১৯ জুলাই বিকাল; বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে বিক্ষোভ চলছে দেশজুড়ে; ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে গুলিও চলছে; তার মধ্যেই ঢাকার আকাশে উড়ছিল হেলিকপ্টার। আন্দোলন দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেলিকপ্টার ব্যবহার এবারই প্রথম দেখা গেল।
সেদিন মোহাম্মদপুরের বছিলায় ওয়েস্ট ধানমন্ডি হাউজিংয়ের এ ব্লকের ৪ নং সড়কের একটি ভবনের নবম তলার ফ্ল্যাটে থেকে একই গুলিতে বিদ্ধ হন মুমতাহিনা নাজ ও তার খালাত বোন মহসিনা আফনান আয়েশা।
গুলিটি মুমতাহিনার ডান পায়ে আঁচড় কেটে বাম পায়ের হাঁটুর এক পাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়, এরপর সেই বুলেট তার পাশে দাঁড়ানো আয়েশার পায়ে বিদ্ধ হয়। এই একটি বুলেট মুমতাহিনার বাম পায়ের হাঁটুর হাড় কয়েক টুকরা করে দেয়, আর আয়েশার ডান পায়ের হাঁটুর নিচের অংশের হাড় ভেঙে দেয়।
মুমতাহিনার বাবা মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন আহমেদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেছিলেন, “ওই দিন আন্দোলনকারীদের রাস্তা থেকে সরাতে র্যাব নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল। হেলিকপ্টার থেকেও একের পর এক সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি চালানো হয়। আমার মেয়ে ঘরের ভেতরে থেকে গুলিবিদ্ধ হয়। বহু বাড়ির ছাদ, বারান্দায় গুলির চিহ্ন রয়েছে।”
শুধু মুমতাহিনা ও মহসিনাই নয়, তখন হেলিকপ্টার থেকে চালানো গুলিতে আরও অনেকের হতাহত হওয়ার খবরও এসেছিল। তাদের অনেকেই ছিল বহুতল ভবনে কিংবা বাড়ির ছাদে থেকে গুলিবিদ্ধ হয়। বলা হচ্ছিল, হেলিকপ্টার থেকে গুলি না ছুড়লে অত ওপরে থাকা অবস্থায় গুলি লাগা সম্ভবপর নয়।
জুলাই মাসের শেষার্ধ্বে আন্দোলনের সময়ই হেলিকপ্টার থেকে গুলি নিয়ে প্রবল সমালোচনা উঠেছিল, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এর প্রতিবিধান চেয়ে হাইকোর্টে আবেদনও হয়।
গত আগস্টের মাঝামাঝিতে সেই আবেদনের শুনানিতে বিচারকের এমন মন্তব্যও এসেছিল, হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়ার নির্দেশদাতারাও দায় এড়াতে পারে না।
কিন্তু এখন র্যাব হেলিকপ্টার ওড়ানোর কথা স্বীকার করলেও দাবি করছে, এই আকাশযান থেকে কোনও গুলিই ছোড়েনি তারা।
‘পুলিশ’ লেখা হেলিকপ্টার আকাশে দেখা গেলেও এই বাহিনী বলছে, তারা হেলিকপ্টার ব্যবহারই করেনি, তখন তাদের আকাশযান ব্যবহার করেছিল র্যাব।
বিজিবি বলেছে, তখন সরকার থেকে তাদের হেলিকপ্টার ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হলেও তারা ব্যবহার করেনি।
জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠার পর আওয়ামী লীগ সরকার র্যাব-পুলিশের সঙ্গে বিজিবি নামিয়েছিল।
যখন হেলিকপ্টার থেকে গুলির নির্দেশদাতাদের খোঁজা হচ্ছে; সেখানে হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণের বিষয়টিই এখন পুরোপুরি অস্বীকার করা হচ্ছে।
অথচ জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুলিবিদ্ধ অনেকের স্বজনের দাবি, হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিই তাদের হতাহত হওয়ার কারণ।
হেলিকপ্টার থেকে গুলির বহু অভিযোগ
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদি এলাকায় গত ২০ জুলাই সন্ধ্যায় সংঘর্ষ চলাকালে র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে সুমাইয়া আক্তার (২০) নামে গৃহবধূর মৃত্যু হয় বলে তার স্বজনদের অভিযোগ।
সুমাইয়ার মায়ের পরিবার পাইনাদি এলাকার একটি ভবনের ষষ্ঠ তলার ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে। সন্তান জন্মের জন্য সুমাইয়া মায়ের কাছে এসেছিলেন। সন্তানের জন্মের দুই মাস পরই প্রাণ হারান সুমাইয়া।
আসমা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ২০ জুলাই সন্ধ্যার দিকে গোলাগুলির শব্দ শুনে তিনি ফ্ল্যাটের উত্তর পাশের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান। তখন হেলিকপ্টার উড়ছিল। শিশু মেয়েকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে হেলিকপ্টার দেখতে সুমাইয়াও বারান্দায় এসে দাঁড়ান। তখন সুমাইয়া গুলিবিদ্ধ হন।
সুমাইয়ার ছোট ভাই সজলও সাংবাদিকদের বলেছিলেন, হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলি বারান্দার গ্রিলে লেগে তার বোনের মাথায় এসে লাগে।
গত ১৯ জুলাই ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় মাদ্রাসাছাত্র জোবাইদ হোসেন ইমনও (১২) হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে নিহত হন বলে তার স্বজনদের অভিযোগ। ওই ঘটনায় ইমনের পরিবার শেখ হাসিনাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে যে মামলা করেছে, সেখানে র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়ার কথা বলা হয়েছে।
১৯ জুলাই বিকালে রামপুরায় বিটিভি ভবনের কাছে আলমগীর শেখ নামে এক যুবকও হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে নিহত হন বলে অভিযোগ তার পরিবারের।
নিহত আলমগীর কুষ্টিয়ার কুমারখালীর শিলাইদহ ইউনিয়নের কসবা গ্রামের বাসিন্দা। রামপুরার হেলথকেয়ার ফার্মাসিটিক্যাল লিমিটেডের গাড়িচালক ছিলেন তিনি। পাশাপাশি ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাতেন।
আলমগীরের মা আলেয়া খাতুন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “হেলিকপ্টার থেকে তিনটি গুলি করে ছেলেকে মারে ফেলেছে। আমার বেটা তো আর ফিরে আসবে না। এখন ওর বউ ছোয়ালপালের দেখবি কিডা?”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির খসড়া হিসাবে, ১৬ জুলাই থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের হামলায় ১ হাজার ৫৮১ জন নিহত এবং প্রায় ৩১ হাজার জন আহত হয়েছে।
হাইকোর্টে রিট আবেদন
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সংঘাতের সময় বাড়িতে, বাড়ির আঙিনায় ও পরিবারের সঙ্গে থাকা অবস্থায় গুলিতে নিহত ১০ শিশুর প্রত্যেকের পরিবারকে ৫০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে করা এক রিট আবেদনের শুনানিতে হেলিকপ্টারের প্রসঙ্গটি আসে।
আন্দোলন চলাকালেই গত ৩১ জুলাই রিট আবেদনটি করেন এক সময়ের বিএনপি নেতা, আইনজীবী তৈমূর আলম খন্দকার। সরকার পতনের পর গত ১৪ আগস্ট শুনানিতে ‘হেলিকপ্টার দেখতে এসে লুটিয়ে পড়েন সুমাইয়া’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরেন তৈমুর আলম।
তিনি বলেন, “কোনও পাবলিক মুভমেন্ট নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে স্বাধীনতার পর কেউ দেখেনি। এই হেলিকপ্টার থেকে ঘরে গুলি ছুড়েছে।”
“তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার কারণে মারা গেছে”- বিচারক এই প্রশ্ন করার পর তিনি বলেন, পত্র-পত্রিকার খবরে এসেছে।
তখন আদালত বলে, “যারা সিস্টেম নষ্ট করে এসেছে, তাদেরও জবাবদিহিতা আছে। শুধু হেলিকপ্টারের ওপর থেকে গুলি কে করেছে, তা নয়। যারা গুলি করেছেন, শুধু তারাই দায়ী নন, যারা অর্ডার দিয়েছেন, তারা দায় এড়াতে পারেন না।”
র্যাব কী বলছে
আন্দোলন চলাকালেই গত ২৬ জুলাই র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়ার অভিযোগ নাকচ করেছিল।
র্যাব সদরদপ্তরের সেই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, যারা রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল, তাদের ছত্রভঙ্গ করতে হেলিকপ্টার থেকে শুধু কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়েছিল।
গত ১৮ জুলাই বাড্ডায় কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে আটকে পড়া পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করতে সেখানে হেলিকপ্টার গিয়েছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তির ভাষ্য এখনও দিচ্ছে র্যাব।
গত বুধবার র্যাবের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌসকে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়া হয়েছিল কি না?
জবাবে তিনি বলেন, “র্যাবের সদস্যরা ছাত্র-জনতার ওপর কোনও গুলি চালায়নি।
“আমরা হেলিকপ্টার থেকে কেবল টিয়ারগ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছি। হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে, এরকম কোনও ভিডিও নেই। আপনাদের কারও কাছে যদি গুলি করার কোনও ভিডিও থাকে, আপনারা সেগুলো দিলে র্যাব তা যাচাই করবে।”
শনিবার তিনি আরেক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আন্দোলন চলাকালে র্যাব প্রাণঘাতী কোনও অস্ত্রই ব্যবহার করেনি।
পুলিশ কী বলছে
আন্দোলনের সময় ‘পুলিশ’ েলখা হেলিকপ্টারও উড়তে দেখা গিয়েছিল।
সেবিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর সপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) ইনামুল হক সাগর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, পুলিশের নিজের ব্যবহারের হেলিকপ্টারই এখন নেই।
“পুলিশের দুটি হেলিকপ্টার কেনার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে রাশিয়া থেকে। সেই দুটি হেলিকপ্টার এখনও দেশে আসেনি। বর্তমানে পুলিশের যে দুটো হেলিকপ্টার আছে, সেগুলো ব্যবহার হচ্ছে র্যাবে। কারণ র্যাব পুলিশ বাহিনীরই একটি অংশ।”
বিজিবি কী বলছে
আন্দোলন দমনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কোনও হেলিকপ্টার আকাশে ওড়েনি বলে দাবি করছেন বাহিনীর মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী।
গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “আন্দোলন দমনে র্যাবের মতো বিজিবিকেও হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু বিজিবির হেলিকপ্টার একদিনের জন্যও ব্যবহার করা হয়নি।”