Beta
শনিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৪
Beta
শনিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৪

শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ ফেরত চাইলে কী করতে পারে ভারত

প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভারত সফর করে এসে গত ২৫ জুন গণভবনে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি
প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভারত সফর করে এসে গত ২৫ জুন গণভবনে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন শেখ হাসিনা। তার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে কয়েকটি মামলা হয়েছে। হত্যার অভিযোগের পাশাপাশি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগেও মামলা হয়েছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে চাইছে আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি। তাকে ফেরত পাঠাতে এরই মধ্যে নয়া দিল্লির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনও বক্তব্য আসেনি এই বিষয়ে।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে যদি শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর জোর দাবি ওঠে, তাহলে নয়া দিল্লি কী করতে পারে- সেই প্রশ্ন উঠেছে।

বন্দি প্রত্যর্পণে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চুক্তি রয়েছে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ই ২০১৩ সালে চুক্তিটি হয়। ২০১৬ সালে সেটি সংশোধনও হয়েছিল।

সেই চুক্তিতে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে বিচারের মুখোমুখি করার সুযোগ রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখে ভারতের সংবাদমাধ্যম ফার্স্টপোস্টে লিখেছেন প্রভাস কে দত্ত।

উত্তর-পূর্ব ভারতে বিদ্রোহ মোকাবেলায় ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তিটি হয়েছিল। এই চুক্তির সুবিধা ভারত-বাংলাদেশ উভয়ই পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে আত্মগোপনে থাকা জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্যদের গ্রেপ্তার করে ফেরানো হয় ওই চুক্তির অধীনে।

আর ভারতও ওই চুক্তির অধীনেই ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) নেতা অনুপ চেটিয়াকে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যেতে পেরেছিল। ভারতও এই চুক্তির মাধ্যমে কয়েকজন বাংলাদেশি পলাতককে হস্তান্তর করেছে।

চুক্তিতে প্রত্যর্পণের শর্ত ও অপরাধের তালিকা রয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের ‘প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধ’ হিসাবে চুক্তিতে তালিকাভুক্ত অপরাধের জন্য ‘যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে’ বা ‘যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে বা দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে বা তাদের জন্য ওয়ান্টেড’ পলাতকদের প্রত্যর্পণ করার কথা।

এক বছর বা তার বেশি মেয়াদের কারাদণ্ডযোগ্য অপরাধই অর্থাৎ আর্থিক অনিয়মসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট অপরাধগুলোই প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।

ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তির সফল বাস্তবায়নে দ্বৈত অপরাধের নীতিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক, যা তুলে ধরেছেন প্রভাস দত্ত। অর্থাৎ, কোনও অপরাধকে যাতে প্রত্যর্পণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা যায়, তার জন্য ওই অপরাধটি উভয় দেশেই দণ্ডনীয় হতে হবে।

চুক্তির ধারা ৭ এ প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধ কী এবং উভয় দেশের কর্তৃপক্ষ প্রত্যর্পণের অনুরোধের জবাবে কীভাবে সাড়া দেবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে।

কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম আছে। যেসব অপরাধ ‘রাজনৈতিক প্রকৃতির’ তাদের ক্ষেত্রে এই চুক্তি প্রযোজ্য হবে না।

চুক্তির ষষ্ঠ ধারায় রাজনৈতিক অপরাধের একটি তালিকা উল্লেখ করা হয়েছে, যা এই চুক্তির ব্যতিক্রম।

চুক্তির অষ্টম ধারায় আরও কিছু ব্যতিক্রম উল্লেখ করা হয়েছে, যার আলোকে ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশই নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারবে।

যদি কোনও প্রত্যর্পণের অনুরোধ ‘বিশ্বাসযোগ্য না হয়’ এবং ‘ন্যায়বিচারের স্বার্থে’ নয় বলে বিবেচিত হয়, সেক্ষেত্রে তা প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে।

ত ৫ অগাস্ট গণভবন থেকে হেলিকপ্টারে সরিয়ে নেওয়া হয় শেখ হাসিনাকে। পরে তিনি যান ভারতে।

চুক্তির অষ্টম ধারা অনুযায়ী, যদি কোনও ব্যক্তি প্রত্যর্পণকারী দেশকে সন্তুষ্ট করতে পারে যে তার বিরুদ্ধে যে অপরাধের অভিযোগ আছে অথবা যে অপরাধের জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, তা খুবই তুচ্ছ প্রকৃতির, তাহলে প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে।

অথবা তাকে প্রমাণ করতে হবে যে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগটি ন্যায়বিচারের স্বার্থে করা হয়নি। যে অপরাধের জন্য তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে অথবা যে অপরাধে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, তা একটি সামরিক অপরাধ এবং সাধারণ অপরাধ আইনের অধীনে দণ্ডনীয় কোনও অপরাধ নয়।

এছাড়া যদি কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুরোধকারী দেশে কোনও ফৌজদারি মামলা চলমান থাকে অথবা সেখানে তাকে কোনও অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়, তাহলে প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে।

ভারত কি হাসিনার প্রত্যর্পণের অনুরোধ অস্বীকার করতে পারে?

প্রভাস দত্ত লিখেছেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর মধ্যে হত্যা, অপরাধমূলক মানবহত্যা, আক্রমণ, বিস্ফোরণ ঘটানো, জীবন বিপন্ন করার উদ্দেশ্যে বিস্ফোরক পদার্থ বা অস্ত্র তৈরি করা বা রাখা, গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা, জীবন বিপন্ন করার উদ্দেশ্যে সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত করা, অপহরণ বা জিম্মি করা, হত্যার উস্কানি এবং সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত অপরাধ অন্তর্ভুক্ত।

এই অপরাধগুলো রাজনৈতিক প্রকৃতির অপরাধগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রমের আওতায় পড়ে না। সুতরাং, একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও শেখ হাসিনার মামলা এই ব্যতিক্রমের আওতায় নাও আসতে পারে।

এছাড়া এগুলো তুচ্ছ অভিযোগ নয় বা ধারা ৮ চালু করার মতো সময় অতিবাহিত হয়নি।

তবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা অভিযোগগুলোকে ভারত যদি ‘সৎ উদ্দেশে নয়’ এবং ‘ন্যায়বিচারের স্বার্থে নয়’ বিবেচনা করে, সেক্ষেত্রে ধারা ৮ এর আওতায় প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারে।

তবে এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্নটি, বলছেন প্রভাস দত্ত।

তার ভাষ্যে, কারণ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ভারতের একজন বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন শেখ হাসিনা। ভারতের প্রতি তার বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নয়াদিল্লির জন্য কৌশলগত গুরুত্ব বহন করে।

“কিন্তু এটি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। কারণ বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে থাকা দেশটি দ্রুত চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের খেলার মাঠ হয়ে উঠছে। এক্ষেত্রে ভারত ইউনূস সরকারকে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের জন্য আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করা থেকে নিরুৎসাহিত করতে একটি কূটনৈতিক পথ বেছে নিতে পারে।”

শেখ হাসিনা রয়েছেন কোন প্রক্রিয়ায়

গত ৫ আগস্ট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তারপর থেকে তিনি দিল্লির উপকণ্ঠে একটি আধা সামরিক বাহিনীর অতিথি নিবাস বা ‘সেফ হাউসে’ রয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে। তবে নয়া দিল্লির পক্ষ থেকে তাদের অবস্থানের বিষয়ে কিছুই প্রকাশ করেনি নয়া দিল্লি।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ছয় বছর ভারতেই নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।

এবার শেখ হাসিনা তড়িঘড়ি করে ভারতে আশ্রয় নিলেও তার গন্তব্য ইউরোপের কোনও দেশ বলে  তখন শোনা গিয়েছিল। তবে পরে তার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় জানান, তার মা অন্য কোনও দেশে আশ্রয়ের আবেদন করেননি।  

শেখ হাসিনা ভারতে এখন কোন স্ট্যাটাসে রয়েছেন, তা জানা যায়নি। তিনি কোনও বিশেষ ভিসায় ভারতে অবস্থান করছেন, না কি তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে ভারত সরকার পুরোপুরি নীরব।

ভারতে এই মুহূর্তে তার অবস্থানের বৈধতাটা ঠিক কী এবং তা কতদিন পর্যন্ত বৈধ থাকতে পারে, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে বিবিসি বাংলা।

দিল্লির কূটনীতিকদের প্রশ্ন করে বিবিসি বাংলা জবাব পেয়েছে, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শেখ হাসিনার যে ‘ডিপ্লোম্যাটিক/অফিসিয়াল’ পাসপোর্ট ছিল, তা এখনও বৈধ এবং সেই পাসপোর্টের সুবাদে তিনি অন্তত দেড় মাস কোনও ভিসা ছাড়াই ভারতে থাকতে পারেন।

অর্থাৎ এই সময়ে শেখ হাসিনার পাসপোর্ট যদি প্রত্যাহার না করা হয়, তার ভারতে অবস্থানের ক্ষেত্রে কোনও জটিলতা নেই।

নরেন্দ্র মোদীর আমন্ত্রণে ভারত সফর করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার ছিল সফরের দ্বিতীয় দিন।
নরেন্দ্র মোদীর আমন্ত্রণে গত জুন মাসে ভারত সফর করেন শেখ হাসিনা। তার দুই মাস না যেতেই তার সরকারের পতন ঘটে। ফাইল ছবি

গত ১৬ আগস্ট দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এই প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন।

তবে তিনি বিষয়টি খোলসা না করে বলেছিলেন, “আমরা গত সপ্তাহেও এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছিলাম যে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ভারতে আসার বিষয়টি অনুমোদন করা হয়েছিল খুব স্বল্প সময়ের নোটিসে। এই পরিস্থিতি এখনও ক্রমাগত পাল্টাচ্ছে। এই মুহূর্তে অন্তত তার (শেখ হাসিনার) পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের নতুন করে কিছু জানানোর নেই।”

১০ দিন আগে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও একই কথা বলেছিলেন।

ফলে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, শেখ হাসিনা ভারতে এখন কীসের ভিত্তিতে আছেন?

তার উত্তরে দিল্লির শীর্ষস্থানীয় একাধিক কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ভারতে শেখ হাসিনার এই মুহূর্তে অবস্থানের ভিত্তিটা হল ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘সংশোধিত ট্র্যাভেল অ্যারেঞ্জমেন্ট’।

শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী সরকারের মধ্যে ঢাকায় এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২০১৮ সালের ১৫ জুলাই।

ওই সমঝোতা স্মারকের ১(এ) ধারাতে উল্লেখ করা আছে, উভয় দেশের ডিপ্লোম্যাটিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীরা ৪৫ দিনের মেয়াদে ভিসা ছাড়াই বসবাসের জন্য অন্য দেশে থাকতে পারবে।

বিবিসি জানতে পেরেছে, প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে শেখ হাসিনা যখন দেশত্যাগ করেন, তার ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট তখন বৈধ ছিল।

ফলে যতদিন সেই পাসপোর্ট বহাল থাকছে, কোনও ধরনের ভিসা ছাড়াই ৪৫ দিন ভারতে অবস্থান করতে পারবেন শেখ হাসিনা। তার ১৫ দিন অবশ্য এরই মধ্যে অতিক্রান্ত হয়েছে। আরও এক মাস বাকি।

কিন্তু এই দেড় মাসের মধ্যে যদি শেখ হাসিনার বর্তমান পাসপোর্ট বাংলাদেশ সরকার বাতিল করে, তাহলে ভারতের কী করণীয়?

সেই প্রশ্নে দিল্লির এক কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সেটাও বড় কোনও সমস্যা নয়, কারণ এই ধরনের পরিস্থিতিতে আমাদের ‘প্ল্যান বি’ বা ‘প্ল্যান সি’ প্রস্তুত রাখতেই হয়, এখানেও নিশ্চয়ই সেটা তৈরি আছে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত