখে বলবে ‘বাহ!’ এইটা খুব জরুরি। যে কোনও প্রোডাক্ট- শিল্পের ক্ষেত্রে যে কোনও শিল্পীর মানে একটা কাজ যদি নিজেই এপ্রিশিয়েট করতে না পারে, তাহলে বাইরের লোকের থেকে এপ্রিসিয়েশন পাওয়াটা খুব মুশকিল হয়। ওই যে অনেকটা ওই ফরমায়েশি লেখার মতো।

এখানকার খাবারদার কেমন লাগছে?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: একটু বেশিই। খাওয়াদাওয়ার থেকে ভয় আমাকে আগেই দেখিয়ে দিয়েছিল অনেকে। বাংলাদেশে যখন আসি তার আগেই আমায় অনেকেই বলেছিল, সাবধানে খাস কিন্তু! উনারা বড্ড খাওয়ান। হ্যাঁ, দাওয়াতের একটা ভয় দেখিয়ে পাঠিয়েছিল আমাকে।

রান্না কাছাকাছি; খুব তফাৎ নেই। এখানে যেগুলো নতুন সেগুলো হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ভর্তা। পশ্চিমবঙ্গে ওই চলটা নেই। বিভিন্ন ধরনের ভর্তা। মানে ধনেপাতার ভর্তা, চিংড়ি মাছ ভর্তা, কত রকমের ভর্তা।

মাওয়া গিয়ে কেমন লাগলো?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: মাওয়া জায়গাটা ভীষণ ভালো লাগলো এবং লাকিলি আমরা যখন গেছি তখন ওই তো বর্ষা। জল এবং পদ্মার যা তেজ দেখলাম, ওর উপরে নৌকো নিয়ে যাওয়া।

ওই জিনিসটা খুব ভালো লাগলো, ইলিশটা বেছে নিয়ে তারপর সেটাই রান্না করানো। আগে ইলিশটা দেখে নিয়ে সেটা কিনে তারপর রান্না করে … মজা হয়েছে খুব। 

সেখানেও প্রচুর লোক মানে প্রায় সবাই এসে এসে ছবি তুলছেন! বাংলাদেশে এতো মানুষ আমাকে চিনবেন আমি সত্যি এক্সপেক্ট করিনি। কারণ সিনেমা তো আসে না এখানে। টেলিভিশনের মাধ্যমে মানে শুধু টেলিভিশনটা কতটা পাওয়ারফুল একটা মিডিয়া।

প্রথমবার বাংলাদেশে কাজ করতে এসেছেন, এখানকার কোন ছবি বা ওয়েব সিরিজ কি দেখা হয়েছে?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: সত্যি কথা বলতে কি আমার দেখা হয়নি, কিন্তু হইচইতে আছে। আমি এবারে গিয়ে দেখবো ডেফিনিটলি।

আমি যখন ছোট ছিলাম তখন খুব বাংলাদেশের নাটক দেখতাম। আমাদের ওই টেলিভিশন অ্যান্টেনা বুস্টার লাগিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। আমরা ওই ঘোরাচ্ছি …হলো? হ্যাঁ এসেছে ঝিরঝির করছে। আরেকটু ঘোরাক (হাসি)।

তখন খুব থিয়েটার হতো টেলিভিশনে (বিটিভিতে)। টেলিনাটক বা টেলিড্রামা কিছু একটা বলা হতো। সেগুলো প্রচুর দেখেছি ।   

আলাপচারিতায় শাশ্বত চট্টপাধ্যায়

আমরা আপনার পুরনো দিনের দিকে যদি একটু যাই। তো আমাদের জানা মতে ১৯৭০-এ আপনার জন্ম।

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: আমার জন্ম বালি, ওই মানে আমাদের আদি বাড়ি হচ্ছে হাওড়া। ওদিকটা হাওড়া, লিলুয়া, বেলুড়, বালি… ওই বালিতে বাবাদের আদি বাড়ি ছিল। তা আমার জন্মটা হয়েছে একচুয়ালি কলকাতা শহরেই, মেডিকেল কলেজে। বাবা ওখানকারই ডাক্তার ছিলেন। তো ওখানেই আমার জন্ম হয়।

১৯৭০ এ আপনার জন্ম। আর উত্তম কুমার চলে গেলেন …

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: আশি (১৯৮০)।

তখন আপনার বয়স ১০ বছর। ততদিনে সম্পর্কে আপনি তাকে জ্যাঠা হিসেবে বিবেচনা করেন।

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: হ্যাঁ, খুব অদ্ভুত! আমার মায়ের তরফে উনি আবার আমার মায়ের কোনোভাবে মেসো মশাই, দূরসম্পর্কের। এদিকে বাবার (কাছে একদম) দাদার মতো। কাজেই আমার কাছে একদিকে জেঠু আবার আরেকদিকে দাদু।

উত্তম কুমারকে নিয়ে কোনও স্মৃতি?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: প্রথমবার আমি শুটিং দেখতে যাই উনার বাড়ি। উনার একটি ছবি ‘নিধিরাম সর্দার’। শেষের দিকের একটি ছবি। তো শুটিং দেখার কিছু মুহূর্ত আছে। মেকআপ রুমে কিছু…বাবাদের আড্ডার মুহূর্ত, চোখে ভাসে এখন।

তারপরে ওই সোমাদির বিয়েতে গিয়েছিলাম; সুপ্রিয়া দেবীর মেয়ে। সোমাদির বিয়েতে তখন উনি খুব চিন্তিত ছিলেন। ওই ‘ছোটি সি মুলাকাত’ হয়ে গেছে। একটা ডিজাস্টার হয়েছে। খুবই অন্ধকারে একা একা পায়চারি করছিলেন দেখেছি।

তারপর যেটা দেখলাম, মানে তখনও উনি আমার কাছে উত্তম জেঠু। বাবাও শুটিং করেন। উনিও শুটিং করেন। সিনেমায় অভিনয় করেন; যেসব ছবি আমার দেখা হয়নি। আমি প্রথমে আসলে উত্তম কুমার কী জানতে পারলাম যেদিন উনার দেহটা নিয়ে রাস্তায় লরিটা বেরোল। যতদূর দৃষ্টি গেছে, কোথাও রাস্তাঘাট দেখা যায়নি। 

লক্ষ লক্ষ মানুষ?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: হ্যাঁ। বজবজ লাইনে ট্রেন বন্ধ হয়ে গেছে এবং কোনও বারান্দা কোনও ছাদ খালি নেই। রাস্তায় কোনও গাড়ি চলছে না।

তারপরে আস্তে আস্তে দূরদর্শনে, তখন আমাদের একটাই তো চ্যানেল ছিল, ছবিগুলো দেখতে আরম্ভ করলাম আর বুঝলাম যে কী। এখনও পুরোটা বুঝে উঠতে পারিনি উনি কী!

সেই এক্সপেরিয়েন্সটা কি আপনাকে অচেনা উত্তম’ হতে কোনোভাবে সাহায্য করেছে?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: ডেফিনিটলি সাহায্য করেছে। মানে আমি এতো দেখেছি উনাকে এবং এখনও দেখি। উনি চলে গেছেন চুয়াল্লিশ বছর হয়ে গেছে। আমরা কেউ ভাবতে পারি না পশ্চিমবঙ্গে যে উনি নেই।

এমনই উনার প্রভাব!

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: এখনও । মানে চোখ বন্ধ করলে একটাই ইমেজ আসে মাথায়। তো এতটাই তার ইনফ্লুয়েন্স ছিল অন স্ক্রিন।মানে সেটা শুধু অভিনয় দিয়ে করা যায় না। ওটা একটা ম্যাজিকাল কিছু থাকতে হয় ভেতরে।

যখন আপনি ‘অচেনা উত্তম’ করতে গেলেন তখন কি আপনার ওই ভয়টা কাজ করেনি?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: না! প্রথমে তো আমি করতে চাইনি, ফ্র্যাংকলি স্পিকিং। কিন্তু ডিরেক্টর এবং প্রডিউসার দুজনে মিলে এমন ভাবে ধরলেন তখন আমি ডিসাইড করলাম যে করবো। নইলে অন্য কাউকে দিয়ে করাবে! সে হয়তো আমার মতো পারবে না। কারণ আমার থেকে বড় ফ্যান খুব কম আছে। 

মানে, আমি যেটা প্রথমেই ঠিক করে নিয়েছিলাম যে উনার মতো দেখতে আমাকে কখনই লাগবে না অন স্ক্রিন (তাহলে) আমায় কী দিয়ে পার করতে হবে? অ্যাটিটিউড দিয়ে। 

কোন সিনে কোন অ্যাটিট্যুড এবং উনার কিছু কিছু ম্যানারিজম। সেইগুলো কোথায় কোথায় দেওয়া যায়, এইভাবেই করেছিলাম। তারপর আর ভাবিনি।

কিন্তু অন স্ক্রিন আপনাকে বহু জায়গায় উত্তম কুমারের মতোই লেগেছে। 

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: সেটা মানে হয়তো ওই অ্যাটিটিউডটা বা কোনও একটা অ্যাঙ্গেল ধরা, যেটা কনশাসলি আমরা করেছি। মানে সেটা … (কাঁধ ঝাঁকিয়ে) জানি না কী!

কিন্তু আপনি যখন প্রথম এটার রাশ দেখলেন বা প্রিমিয়ার দেখলেন, তখন আপনার কি কোনও রিগ্রেট হয়েছে মানে খেদ আছে কি না?  

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: না, কোনও খেদ নেই। আমি কোনও কাজ যখন করে ফেলি, তারপর আর কোনও খেদ থাকে না। কারণ সেটা আমার ইচ্ছে তো আমি কাজটা করেছি। তারপর খেদ করে তো লাভ নেই। আর আমার একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে আমি না, যখন কোনও কাজ করি, তখন হানড্রেড কেন দু হানড্রেড পারসেন্ট সেটার সঙ্গে থাকি। কাজটা শেষ হয়ে গেলে ওটা আমি ভুলে যাবার চেষ্টা করি। 

যদি ভুল না করে থাকি তাহলে হচ্ছে ঋত্বিক ঘটক, উত্তম কুমার এবং আসছে যেটা …।

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরে। সেটা আবার ভানু জেঠুর ফ্যামিলির ইচ্ছেতেই আমাকে নিয়ে করা হয়েছে। এবং উনারা বহুদিন থেকে বলে যাচ্ছেন আমাকে, যে যদি কোনোদিন বাবাকে নিয়ে কেউ কোনও সিনেমা করে তাহলে তুমি কোরো কিন্তু ওটা।

‘যমালয়ে জীবন্ত ভানু’ সিনেমায় শাশ্বত

সেটা তো আপনার অ্যাপিয়ারেন্স, আপনার কমিক প্রেজেন্স, খানিকটা চেহারার আদল… ভানু বাবুর ছেলে হিসেবে আপনাকে বিবেচনা করেছে।

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: (হাসতে হাসতে) সেটা আমি জানি না। কিন্তু, সেইটা ওদের একটা অদ্ভুত ইচ্ছে ছিল এবং যে কারণে কাজটা যখন করতে যাই তখন এই কাজটা নিয়ে আমার অনেক বেশি টেনশন ছিল। কারণ তার ছেলেমেয়েরা এখনও জীবিত। এবং তাদের ইচ্ছে যে আমি এটা করি। এখানে যদি আমি খারাপ করি বা কোনোভাবে অসম্মান করা হয় উনাকে সেটা আমার দেখার খুব দরকার ছিল। কিন্তু না, কৃষ্ণেন্দু (‘যমালয়ে জীবন্ত ভানু’ এর নির্মাতা ) যে ডিরেক্ট করেছে এবং যে স্ক্রিপ্ট এবং রিসার্চ করেছে, খুব সুন্দর একটা গল্প ও ভেবেছে যেটা খুবই আনন্দ দেবে বলে আমার ধারণা। এটার সঙ্গে কিন্তু ‘যমালয়ে জীবন্তু ভানু’র কোনও মিল নেই।  

এটা একদম একটি মর্ডান গল্প। এখন স্বর্গও খুব মর্ডান হয়ে গেছে। স্বর্গে সেল ফোন এসে গেছে (হাসি)।

ঋত্বিক ঘটককে কিন্তু মানুষ অন স্ক্রিন দেখে নাই।

শ্বাশত চট্টোপাধ্যায়: যারা (ঋত্বিক ঘটককে) চেনেন তারা দেখেছেন এবং তাদের কাছ থেকে কিন্তু আমি প্রচণ্ড ভালোবাসা পেয়েছি। এবং তারা আমাকে জানিয়েছেন ফোন করে। যেমন আমাদের নির্মল কুমার। এখনও, মানে উনি ওই বয়সে গিয়েও উনি হলে গেছেন দেখতে। উনার মেয়ে নিয়ে গিয়েছিল মাধু আন্টিকে এবং নির্মল জেঠুকে। দুজনে মিলে দেখেছেন মেয়ের সঙ্গে ছবি। আমাকে ফোন করেছেন, জানিয়েছেন। এবং মাধবী মুখোপাধ্যায় বলেছেন আমাকে,  ”আমার ভালো লেগেছে মানে বুঝতে পারছিস? আমি লোকটাকে চিনতাম।” এবং আমাদের মানিক জেঠুর (সত্যজিৎ রায়) যিনি ফটোগ্রাফার ছিলেন, নিমাই বাবু। একদিন একটা ফোন আসে। “আপনি শ্বাশত বলছেন?” আমি বলছি, হ্যাঁ। “অধমের নাম নিমাই ঘোষ। আমি মানিকদার সঙ্গে।” হ্যাঁ, বলুন বলুন বলুন। “না, আমি মেঘে ঢাকা তারা দেখেছি। আমার দুটো দিন সময় লাগলো আপনাকে ফোন করতে।”    

এতোটাই মুগ্ধ ?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: (মাথা নেড়ে) “আমি দুটো দিন ভেবেছি।” মানে এর থেকে বড় পাওনা তো হতে পারে না। কোনও পুরস্কারই এর থেকে বড় হতে পারে না। 

আমি একটি খবরের কাগজে পড়লাম, আমাদের সুভাষ ঘাই (বলিউড ফিল্ম নির্মাতা) মহাশয় লিখেছেন যে, “আই কুড সি ঋত্বিকদা অন স্ক্রিন ।” কিন্তু মজার কথা হচ্ছে আই কুড… আই ডিডন্ট সি হিম।

আমি খালি ওই ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’টা দেখেছি; যাতে উনি অভিনয় করেছিলেন। উনারই ছবি। একটা মাত্র ছবি। 

আরেকটা ইন্টারভিউ ছিল রামকিঙ্কর বেইজকে নিয়ে; সেখানে একবারের জন্য ঢুকে পড়েছিলেন ভেতরে। ওইটুকু আমার স্মৃতি। আর কিচ্ছু জানি না।

মেঘে ঢাকা তারা’ সিনেমায় শাশ্বত

যদি আমি উত্তম কুমার এবং ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলি, উনাদের কমিক সেন্স, ডেলিভারি, টাইমিং… আপনি বোধহয় ওই ফ্ল্যাগটা বহন করে চলেছেন।

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: কারণ ওদের দেখেই তো বড় হয়েছি আমি। মানে আমি সিনেমা দেখতে শুরু করেছি তো ওদের ছবি মানে… সেখানে উত্তম কুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, তুলসী চক্রবর্তী, জহর রায় … কত নাম বলবো!

প্রত্যেকেরই কী টাইমিং! এখন লোকে উনাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কমেডিয়ান ছাপ দিয়ে দেয়। কিন্তু আমার তো মনে হয় যারা ভালো কমেডিয়ান তারা ভালো অ্যাক্টর। ভালো অ্যাক্টর ছাড়া ভালো কমেডিয়ান হতে পারে না।

সেটা তো বোধহয় যদি তোপসে (ফেলুদা), অজিত (ব্যোমকেশ) বাদ দেই, আপনার অভিনীত চরিত্র যেগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তারমধ্যে ওই ব্যাপারটা তো আসল, পাঞ্চ লাইন, কমিক টাইমিং।

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: হ্যাঁ, মানে ‘যেখানে ভুতের ভয়’ যেটা সন্দ্বীপ রায়ের, তাতে আমার নিজেরও দেখে মনে হয়েছে যে কয়েক জায়গায় ভানুর একটু ইনফ্লুয়েন্স আছে আমার অভিনয়ে।

ওই যখন পরাণদা ভূত হয়ে আসে প্রথমবার। তাকানো, ভয় পাওয়া … ওগুলো আনকনশাসলি চলে আসে। কিছু কিছু মানুষ কিছু কিছু জিনিস করে গেছেন যেটার বাইরে গিয়ে ভাবাটা খুব ডিফিকাল্ট। মানে এটা উত্তম কুমার কিন্তু বলেছিলেন যখন উনি ‘স্ত্রী’ করেন, আনকনশাসলি কোথাও ছবি বিশ্বাস উনার মধ্যে ঢুকেছিল… (হাসি) … যে ওর বাইরে যাওয়া যায় না। জমিদার করতে গেলে ওর বাইরে যাওয়া যায় না… (হাসি)। মানে সেগুলো কিছু জিনিস থাকে।

শাশ্বত ও পরাণ বন্দোপাধ্যায়। ‘যেখানে ভূতের ভয়’ সিনেমার সেটে।

সর্ব ভারতীয় দর্শক আপনাকে রিকগনাইজ করলো প্রথম ‘কাহানিতে’, বব বিশ্বাস চরিত্রে। এবং তারপরে বব বিশ্বাসের মতো অফার আসতে শুরু করলো আর আপনি সযত্নে সেগুলোকে এড়িয়ে গিয়েছেন। কেন?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: আমার পয়েন্টটা ছিল যে আমার তো চিরকালই লক্ষ্য বিভিন্ন ধরনের চরিত্র করবো; যেটা আমায় বাংলা দিচ্ছিল তখন। বাংলায় অনেক ভ্যারাইটি চরিত্র পেয়েছি যেটা অনেকের কাছেই যায়নি, অফার তারা পাননি। আমি পাচ্ছিলাম। তো আমায় যদি হিন্দি ছবির জগতে একটা কিছু মার্ক রেখে যেতে হয় তাহলে সব ছবিতে থাকলে চলবে না।   

আমায় একই কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন রণবীর কাপুর; প্রথম যেদিন দেখা হয় ‘জগ্গা জাসুস’-এর সেটে। “দাদা, আপকো চার সাল লাগ গেয়া দুসরা হিন্দি ফিল্ম পানে মে?” আমি বললাম, “নেহি, ম্যায় কিয়া নেহি…কুছ।” কুছ কিয়া নেহি বিকজ আই ডিডন্ট লাইক দেম। আর কিছু ডেট দিতে পারিনি কারণ আমার বাংলায় কমিটমেন্ট ছিল। 

‘কাহানি’ এর বব বিশ্বাস

আপনি যখন শবরের চরিত্র করলেন, যেটা একদমই আধুনিক গোয়েন্দা। বর্তমান সময়ের পুলিশ। এবং যিনি ব্যোমকেশ নন, ফেলুদা নন, কিরিটি নন। সেইখানে কিন্তু আপনি আপনার কমিক টাইমিংটাকে

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: হ্যাঁ। সেটা খুব প্লেইন… পোকার ফেস (নির্বিকারভাবে)। (শবর) হাসানোর চেষ্টা করে না। যা বলার গম্ভীরভাবে বলে দেয়। তাতে করে মজাটা অনেক বেশি পাওয়া যায়।

সেটা প্রলয়ের ক্ষেত্রেও।

শ্বাশত চট্টোপাধ্যায়: প্রলয় আবার প্রচণ্ড এক্সপ্রেসিভ। তার প্রচুর এক্সপ্রেশন। কিন্তু শবরের এক্সপ্রেশন খুব কম কিন্তু!

আপনার কী মনে হয়? মানে আপনি এখন ওটিটিতেও সমানে কাজ করছেন। প্রলয়ের পরে সেটা আবার প্রলয় এলো এবং সেটা ওটিটিতে চললো। ওটিটি এসে সিনেমা-সিরিজে যে ভেদ রেখাটা দশ বছর আগেও ছিল সেটাকে অনেকটাই মুছে দিয়েছে। আপনার কাছে এখন ব্যাপারটা কেমন লাগে?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: অনেক বেশি এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করা যায় ওটিটিতে। কারণ ওটিটিতে ওই আমি জানি একটা কোথাও এটা রিলিজ হবে, এটা এই প্ল্যাটফর্মের জন্য তৈরি করা। এবং সেখানে অতো টাকার রিস্ক নেই যে হলে গেলে সেটা মানুষ যাবেন কি না দেখতে? এই অনিশ্চয়তার ব্যাপারটা কম। তো কাজেই বিভিন্ন ধরনের সাবজেক্ট নিয়ে কাজ করা যায়।

‘এবার শবর’

এবং ওটিটির একটা সুবিধা হচ্ছে, আমার যে কাজটা ভালো লাগলো সেটা আমি আমার নিজের সময় অনুযায়ী দেখে নিতে পারবো; সময় এবং জায়গা অনুযায়ী। যেটা ফিল্মে হবে না। আর এখন মালটিপ্লেক্স কালচারে আমার যে ছবিটা ভালো লাগছে, সেটা হঠাৎ করে সকাল ন’টার একটা শো দিয়ে দিলো। সকাল ন’টায় আমি যেতে পারবো না সিনেমা হলে। বা এখন আর সেই দিন নেই যে আমি রাত্তির দশটার শো-য়ে যাবো। আমার কনভিনিয়েন্ট টাইম অনুযায়ী, এই যে একটা ভালো জিনিস আমি পেয়েছি এই প্ল্যাটফর্মে আছে, আমি আমার সময় মতো দেখে নেবো।

একটু পেছনে যাই। আপনি পরে আর থিয়েটারটা কেন করলেন না?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: আমি প্রথমে থিয়েটারে গিয়েছিলাম, কারণ আমি (চেয়েছিলাম) প্রফেশনাল অ্যাকটর হবো। সেটা বাবা বুঝতেন যে ও কিন্তু অ্যাকটিংটাকে প্রফেশন হিসেবে নেবে। কাজেই আমি কিন্তু থিয়েটার গ্রুপটা ছেড়েছিলাম থিয়েটার করার জন্যই। আমি বাবার নির্দেশনায় হাতি বাগানের আমাদের বিশ্বরূপা থিয়েটারে জয়েন করি। যেই নাটক বাবারা করেছিলেন ‘কালবৈশাখী’ বলে, সেটা পরে বাবা যখন নির্দেশনা দিলেন তখন বাবার রোলটা আমি করলাম। নাটকের নাম ছিল ‘বৈশাখী ঝড়’। এটা লিখেছিলেন বিরূ মুখোপাধ্যায়। অরিজিনাল গল্পটা হচ্ছে ‘অল মাই সানস, মানে যে বিদেশি গল্প …যে একটা ফ্লাইটের… কোনও ডিফেকটিভে ফ্লাইট ক্র্যাশ করে তাতে তার যে কোম্পানির মাল সাপ্লাই দিত তার বড় ছেলে মারা যায়। . এবং সেইটা নিয়ে থিয়েটারটা।  কিন্তু আস্তে আস্তে…।

মানে একটা মিশনের মতো করে হচ্ছে আপনি থিয়েটারে জয়েন করেন?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: হ্যাঁ। থিয়েটার দিয়ে শুরু আমি করব, এটা চিরকাল আমি জানতাম। থিয়েটারটা করলে একটা অদ্ভুত ডিসিপ্লিনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। যেটা কিন্তু খুব হেল্প করে ভবিষ্যতে।

প্রলয় সিনেমার শুটিংয়ে সহশিল্পীদের সঙ্গে শাশ্বত

আপনার বাবা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় । যদি আমরা বাংলা সিনেমার ইতিহাস ধরি তাহলে উত্তম এবং সৌমিত্রের পরে সুদর্শন নায়ক আর স্ক্রিন প্রেজেন্স আর সেই চার্মটা আছে যার, তিনি শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। তার ছেলে হওয়া…আমি যদি ইন্ডাস্ট্রির সমস্ত রকমের নেপোটিজমের কথা বলি বা অন্য যে কোনও জায়গা থেকে বলি… আপনাকে তো সেই অর্থে লঞ্চ করা হয় নাই ফিল্মে।

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: না, কখনোই না। আমরা যখন টেলিভিশনে লঞ্চড হয়েছিলাম তখন ফিল্মের যারা মাথা ছিলেন বা ডিরেক্টরস, তারা বলতেন যে টেলিভিশনে যাদের দেখা যায় তাদের দেখতে কেউ হলে যায় না।

সেটা আমাদের একটা কমন ধারণা ছিল।

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: হ্যাঁ, সে ধারণাটা এখন পাল্টে গেছে। সিনেমা যদি ভালো হয়, অভিনেতা-অভিনেত্রী যদি ভালো হয়, তাহলে মানুষ সিনেমা হলে যায়। সে ভাবনাটা তখন ছিল না। তখন একটা অদ্ভুত, ওই যে বললাম যবে থেকে শুরু হয়েছে যে এটা শহরের ছবি আর ওটা গ্রামের ছবি, তেমনি এটা শুরু করে দিয়েছিলেন যে এটা সিনেমা আর ওটা টেলিভিশন। কোনও মিডিয়ামকে তাচ্ছিল্য করতে নেই।

আজকে টেলিভিশনই তো আবার প্রবল বেগে ফিরে এসেছে। তো একটা ট্রানজিশনের মধ্য দিয়েই সেই যাওয়াটা। আপনার কি মনে হয় যে দেরি হলো কি না?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: আমি ভাবিইনি। সত্যি কথা বলতে কি, আমি আর কী চাই জীবনে কোনোদিন ভাবিনি। কাজেই আমার কাছে যা এসেছে সব বোনাস। এসেছে প্রচুর কিন্তু। যেগুলো আমি এক্সপেক্টই করিনি। আমি কোনোদিন এক্সপেক্ট করিনি যে আমি হিন্দি ছবিতে কাজ করব। আমি তেলেগু ছবিতে কাজ করব।

কাহানি, জাগ্গা জাসুস, নাইট ম্যানেজার, দিল বেচারা, কাল্কি ২৮৯৮ এডি, এই প্রত্যেকটা জায়গাতে আপনার স্ট্রং স্ক্রিন প্রেজেন্স সেটা কি আপনাকে বাংলায় এখন নতুন করে লোকজনকে ভাবাচ্ছে কি না?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: ভাবাচ্ছে তো নিশ্চয়ই। পজিটিভলি ভাবাচ্ছে না, নেগেটিভলি ভাবাচ্ছে সেটা আমার কাছে প্রশ্ন। ভাবাচ্ছে তো বটেই। আমি যদি ভালো চরিত্র পাই তাহলে বুঝবো যে পজিটিভ দিকে ভাবাচ্ছে। যখনই কিছু কিছু অফার আসে ইনসিগনিফিক্যান্ট রোল, তখনই বুঝি যে ওই লোকটা আমার সম্পর্কে পজিটিভলি ভাবছে না, নেগেটিভলি ভাবছে। 

‘দিল বেচারা’তে স্বস্তিকা মুখার্জীর সাথে

ওখানে দীর্ঘ বছর বাংলা, তারপর এখন তো সর্ব ভারতীয়, বলিউড সিনেমা, আমরা যতদূর জানি তেলেগু ইন্ডাস্ট্রিতে ‘কাল্কি ২৮৯৮ এডি’ আপনার প্রথম সিনেমা।  আপনি যদি ইন্ডাস্ট্রি হিসাবে দেখেন, কোন বৈশিষ্ট্যগুলোকে আপনি আসলে আলাদা করবেন?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: আমি বলিউড এবং তেলেগু ইন্ডাস্ট্রি (নিয়ে বলি)। সাউথের (অন্যান্য) ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে আমার কোনও আইডিয়া নেই। কারণ একটা মাত্র ছবি করেছি। আমি একটা জিনিস দেখেছি, ওরা ইন্ডাস্ট্রির পার্ট হিসাবে ভেরি প্রাউড। দে আর ভেরি প্রাউড অব দেয়ার কালচার দেয়ার ল্যাংগুয়েজ।

এই ‘কাল্কি ২৮৯৮ এডি’র যখন একটা শিডিউলে শুটিং করতে যাই সেদিনই হলিউডে অস্কার অ্যানাউন্সড হয়েছে। মানে আমাদের এখানে সকালে। হঠাৎ করে দেখি ‘কাল্কি’ এর ইউনিট শুটিং বন্ধ করে ‘আরআরআর’ এর গানটা চালিয়ে নাচছে, যে ইন্ডাস্ট্রি কো অস্কার মিল গেয়া। বাংলায় সেটা হবে না। আনফরচুনেটলি।

কাজের জায়গা থেকে কাজের ধরন বা কর্ম পরিবেশ সেটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: আমাদের বাংলা ইন্ডাস্ট্রি থেকে যেটা তফাৎ সেটা হচ্ছে যে তারা মার্কেটটা অনেক বেশি বাড়িয়ে ফেলেছে। কাজেই তাদের বাজেট বেশি। বাজেট বেশি যেখানে থাকবে সেখানে লোকের ভিড় বেশি। মানে একটা কাজের পেছনে তিনটে করে লোক থাকবে। এবং তারা ফাঁকি দেওয়ার স্কোপ পাবে না। কারণ যদি ফাঁকি দেয়, পেছনে আরও তিনজন দাঁড়িয়ে আছে তার জায়গা নেবার জন্য। কোনও ইউনিয়ন সেখানে বাঁচাবে না। এটা তফাৎ। (হাসি)

এত বছর ধরে আপনি নানা ধরনের চরিত্র করছেন। ডিরেক্টর বা প্রডিউসার আপনাকে যখন গল্পটা বলে, আপনি কোন বিষয়টাকে প্রাধান্য দেন?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: গল্পটা কোনও ইমপ্যাক্ট ফেলছে কি না। গল্পটা কি আমায় হাসাচ্ছে? কাঁদাচ্ছে? না কী করছে? কারণ আমি নিজে যদি কোনও স্ক্রিপ্ট শুনে বা গল্প শুনে, আমার কোনও ইমপ্রেশন না হয়, আমার কোনও ইমোশনাল চেঞ্জ না হয় তাহলে দর্শক যিনি টিকিট কেটে যাবেন তার কেন হবে?

আমি তো ছবিটা করে পয়সা পাচ্ছি। আর যিনি যাবেন তিনি পয়সা খরচ করে দেখতে যাবেন। তার তো আগে ভ্রুটা কুঁচকানো থাকবে; আমি পাঁচশ টাকার টিকিট কেটেছি। আমি যদি শুধু পয়সার জন্য একটা ছবি একসেপ্ট করে নেই, তাহলে দর্শক আমায় একসেপ্ট করবেন না।  

দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, স্ক্রিপ্টে আমার চরিত্রটা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? মানে সেটা কি কোনও ইমপ্যাক্ট দিচ্ছে? সেইটুকু দেখি। কারণ এখন আমি প্রচণ্ড বেছে কাজ করাতে বিশ্বাসী। আমি সব ছবিতে থাকি না। থাকতে চাই না এট লিস্ট।  

‘দ্য নাইট ম্যানেজার’ সিনেমায় অনিল কাপুরের সঙ্গে শাশ্বত

একটা কথা তো প্রচলিত, একটা ভালো গল্প মানে ভালো ছবি।

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: অনেক সময় দেখেছি ভালো গল্প কাজ করতে করতে খারাপ হয়ে গেছে। মানে, কী বলবো যে পদ্ধতিটা ভুল হয়ে গেছে। কাজ চলতে চলতে বুঝতে পারছি এটা গেলো। তখন কিছু করার থাকে না। 

ভালো গল্প, ভালো প্রজেক্ট বা ভালো প্রডিউসার এবং ভালো ডিরেক্টর তিনটা এক সাথে মেলাতো আসলে…

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: খুবই মুশকিল। আমি তো নতুনদের সঙ্গেও প্রচুর কাজ করেছি। আমি দেখেছি যে ইয়াংদের মধ্যে একটা অন্যরকম ভাবনাচিন্তা করার ক্ষমতা আছে। যেটা আমরা পারব না এখন। ওরা অন্যভাবে জীবনটাকে দেখে। কাজেই ওদের থেকে অনেক রকম নতুন নতুন আইডিয়া পাওয়া যায়, যেগুলো খুব ইন্টারেস্টিং মনে হয় আমার।

আমি প্রচুর ফার্স্ট টাইম ডিরেক্টরের সঙ্গে কাজ করেছি। লেটেস্ট করেছি মানসী সিনহা; প্রথম ছবি ডিরেক্ট করেছে ‘এটা আমাদের গল্প’। সুপারহিট! মানে খাতায় কলমে সুপারহিট নয়। আমি হলে হলে ভিজিট করেছি।

বাংলাদেশে কাজের অভিজ্ঞতাটা কেমন?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: বাংলাদেশে একটা জিনিস দেখলাম, এখানে হয়তো অতো টাকা নেই, কিন্তু একটা সদিচ্ছা আছে যে কাজটা আমি করতে চাইছি সেটা করছি। আমাকে কোনও প্রডিউসার বা কেউ আমাকে ইনফ্লুয়েন্স করে এটা করাতে পারবে না। এনারা যে কাজটা করাতে বিশ্বাস করেন সেটা করছেন। এটা আমি একটা জিনিস দেখলাম যে, ‘আমি এই প্রজেক্টটা এদের নিয়ে করতেই বিশ্বাসী। প্রডিউসার হিসেবে যদি আপনি বলেন ওকে নিন, আমি নেব না’।- এটা আমি দেখলাম এই ইউনিটে। এবং সেটা আমার খুব ভালো লাগলো।

আন্তরিকতা আছে একটা কাজের পেছনে। প্রত্যেকে খাটছে। লোকবল কম। কিন্তু সদিচ্ছার কোনও অভাব নেই। অনেস্টি টুওয়ার্ডস দ্য ওয়ার্ক কোনও অভাব নেই। 

সকাল সন্ধ্যা ডট কমের সঙ্গে আলাপচারিতায় শাশ্বত

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কাজের ধরন, বা এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে যে কাজ হচ্ছে এবং বাংলাদেশে একটি কাজের অভিজ্ঞতার মধ্যে আপনি বিষয়টা কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: পশ্চিমবঙ্গে কাজের ইউনিটে অনেক বেশি মানুষ। এবং ছবি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ছবির পেছনে টাইম দেওয়া হচ্ছে না। এটা আমাদের খুব বড় একটা ভুল হচ্ছে। যেটা হচ্ছে যে, আমাকে একটি ছবি এইরকম বাজেটের মধ্যে রিলিজ করতে হবে। কী ছবি আমি তখনও জানি না।

এটা একটা বেসিক গণ্ডগোল, আমার মনে হয়, যে আমি ডিরেক্টর হিসেবে প্রডিউসার হিসেবে এই ছবিটা করতে চাই; সেটাই তো আমার করা উচিত। কিন্তু না! আমাকে জুলাই মাসে ফার্স্ট উইকে এই ছবিটা রিলিজ করতে হবে। আমাকে এরমধ্যে রিলিজ না করলে আমি এটা ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডে দিতে পারবো না। এইগুলো প্রায়োরিটি হয়ে গেছে।

কেন হয়েছে জানি না। যেটা আমায় সত্যি খুব ভাবাচ্ছে যে, আমরা এন্টারটেইনমেন্টের বদলে অন্য বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে ফেলছি।

গল্পের জায়গা থেকেও কি পুরস্কার পাওয়ার বিষয়টা মাথায় থাকে?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: সত্যি কথা বলতে কী … এই একটা কাজ করলাম  ‘এটা আমাদের গল্প,’ যেটা একটু অন্যরকম। অন্যরকম গল্প পেলে কিন্তু মানুষ হলে আসে।

যেটা মাঝখানে দুয়েকটা হয়েছে। ‘টনিক’ বলে একটা ছবি হয়েছে, ‘প্রজাপতি’ হয়েছে। যেগুলো মানুষ দেখেছেন। স্পেশালি বয়স্ক মানুষরা আসছেন  তাও আবার হলে। এবং তারা দেখে ভালো লাগছে বলে তাদের ছেলেমেয়েদের পাঠাচ্ছেন। এই তো হয়!

চিরকাল তাই হয়ে এসেছে। আমরা ছোটবেলায় কী করতাম? আমাদের পড়াশোনা চলছে, ক্লাস, হঠাৎ ইভনিং শো-তে সবাই সেজেগুজে গাড়ি নিয়ে চলে গেল সিনেমা দেখতে। কোন সিনেমাটায় গেল? ওই সিনেমাটা। আচ্ছা!

পরের দিন আমি স্কুলের ব্যাগে এমনি জামাকাপড় ভরে স্কুলে না গিয়ে দুপুর বেলা টিকিট কেটে সিনেমা দেখে নিলাম। কারণ তখন সিনেমার টিকিটের দামও অনেক কম ছিল।

আর আমরা একই ছবি তিনটে শো, চারটে শো চলতো; নুন, ম্যাটিনি, ইভনিং, নাইট। আমি আমার সুবিধা মতো দেখছি, আমার বাবা-মা নিজের সুবিধা মতো দেখছে। এইটাতো এখন অসুবিধা হয়ে গেছে। আমার যে ছবিটা দেখতে ইচ্ছে করছে সেটা শিফট করে সকাল ন’টার শো করে দিলো। আমার পরিচিত খুব, আমার সঙ্গে ওর সম্পর্ক ভালো, ওর ছবিটা সন্ধ্যে ছ’টায় দিলাম। এই করলে কি ইন্ডাস্ট্রি বাঁচে? 

শাশ্বত অভিনীত ‘এটা আমাদের গল্প’

বার বার একই বৃত্তের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে কী-না? মানে, একই রকম অনেকগুলো মেকিং হচ্ছে, যখন ব্যোমকেশ শুরু হলো তখন সবাই সেটাই বানাচ্ছে, ফেলুদা আবার নতুন  করে হচ্ছে…। এখন যেমন মৃণাল সেনের অনেকগুলো বায়োপিক হচ্ছে।

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: সত্যি কথা বলতে কি একটা নতুন গল্প ভাবতে যে সময়টা লাগে, সেটা কারও হাতে নেই। কেন নেই, জানিনা। হয়তো টাকাটা কমতে কমতে এমন এক জায়গায় গেছে যে আমাদের পক্ষে, কোন রাইটারের পক্ষে…। আগে শুনতাম যে তিনমাস ধরে স্ক্রিপ্ট হচ্ছে। এখন আর সময়টা নেই। তো, একদিক দিয়ে সময়টাতো সেইভ হবে, যে বোমক্যাশ, ফেলুদা এগুলো স্টাবলিশড হিট। এগুলো রিনাউনড লেখকদের লেখা… অ্যাটলিস্ট ফিফটি পারসেন্ট, অর্থাৎ গল্পের দিক থেকে আমরা সেইফ। এবার আমাদের বাকি ফিফটি পারসেন্ট। এই সেইফ খেলাটাই চলছে। দর্শক কমে যাওয়ায় এবং হল কমে যাওয়ায় এখন এমন একটা পরিস্থিতি যে, আমি একটা ছবির পেছনে খুব বেশি সময় এবং টাকা খরচা করতে পারছিনা। আমরা বড় ছবি করতে পারছিনা।

কিন্তু একসময় প্রচুর প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের গল্প থেকে, সাহিত্য নির্ভর সিনেমা হয়েছে।

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: মুশকিল হচ্ছে যে তখনকার বাংলা সিনেমার প্রোডিওসাররা বাঙালি ছিলেন। এখন আমি আশাপূর্ণা দেবী যে কে, সেটা অবাঙালি প্রডিউসারকে বোঝাতে পারবো! বাংলার ইমোশন কী বোঝাতে পারবো! সে রাজি হবে কেন? ‘কেয়া হ্যায় ইসমে?’ বলে ফেলে দেবে।   

আর্ট ফিল্ম আর কমার্শিয়াল ফিল্ম ব্যাপারটা কীভাবে দেখেন?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: আর্ট-কমার্শিয়াল নয়; আমার কাছে ভালো ছবি, খারাপ ছবি। আমার কাছে আর্ট-কমার্শিয়াল কিছু নেই।

কিন্তু ‘মেঘে ঢাকা তারা’ তো সেই অর্থে কমার্শিয়াল ফিল্ম না।

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: ‘মেঘে ঢাকা তারা’ এর কথাও আমি বলছি। আমি জানি না পশ্চিমবঙ্গে কজন মানুষ ওই সিনেমাটা হলে গিয়ে দেখেছেন। খুব কম সংখ্যক মানুষ দেখেছেন কিন্তু। যারা দেখেছেন তারা কিন্তু পাঁচ বার ছ’বার করে দেখেছেন।

এবং আমি একটা ঘটনা বারবার বলি; আমি কেরালা ফিল্ম ফেস্টিভালে গিয়েছিলাম। প্রিয়দর্শনজি তখনকার হেড ছিলেন কেরালা ফিল্ম ফেস্টিভালে। যখন গেছি তখন একমাত্র প্রিয়দর্শনজি ছাড়া আমায় কেউ চেনেন না। কারণ তখন বব বিশ্বাস হয়ে গেছে। সকাল সাড়ে আটটার শো হাউসফুল। রাত্রি সাড়ে আটটার শো হাউসফুল। সিঁড়িতে লোক বসে আছে। তারা কিন্তু সবাই সাউথ ইন্ডিয়ান। কেউ বাঙালি নন। তারা গেছেন ঋত্বিক ঘটকের বায়োপিক দেখতে। তাদের কাছে ঋত্বিক ঘটক চেনা। আমি কেউ নই। আমি যখন হলে ঢুকেছি তখন কেউ আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি। এবং হলে যখন ফার্স্ট ওই শটটা পড়ে প্যান করে এসে গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, হাত তালি-সিটি হলে। যখন ওই ডায়লগটা হচ্ছে যে, “দুনিয়ার টাকা থাকবে না দুগ্গা কাজগুলো থেকে যাবে দেখে নিও”, সিটি-তালি, মানে সাব টাইটেল। এবং যখন ছবিটা শেষ হয় দুটো শো-য়ের মাঝে আমি হল থেকে বের হতে পারছি না!

প্রফেশনালিজমের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের ইন্ডাস্ট্রি কেমন?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: এখন অব্দি প্রফেশনালিজম আছে বলে তাও ইন্ডাস্ট্রিটা চলছে। সবাই যদি ফাঁকিবাজ হয়ে যেতো তাহলে কিন্তু কোনও ইন্ডাস্ট্রি চলে না। বেশিরভাগ মানুষ আমি বিশ্বাস করি এখনও ভালো কাজ করতে বিশ্বাসী বলে ইন্ডাস্ট্রিটা চলছে। বেশির ভাগ মানুষের জন্যই একটা ইন্ডাস্ট্রি চলে, নইলে চলে না। কিন্তু কিছু মানুষ যারা হয়তো সত্যি চেঞ্জ আনতে পারতেন তারা কেন ভাবছেন না আমি জানি না।

একই বৃত্তের মধ্যেই ঘুরপাক খাওয়ার মতো কোনও একটা ব্যাপার হচ্ছে কি না?

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়: হ্যাঁ, নতুনত্ব আনছি না। মানে নতুন হিরো বা নতুন হিরোইন তৈরি করার চেষ্টা করছি না আমরা। 

অনুলিখন: আইরিন সুলতানা

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী অমিতাভ দেউরী একজন গবেষক, কিউরেটর ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত