শুরুতেই উন্মাতাল যৌন দৃশ্য। টানটান উত্তেজনার মধ্যে খুন এবং বিচার। নিখুঁত সিনেমেটোগ্রাফি। দর্শক টানার জন্য সিনেমাটিতে ছিল সবকিছুই। তবুও চললো না!
জনপ্রিয় লেখক স্টিফেন কিংয়ের গল্পের ওপর ভিত্তি করে ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায় ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’। বাণিজ্যিকভাবে বক্স অফিসে এ সিনেমাটি ব্যাপক সাড়া ফেলবে বলেই চলচ্চিত্রবোদ্ধারা মনে করছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিনেমার মোটামুটি মাপের বাজেটটিও তুলে নিয়ে আসা যায়নি।
তিন দশক আগে মাস্টারপিস এই সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল ৩০ বছর আগে এই সেপ্টেম্বরেরই তৃতীয় সপ্তাহে। কাঁপানোর মতো সব উপাদান থাকা সত্ত্বেও বক্স অফিসে কেন লোকসানের মুখে পড়েছিল ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’? ব্যর্থতার পরে কীভাবেই বা আবার ক্লাসিক সিনেমার জগতে শীর্ষস্থানটি দখল করে নিল সিনেমাটি? সেই যাত্রা বর্ণনা করেছেন এর পরিচালক ফ্র্যাঙ্ক ডারাবন্ট।
ছবি মুক্তির এক দশক পরে ২০০৪ সালে বিবিসি ফোর এর ‘দ্য ডিভিডি কালেকশন’ সঞ্চালক স্টুয়ার্ট ম্যাকোনিকে সাক্ষাৎকারে ‘শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ সেই সিনেম্যাটিক প্রত্যাবর্তন নিয়ে কথা বলেন ডারাবন্ট।
‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ সিনেমার যাত্রার গল্প
স্টিফেন কিং বিশ্বের সবচেয়ে বাজার কাটতি ফিকশন বইয়ের লেখক। তার পাঠকপ্রিয়তা সহজেই ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ দেখতে প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের টানবে বলে মনে করা হয়েছিল। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত স্টিফেন কিংয়ের লেখা গল্প সংকলন ‘ডিফারেন্ট সিজন’ প্রকাশ হয়। ‘রিটা হেয়ওয়ার্থ অ্যান্ড শশাঙ্ক রিডেমশন’ ছিল সেই সংকলনেই ঠাঁই পাওয়া একটি নভেলা অর্থাৎ বড় গল্প। ওই সংকলনেই ছাপা হওয়া আরেকটি গল্প ছিল ‘দ্য বডি’, যাকে ভিত্তি করে ১৯৮৬ সালে ‘স্ট্যান্ড বাই মি’ নামের একটি সিনেমা হয়। এটি ছিল বক্স অফিসে আলোড়ন তোলা একটি সিনেমা।
১৯৮৭ সালে পরিচালক ডারাবন্ট ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’- এর চিত্রনাট্য তৈরির জন্য স্টিফেন কিংয়ের কাছ থেকে স্বত্ব কিনে নেন। তার কাছে গল্পটা ছিল দারুণ ফিল্মিক। সেই অনুভূতি ছিল ডারাবন্টের ভাষায়, “আমি গল্পটি পেয়েছি, স্টিফেন কিংয়ের গল্প, এতটাই আকর্ষণীয়, সত্যি, এবং এতটাই স্পর্শকাতর যে- আমার কাছে এটি স্বাভাবিকভাবেই একটি সিনেমা ছিল।”
নভেলাটি অ্যান্ডি ডুফ্রেন নামের একটি চরিত্রের গল্প দিয়ে শুরু হয়। স্ত্রী ও পরকীয়া প্রেমিককে হত্যার মধ্য দিয়ে তাকে ‘শশাঙ্ক স্টেট প্রিজন’ নামের একটি ভয়ঙ্কর কারাগারে (কাল্পনিক) যেতে হয়। সেই কারাগারে আরেক বন্দী এলিস ‘রেড’ এর সঙ্গে মনোজাগতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে অ্যান্ডি ড্রুফেনের। কারাগারের নির্মম পরিবেশে বন্দিদের মধ্যে গড়ে ওঠা ঘাত-প্রতিঘাত-নিষ্ঠুরতা-মানবিকতার এক দুর্দান্ত জার্নি ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ সিনেমাটি।
কারাগারের লোকেশন বাছাই করতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি পরিচালক ডারাবন্টকে। অবশেষে শুটিং লোকেশন হিসেবে পেয়েছিলেন ওহিয়ো স্টেট রিফরমেটরিকে। ১৮৯৬ সালে খোলা এই কারাগারে বন্দিদের সঙ্গে নিষ্ঠুরতম আচরণ করা হতো। একশ বছরেরও কিছু বেশি সময় চলার পরে বন্দিদের সঙ্গে নৃশংস, রূঢ় ও অমানবিক আচরণের অভিযোগে এটি বন্ধ করে দেওয়া হয় ১৯৯০ সালে।
পরিচালক ডারাবন্টের ভাষ্যমতে, ওই কারাগারে শুটিংয়ের সিদ্ধান্ত ‘দ্য শশ্যাঙ্ক রিডেম্পশন’ সিনেমায় একটি বাস্তবিক ভয়াবহ পরিবেশ যোগ করেছিল। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, কারাগারটি সিনেমার অভিনেতাদের মধ্যে বিষণ্ণতা এবং পাথুরে শীতল পরিবেশে ডুবে যাওয়ার অনুভূতি তৈরি করেছিল।
“সুতরাং, এটি সিনেমার শুটিং করার জন্য একটি খুব নিপীড়নমূলক জায়গা ছিল। লোকেরা বলবে আপনি এই জায়গায় দুঃখ অনুভব করছেন বা আপনি সেই জায়গায় ভূত অনুভব করছেন।”
বিবিসি ফোরের ওই অনুষ্ঠানে ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ সিনেমার দুই মূল অভিনেতা- ড্রুফেন চরিত্রে অভিনয়কারী টিম রবিনস এবং রেড চরিত্রের রূপদানকারী মরগ্যান ফ্রিম্যানকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। টিম রবিনস ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ মুক্তির আগের বছরই ‘দ্য প্লেয়ার’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেতার পুরস্কার জেতেন। ওদিকে মরগ্যান ফ্রিম্যানও দুইবার সেরা অভিনেতা হিসেবে অস্কার মনোনয়ন পেয়েছিলেন। মরগ্যান ফ্রিম্যান আগের বছরই অর্থাৎ ১৯৯৩ সালে ক্লিন্ট ইস্টউড অভিনীত ওয়েস্টার্ন জনরার সিনেমা ‘আনফরগিভেন’- এ দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য দর্শকপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ‘আনফরগিভেন’ বক্স অফিসে সাফল্য অর্জনের পাশাপাশি চারটি অস্কার জিতেছিল।
এমনকি ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ নিয়ে দর্শকদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াও খুব আশাব্যঞ্জক ছিল। এর প্রযোজক, লিজ গ্লোটজার ২০১৪ সালে ভ্যানিটি ফেয়ারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা জানিয়ে বলেন, “আমি বলতে চাচ্ছি, সেগুলো ছিল সর্বকালের সেরা স্ক্রিনিং।”
সুতরাং সিনেমাটি যে ‘হিট’ করবে তার সব আলামতই পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু হায়! ২ কোটি ৫০ লাখ ডলার বাজেটের সিনেমাটি দর্শক পেল না। কেবল যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে তুলতে পারলো ১ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
কেন বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়লো
‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ চলচ্চিত্রটির মুক্তির সময় আরও দুইটি দুর্দান্ত সিনেমা বক্স অফিসে দর্শকদের টানছিল। এর একটি হচ্ছে টম হ্যাঙ্কস অভিনীত ‘ফরেস্ট গাম্প’ এবং অপরটি কুয়েন্টিন ট্যারান্টিনোর ‘পাল্প ফিকশন’। মাত্র সপ্তাহখানেক আগে মুক্তি পাওয়া ‘ফরেস্ট গাম্প’ ততোদিনে দর্শকদের ব্যাপক আকারে টানতে শুরু করেছিল প্রেক্ষাগৃহে। মুখে মুখে আলোচিত হচ্ছিল এটির কথা। আর ‘পাল্প ফিকশন’ মুক্তি পায় ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’-এর পরে। কিন্তু তার আগেই কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পামে ডি’অর পুরস্কার জিতেছিল।
আগে-পরে মুক্তি পাওয়া দুইটি সিনেমা কেবল যে সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল তাই নয়, সেই সময়ে আমেরিকার চলতি পপ-কালচারাল ফেনোমেনাকেও ধরতে পেরেছিল। এ দুটি সিনেমার ডায়লগ, আকর্ষণীয় সিনেমাটোগ্রাফি এবং জুকবক্সে বাজানো মিউজিক দর্শকদের দারুণভাবে মত্ত রেখেছিল। মিডিয়া কাভারেজেও এই দুই সিনেমার জয়-জয়কার ছিল।
সে তুলনায় ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’-এর গল্প অনেকটা মনোজাগতিক, অন্তর্ঘাতমূলক এবং চাকচিক্যহীন। নারী চরিত্রের কম উপস্থিতিও সিনেমাটি বাজার ধরতে না পারার একটি কারণ। বিশেষ করে এর আগ দিয়েই ১৯৯৪ সালের গ্রীষ্মে চিত্তাকর্ষক নারী চরিত্রের উপস্থিতি নিয়ে বক্স অফিসে এসেছিল ‘দ্য লায়ন কিং’, ‘ট্রু লাইজ’,’ স্পিড’ এবং ‘দ্য মাস্ক’ এর মতো সিনেমা। যদিও এতো সেরাদের ডামাডোলে চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের চোখ এড়ায়নি ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’। অস্কারে সাতটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিল। মরগ্যান ফ্রিম্যান পেয়েছিলেন সেরা অভিনেতার আর সিনেমাটি পেয়েছিল শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের মনোনয়ন। কিন্তু জোটেনি একটিও।
‘ফরেস্ট গাম্প’ সেই বছর অস্কারে ৬টি পুরস্কার জিতে সবাইকে পিছে ফেলে দেয়। সেরা চিত্রনাট্যের জন্য ‘পাল্প ফিকশন’-এর ভাগ্যে জোটে একটি পুরস্কার মাত্র।
আশার শক্তি
অভিনেতা মরগ্যান ফ্রিম্যান ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ এর বক্স অফিস ব্যর্থতা নিয়ে খুব মজার একটি অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন ‘দ্য গ্রাহাম নর্টন শো’-তে এক সাক্ষাৎকারে ২০১৭ সালে।
তিনি বলেন, “সিনেমার প্রচারণা আসলে নির্ভর করে মানুষের মুখে মুখে ছড়ানোর মধ্য দিয়ে। যেমন যে কয়জন লোক শশাঙ্ক রিডেম্পশন মুক্তির পর দেখতে গিয়েছিলেন তারা বাকিদের কাছে বলেছিলেন- ওহ আপনারা কি ওই ভয়ঙ্কর সিনেমাটি দেখেছিলেন… যার নাম… শঙশম (উচ্চারণ করতে পারেননি অর্থে বুঝিয়েছেন)।”
ফ্রিম্যান তার সাক্ষাৎকারে আরেকজন নারীর সঙ্গে অভিজ্ঞতার কথাও বলেছিলেন। সেই নারী তার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর বলেছিলেন, “ওহ, আমি তোমাকে ‘হাডসাকার রিডাকশনে’ দেখেছি।”
‘দ্য হাডসাকার প্রক্সি’ নামে ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরেই আরেকটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল। অর্থাৎ ওই ভদ্রমহিলা সিনেমার নামটিই মনে করতে পারেননি। ফ্রিম্যানের মতে, কঠিন নামও সিনেমাটি না চলার একটি কারণ।
শশাঙ্ক রিডেম্পশন মানে ‘শশাঙ্ক’ নামের কারাগার থেকে মুক্তি। অবশেষে ব্যর্থতার কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিল এ সিনেমাটি। ঠিক যেন, সিনেমার ভেতরে প্রোথিত আশার প্রাণভোমরাটির ছোঁয়া এর বিপণনে লেগেছিল।
সেই সময়টি ছিল হোম-ভিডিও অর্থাৎ ভিসিআর-ভিসিপিতে ভিএইচএস ক্যাসেটে সিনেমা দেখার যুগ। সেখানে সিনেমাটি মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের সুখের জীবনে প্রত্যাবর্তন, বন্ধুত্ব এবং আশার শক্তি নিয়ে তৈরি ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ দর্শকদের অনুরণিত করতে তাকে।
পরিচালক ডরাবন্ট জানাচ্ছেন, ১৯৯৫ সালের মধ্যেই ভিএইচএস ক্যাসেটে সবচেয়ে বেশি ভাড়া হতে থাকে ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’। তারপর থেকে এ সিনেমার গল্প শুধুই এগিয়ে চলা।
১৯৯৭ সাল থেকে টেলিভিশনে সিনেমাটির ঘনঘন সম্প্রচার এটিকে বিপুল পরিমাণে দর্শকের কাছে পৌঁছে দেয়। পরিচালক ডারাবন্ট যখন বিবিসিকে সিনেমাটির এক দশক নিয়ে সাক্ষাৎকার দেন সেই সময়ের মধ্যেই ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ বারবার বিভিন্ন রেটিং এজেন্সি ও চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের তালিকায় শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে শীর্ষ স্থান দখল করেছে।
বিবিসির রেডিও টাইমসের একটি জরিপে ‘কখনও অস্কার জিততে পারেনি’ চলচ্চিত্রের তালিকাতেও সিনেমাটি সেরা নির্বাচিত হয়েছে। অদ্ভুত হলো, এই তিন দশক পরেও শুরুতে বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়া এ সিনেমাটি ইন্টারনেট মুভি ডেটাবেইজ রেটিংয়ে (আইএমডিবি) শীর্ষ ২৫০ চলচ্চিত্রের তালিকায় এক নম্বরে রয়েছে। এর রেটিং সেখানে ৯ দশমিক ৩। দিন দিন যেন আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে আশার শক্তিকে ধারণ করা সিনেমাটি।