‘শেখ হাসিনা পালায় না’- এক বছর আগের এই ভিডিও সোমবার ফিরে এসেছিল সোশাল মিডিয়ায় বিভিন্নজনের ওয়ালে। ২০২৩ সালের ১ অগাস্ট এক অনুষ্ঠানে এই বক্তব্য দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
এক বছরের মাথায় পাল্টে গেল দৃশ্যপট; ছাত্র-গণ আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে ৫ অগাস্ট দেশে ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। তারপরই দেশজুড়ে শুরু হয় উল্লাস মিছিল।
একটানা ১৫ বছর দেশ শাসন করছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। কঠোর হাতে বিরোধী দলকে দমন করে তকমা পেয়েছিলেন ‘আয়রন লেডি’; আর চলে যাওয়ার সময় জনতার স্লোগান শুনতে হলো- ‘এক, দুই, তিন চার-শেখ হাসিনা স্বৈরাচার’।
গণআন্দোলনে পতনের পর এই প্রথম কোনও রাষ্ট্রনেতাকে পালাতে দেখল বাংলাদেশ। ক্ষমতার দম্ভই তার এই পরিণতি ডেকে এনেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছ থেকে মন্তব্য এসেছে।
৭৬ বছর বয়সী শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারিয়ে ভারতে গেছেন। সেখান থেকে ইউরোপের কোনও দেশে তিনি আশ্রয় চাইতে পারেন বলে জানা গেছে। তবে তিনি আর রাজনীতিতে ফিরছেন না, এমনটাই জানিয়েছেন তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরও ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন শেখ হাসিনা। তখন যুক্তরাজ্যেও যাতায়াত ছিল তার।
পঁচাত্তরের পর দেশে প্রতিকূল অবস্থায় ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরেছিলেন শেখ হাসিনা; বাবার দল আওয়ামী লীগে দায়িত্ব নিয়ে। তিনি বলছিলেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই তার লক্ষ্য। দলের নেতা-কর্মীরা সেজন্য তাকে ‘গণতন্ত্রের নেত্রী’ হিসাবেই দেখত।
কিন্তু তার ভিন্ন পরিচয়ে বিদায় নেওয়াটা সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন মূল্যায়ন করেছেন এভাবে- “এরশাদের চেয়ে শেখ হাসিনা শত গুণ বেশি খারাপ হয়ে বিদায় নিয়েছেন। এরশাদ পালিয়ে যাননি, তিনি পালিয়ে গেছেন। তিনি পালিয়ে গেছেন, কিন্তু আওয়ামী লীগ দলটাকে ধ্বংস করে দিয়ে গেলেন। তার হিংসা, দম্ভ, অহংকার দলটাকে ধ্বংস করল।”
এক ছেলে ও এক মেয়ের জননী শেখ হাসিনার জন্ম ১৯৪৭ সালে গোপালগঞ্জে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম সন্তান হিসাবে। বাবার সূত্রে ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে হাতে খড়ি শেখ হাসিনার। ইডেন কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্রলীগের হয়ে ছাত্র সংসদেও নির্বাচিত হন।
১৯৬৭ সালে তার বিয়ে হয় এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে। এই পরমাণু বিজ্ঞানীর সঙ্গে তার সংসারে আসে দুই সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী জয় প্রধানমন্ত্রী মায়ের তথ্য প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টার পদে ছিলেন। মেয়ে সায়মা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালকের পদে আছেন।
পঁচাত্তরে স্বামীর সঙ্গে বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা। তখন আর দেশে ফেরেননি তারা। শেখ হাসিনা ভারতে থাকলেও রেহানা চলে যান যুক্তরাজ্যে। তার তিন সন্তানের একজন টিউলিপ সিদ্দিকী যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট সদস্য, এবার সহকারী মন্ত্রীও হয়েছেন।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে প্রবাসে থেকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার কিছু দিন পর দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। জিয়া এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর বিএনপির সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা নিয়েছিলেন সেনাশাসক এইচ এম এরশাদ।
তখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নামেন শেখ হাসিনা। একই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া, বিএনপির হাল ধরে।
এর মধ্যে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিলে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। তার সেই সিদ্ধান্তকে অনেকে এরশাদের সঙ্গে আঁতাত হিসাবে দেখেছিল। সেই নির্বাচনে যায়নি বিএনপি।
সেই সংসদ টেকেনি, পরে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গণআন্দোলন তীব্র হয়। তারই ধারবাহিকতায় ছাত্রনেতাদের সক্রিয়তায় তীব্র আন্দোলনে ১৯৯০ সালে ক্ষমতা ছাড়েন এরশাদ।
১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে আওয়ামী লীগ বসে বিরোধী দলের আসনে, শেখ হাসিনা হন বিরোধীদলীয় নেতা।
১৯৯৬ সালে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পর ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ, প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা।
২০০১ সালের নির্বাচনে আবার ক্ষমতা হারালে আবার বিরোধীদলীয় নেতার আসনে বসতে হয় তাকে। তখন ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলায় প্রাণে রক্ষা পেলেও শ্রবণশক্তি হারান তিনি।
২০০৭ সালে নির্দলীয় সরকার নিয়ে সংকট তৈরি হলে সংঘাত-সহিংসতার মধ্যে জারি হয় জরুরি অবস্থা; সেনা নিয়ন্ত্রণে গঠিত হয় সরকার, গ্রেপ্তার হন শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া।
তবে আন্দোলনের চাপে দুজনকেই মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ফখরুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দুই বছর পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ফের প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা।
এরপর তার শাসনই চলতে থাকে। এরমধ্যে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়, খালেদা জিয়াকে বন্দি করা হয়। বাতিল করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা।
এরপর প্রহসনের নির্বাচন নিয়ে যেমন সমালোচনা ওঠে, তেমনি গুম-খুন, মানবাধিকার হরণ, বাক স্বাধীনতা খর্বের ঘটনাগুলো ক্ষোভ বাড়াতে থাকে মানুষের। তার শাসনকে কর্তৃত্ববাদী শাসন হিসাবেই দেখতে থাকে বিদেশি সংবাদমাধ্যম।
নানা সমালোচনা অবকাঠামো উন্নয়ন দিয়ে আড়াল করতে চাইছিলেন শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, টানেল, মারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সামনে মেলে ধরছিেলন তিনি।
কিন্তু বিরোধী দলকে কঠোর হাতে দমন করলেও কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের এক আন্দোলনই পতনের দিকে নিয়ে যায় পাঁচ বারের প্রধানমন্ত্রী, আট বারের সংসদ সদস্য শেখ হাসিনাকে।
সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল গত জুলাই মাসে। শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলনে আগুন জ্বলে ওঠে গত ১৪ জুলাই শেখ হাসিনার এক বক্তব্যে।
তিনি বলেছিলেন, “মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের বাচ্চারা পাবে, রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?”
এর পরপরই ক্রোধে ফেটে পড়ে শিক্ষার্থীরা। রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে বের হয় মিছিল, যার স্লোগান ছিল- ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার-রাজাকার/ কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার-স্বৈরাচার’।
পরদিন গত ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালালে পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে গড়ায়। এরপর কয়েকদিনে দেড় শতাধিক নিহত হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েন করে সরকার।
তবে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে দিনকে দিন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ধরে নেওয়া হয়েছিল। তারা মুক্ত হওয়ার পর সরকারের পদত্যাগের দাবি তোলে।
গত ৩ অগাস্ট শহীদ মিনারে বিশাল সমাবেশ করে তারা পরদিন েথকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। তা ঠেকাতে আওয়ামী লীগ মাঠে নামল ৪ অগাস্ট ব্যাপক সংঘাতে একদিনেই শতাধিক নিহত হয়।
এই পরিস্থিতিতে ৫ আগস্ট সারাদেশ থেকে মানুষকে ঢাকায় আসার আহ্বান জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সাবেক একদল সেনা কর্মকর্তাও আন্দোলনের সমর্থন জানায়। তারপরও ৪ অগাস্ট কঠোর হওয়ার বার্তা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা, কিন্তু পরদিন চিত্র পােল্ট যায়।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারিও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে গেলেও তারপর আট মাসও গেল না, ‘স্বৈরাচার’ তকমা নিয়ে দেশ ছাড়তে হয় তাকে।