Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

শরীফার গল্প : কমিটিতে ‘বিজ্ঞান বোঝানো যায়নি’ তাদের

shorifar-golpo-250124
[publishpress_authors_box]

‘শরীফার গল্প’ নিয়ে একটি মহল বিতর্ক তোলার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যবই মূল্যায়নে যে কমিটি গঠন করেছিল; তাতে বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধিত্ব না থাকা নিয়ে উঠেছিল প্রশ্ন। কমিটি প্রতিবেদন দেওয়ার পর সেই প্রশ্নটিই আবার ফিরে এল।

কমিটির এক সদস্য বলেছেন, পাঁচ সদস্যের কমিটির বৈঠকে তারা দুজন জাতীয়-আন্তর্জাতিক নানা গবেষণাপত্র দেখিয়ে এই লেখাটি পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করার যৌক্তিকতা তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ধর্মীয় বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে বাকি বিষয় বুঝতে চাননি।

সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইটি রচনা ও সম্পাদনার দায়িত্বে থাকা আবুল মোমেন বলেছেন, তারা বিজ্ঞানসম্মত বিষয়ই সন্নিবেশিত করেছিলেন ওই অধ্যায়ে। তাতে শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানীদের সমর্থনও ছিল।

সেই বিষয়টিই কমিটির সভায় বোঝানো সম্ভবপর হয়নি বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানান কমিটিতে থাকা এক সদস্য।

বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির এক দশক পরে গত বছর সপ্তম শ্রেণীর নতুন পাঠ্যবইয়ে শরীফার গল্প অধ্যায়টি সংযোজিত হয়।

এক বছর পর এই অধ্যায়টির বিরোধিতা করে এক অনুষ্ঠানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক খণ্ডকালীন শিক্ষকের বক্তব্য এবং তার বই ছেঁড়ার ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে তা নিয়ে শুরু হয় তুমুল আলোচনা-সমালোচনা।

তা দেখে বিষয়টি ‘আরও গভীরভাবে’ পর্যালোচনা করে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) সহায়তা করার জন্য ৫ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

কমিটিতে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুর রশীদকে আহ্বায়ক করা হয়। সদস্য হিসাবে রাখা হয় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গভর্নর মুফতি মাওলানা কফিল উদ্দীন সরকার, ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুর রশিদ, এনসিটিবির সদস্য মোহাম্মদ মশিউজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল হালিমকে।

গত জানুয়ারিতে ওই কমিটি গঠনের পরপরই তাতে কোনও জেন্ডার বিশেষজ্ঞ, কোনও নারী কিংবা বিষয়টির সঙ্গে সম্পর্কিত কাউকে না রাখায় প্রশ্ন উঠেছিল

সেই প্রশ্নের মধ্যে থেকেই কমিটি সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তাতে পাঠ্যবইটি থেকে শরীফার গল্প বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে বলে খবর এসেছে।

কীসের ভিত্তিতে সুপারিশ করা হয়েছে- শনিবার সকাল সন্ধ্যা জানতে চাইলে কমিটির প্রধান ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুর রশীদ কিছু বলতে রাজি হননি।

তিনি বলেন, “আমরা সেটা তো বলব না। কয়েকদিন আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়ের কাছে রিপোর্ট জমা দিয়েছি।

“উনারা এখন পুরোটা নেবেন, নাকি আংশিক নেবেন, এটা এখন উনাদের দায়িত্ব। ধরেন অর্ধেক নিলেন, তখন তো কাজ হবে না। আবার যদি পুরোটা নেন ….  অথবা উনারা এটা বাতিলও করতে পারেন।”

অধ্যায়টিতে কী ধরনের অসঙ্গতি পেয়েছেন- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “এভাবে মিডিয়াতে কথা আমরা কেউ বলব না। আমরা রিপোর্ট জমা দিয়েছি, আপনারা তাদের কাছে যান।”

সপ্তম শ্রেণির এই বইয়ে রয়েছে শরীফার গল্প।
সপ্তম শ্রেণির এই বইয়ে রয়েছে শরীফার গল্প।

শিক্ষা সচিব সোলেমান খানের মোবাইল ফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়ায় তার বক্তব্য জানতে পারেনি সকাল সন্ধ্যা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আর কেউ এনিয়ে কিছু বলতে চাননি। শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বিদেশে থাকায় তার বক্তব্যও জানা যায়নি।

কমিটিতে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল হালিম সকাল সন্ধ্যার প্রশ্নে বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, “প্রতিবেদন আমরা দিয়েছি। কিন্তু আমি কথা বলতে পারছি না। পরীক্ষার ডিউটিতে আছি, ব্যস্ত রয়েছি।”

কমিটিতে থাকা এনসিটিবির সদস্য (কারিকুলাম) মোহাম্মদ মশিউজ্জামান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে। এটা এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ইস্যু।

“একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে রিপোর্টে কী বলা হয়েছে, সেটা আমি বলতে পারি না। এটা সরকারি কর্মচারী বিধিমালার পরিপন্থি। যতক্ষণ না মন্ত্রণালয় এটা নিয়ে কিছু বলছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি বলতে পারি না।”

তবে মশিউজ্জামান ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, তারা যা দিয়েছিলেন পাঠ্যপুস্তকে, সেটা ঠিকই ছিল। এখন মন্ত্রণালয় যদি সংশোধন করতে হবে, তাও তারা করবেন।

“বইতে যেটা দিয়েছি, সেটা ঠিকই দিয়েছি। কিন্তু আমরা তো কেউ পারফেক্ট নই। এখন যদি সংশোধন করতে হয়, তাহলে রাজি আছি। কিন্তু আমরা ভুল করিনি।”

কবি-প্রাবন্ধিক আবুল মোমেনের রচনা ও সম্পাদনায় সপ্তম শ্রেণির নতুন শিক্ষাক্রমের ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইটি প্রকাশিত হয়।  

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বইয়ে এখন যা রয়েছে, সেটা বিজ্ঞানসম্মত। এটা দেওয়া যায় মনে করেই দিয়েছি, হুট করে নয়। দেশের শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানীরাও এর পক্ষে মত দিয়েছেন।

“আর এটা তো গোপনীয়তার কিছু নেই, এটা অস্পৃশ্য কিছুও নয়। এখানে ধর্মীয়ভাবেও বাধা নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাই করা হলো। এটাকে একটা মহল পূঁজি করল।”

সরকার এই আপত্তি উপেক্ষা করতে পারত বলে মনে করেন আবুল মোমেন।

২০১৩ সালে সরকার নারী-পুরুষের পাশাপাশি হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। ২০২৩ সালে সপ্তম শ্রেণীর বইটিতে ‘মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা’ শিরোনামের অধ্যায়ে যুক্ত হয় শরীফার গল্প। এর উদ্দেশ্য ছিল পুরুষ ও নারীর পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গের একজন মানুষকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।

বইটির সঙ্গে যুক্ত থাকা এনসিটিবির এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা কিন্তু এটা (শরীফার গল্প) হুট করে দিইনি। কিছু না বুঝে দিইনি।

“এগুলো আমাদের জানা ছিল। ২০১৭ সাল থেকে আমরা তাদের (হিজড়া) নিয়ে কাজ করেছি ক্লোজলি, ওদের জীবনযাত্রাসহ সবকিছুর সঙ্গে আমরা পরিচিত। কিন্তু যখনই এটা বইয়ে আনা হলো, আমরা নানাভাবে চাপে পড়লাম, সব জায়গায় কথা শুনতে হলো।”

“যারা মানবতা নিয়ে কথা বলেন, তারা কিন্তু আমাদের পক্ষে এগিয়ে আসেননি। আমরা দুই পক্ষেরই গালি খেয়েছি,” হতাশ কণ্ঠে বলেন তিনি।

গল্পটি মূল্যায়নে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সদস্য সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ওখানে তিনজন মওলানা আর আমরা দুজন ছিলাম। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা একমত হতে পারিনি।

“বারবার মিটিং করেছি; সেখানে জাতীয় আন্তর্জাতিক ডকুমেন্টস, বিভিন্ন গবেষণা দেখিয়েছি। কিন্তু এতকিছু করেও আমাদের তাদের জায়গায় আসতে হয়েছে।”

তিনি বলেন, “এক পর্যায়ে শুনতে হলো, আর বিলম্ব করা যাবে না। রিপোর্ট যাই হোক না কেন, সেটা দিতে হবে।”

কমিটিতে ভারসাম্য না থাকায় কাজের অসুবিধা হয়েছে দাবি করে ওই সদস্য বলেন, “এর চাইতে যদি আমাদের বলা হতো, এটা সংশোধন, পরিমার্জন করতে হবে; তাহলে বিষয়টি আমাদের জন্য ইজি হতো। স্মার্ট একটা জায়গায় যেতে পারতাম। কিন্তু ওদের হাতে দেওয়াতে সেটা কঠিন হয়ে গেছে।”

এখন কী হবে

বইটির রচয়িতা ও সম্পাদক আবুল মোমেন বলেন, “বল এখন সরকারের কোর্টে, তাদের সিদ্ধান্তের পর এ বিষয়ে আমরা কী করবো, সেটা বলা যাবে।

প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় এনসিটিবিকে জানাবে, তারা জানাবে রচয়িতা ও সম্পাদকদের। তারপরই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এনসিটিবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “হয়ত শরীফার গল্প থাকবে না। তবে শরীফার গল্প দিয়ে নয়, অন্য কিছু দিয়ে হলেও থাকতে হবে। অন্য গল্প আসবে, অন্য কিছু আসবে। আমরা এটা ছাড়ছি না।”

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হলে কর্মকর্তারা বলেন, মন্ত্রী নওফেল বর্তমানে যুক্তরাজ্যে রয়েছেন। তিনি ফিরবেন আগামী সোমবার। তারপরই সিদ্ধান্ত হবে।

এসসিটিবি কর্মকর্তারা এর আগে বলেছিলেন, বিশেষজ্ঞ কমিটি যদি মত দেয়, তাহলে এ বছরই গল্পে সামান্য পরিবর্তন করে সেটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে জানিয়ে দেওয়া হবে।

কমিটি গঠনের সময় শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, হিজড়াদের অধিকার বাংলাদেশে আইনিভাবে স্বীকৃত। তারাও এ দেশের নাগরিক। তারপরও শরীফার গল্প নিয়ে প্রয়োজনে পর্যালোচনা করার সুযোগ আছে।

বইটি সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত যারা ছিলেন, তারা বলেছিলেন, শরীফার গল্পে হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের কথা বলা হয়েছে। ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি কোথাও লেখা না হলেও তা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।

শিক্ষামন্ত্রীও তখন বলেছিলেন, বইয়ে শব্দটি ট্রান্সজেন্ডার নয়, থার্ড জেন্ডার আছে। সেটা আইনত স্বীকৃত, যারা জৈবিক (বায়োলজিক্যাল) কারণে তৃতীয় লিঙ্গ বা সামগ্রিকভাবে সমাজে হিজড়া নামে পরিচিত। তারা এ দেশের নাগরিক। অবশ্যই তাদের নাগরিক সুবিধা আছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত