বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির এক দশক পরে পাঠ্যবইয়ে তাদের নিয়ে একটি অধ্যায়ের আলোচনা তৈরি করেছে বিতর্ক।
সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ‘শরীফার গল্প’ নিয়ে এক অঙ্গন থেকে আপত্তি ওঠার পর অধ্যায়টি পর্যালোচনায় একটি কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
তবে সেই কমিটির সদস্যদের মধ্যে কোনও জেন্ডার বিশেষজ্ঞ কিংবা বিষয়টির সঙ্গে সম্পর্কিত কাউকে না রাখায় নতুন করে উঠেছে প্রশ্ন। কমিটিতে কোনও নারী না থাকার বিষয়টিও আসছে সামনে।
নতুন শিক্ষাক্রমে সপ্তম শ্রেণির বইটিতে ‘মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা’ শিরোনামের অধ্যায়ে যুক্ত হয়েছে শরীফার গল্প। যার উদ্দেশ্য পুরুষ ও নারীর পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গের একজন মানুষকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।
এক বছর পর এই অধ্যায়টির বিরোধিতা করে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক খণ্ডকালীন শিক্ষকের বক্তব্য এবং তার বই ছেঁড়ার ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে তা নিয়ে শুরু হয় তুমুল আলোচনা-সমালোচনা।
তা দেখে বিষয়টি ‘আরও গভীরভাবে’ পর্যালোচনা করে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্ক বোর্ডকে (এনসিটিবি) সহায়তা করার জন্য বুধবার পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুর রশীদকে। অন্য সদস্যরা হলেন- ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গভর্নর মুফতি মাওলানা কফিল উদ্দীন সরকার, এনসিটিবির সদস্য মশিউজ্জামান, ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) পরিচালক।
এর আগে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেছিলেন, পাঠ্যবইয়ে ‘শরীফা’ গল্পটি উপস্থাপনে যদি কোনও বিতর্ক বা বিভ্রান্তি হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন আনা যেতে পারে।
তবে দেশে ধর্মকে ব্যবহার করে একটি গোষ্ঠীর অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রবণতা রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
গঠিত কমিটি নিয়ে আপত্তি যেখানে
যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, তাতে একটি অংশের ব্যক্তিদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলে অনেকে আপত্তি তুলেছেন, তা নিয়ে সোশাল মিডিয়ায়ও লেখালেখি হচ্ছে।
বলা হচ্ছে, এই কমিটিতে অবশ্যই সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, চিকিৎসকদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন ছিল। তাদের প্রতিনিধিত্ব না থাকায় কমিটির সুপারিশ বিজ্ঞানভিত্তিক নাও হতে পারে।
যুক্তরাজ্যের দ্য ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ডে গবেষণারত বাংলাদেশি চিকিৎসক মারুফুর রহমান তদন্ত কমিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
তিনি ফেইসবুকে লিখেছেন, “সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অফিস আদেশেও বলা হয়েছে, গল্পটি ধর্মীয় ও সামাজিক আঙ্গিকে পর্যালোচনার কথা। তাহলে শিক্ষা বোর্ড ভাবছে, জেন্ডার বিষয়টি সামাজিক ইস্যু, বায়োলজির বিষয় না।
“এই কমিটিতে পাঁচজনের মধ্যে তিনজনই কেন ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কিত? সামাজিক অংশের আলোচনার জন্য কেন এই কমিটিতে সমাজবিজ্ঞানী, জেন্ডার স্টাডিজ এক্সপার্টরা নেই?”
ধর্মীয় পরামর্শও যদি নিতে হয়, তাতেও কমিটির তিনজনই একই ধর্মের কেন, সেই প্রশ্ন রেখেছেন মারুফুর।
কমিটিতে নারী না থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রাশেদা রওনক খান।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নারীর ক্ষমতায়নে যদি নারীকেই বাদ দেওয়া হয়, তাহলে সেটা যেমন সম্ভব হবে না কিংবা বাস্তবসম্মত হবে না, ঠিক একই অবস্থা এই তদন্ত কমিটি নিয়ে।”
তিনি বলেন, ‘‘কমিটিতে লিঙ্গীয় বৈচিত্র্যও নেই। কেবল পুরুষ বা অধিকাংশ ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ দিয়ে কমিটি গঠন মানে হলো, সিদ্ধান্ত আগেই একপাক্ষিক হয়ে যাবার আশঙ্কা তৈরি হয়ে যাওয়া।’’
রওনক আরও বলেন, “এই স্পর্শকাতর বিষয়ের তদন্ত কমিটিতে থাকতে পারত বৈজ্ঞানিক, চিকিৎসক, মনোচিকিৎসক, ফিজিওলজিস্ট, নৃবিজ্ঞানী, জেন্ডার বিশেষজ্ঞ, তাদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যাদের নিয়ে কথা, তাদের কোনও সদস্যও নেই।”
আলোচনায় আরও আসছে, জেন্ডার সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়, সেক্স চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিষয়, মনোবিজ্ঞান হলো সামাজিক বিজ্ঞান এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের মিশ্রণ। গঠিত তদন্ত কমিটিতে সেসব বিষয়ের বিশেষজ্ঞরাও নেই।
যুক্তরাষ্টের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলছে, ট্রান্সজেন্ডার হলো যাদের জেন্ডার (সামাজিক লিঙ্গ পরিচয়) আর সেক্স (জৈবিক লিঙ্গ পরিচয়) ভিন্ন।
ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে আলোচনা, গবেষণা রয়েছে বিশ্বজুড়ে। তবে তাদেরকে মানসিক রোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি কোথাও। ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ (আইসিডি১১-২০১৯, বিশ্বস্বাস্থ সংস্থা) অনুযায়ী, ট্রান্সজেন্ডার মানসিক বা আচরণগত রোগ নয়। তবে সামাজিকসহ নানা ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হওয়ায় তাদের মনো-সামজিক সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে।
এই তদন্ত কমিটিতে চিকিৎসক থাকা প্রয়োজন ছিল কি না- প্রশ্ন করা হলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, এখানে অবশ্যই চিকিৎসক থাকা প্রয়োজন ছিল।
“যেহেতু এটি অত্যন্ত সেনসিটিভ বিষয়, তাই এখানে বিভিন্ন বিশেষায়িত চিকিৎসকদের রাখা প্রয়োজন ছিল।”
কমিটিতে এন্ড্রোক্রাইনোলজিস্ট (হরমোনজনিত বিষয় নিয়ে কাজ করেন যে চিকিৎসক), এন্ড্রোলজিস্ট (প্রজননতন্ত্র নিয়ে যারা চিকিৎসা দেন), মনোবিজ্ঞানী, মনোরোগ চিকিৎসক রাখা দরকার ছিল বলে মনে করেন তিনি।
ডা. হেলাল সেইসঙ্গে বলেন, “তবে চিকিৎসক থাকলেও এখানে এমন কাউকে রাখা যাবে না, যিনি কেবলমাত্র বিশ্বাসের ভিত্তিতে কথা বলেন। তাকে তার চিকিৎসা বিজ্ঞানের বইয়ে পড়া যুক্তিতর্ক, উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ নিয়ে রেফারেন্সসহ সবকিছু দিয়ে কথা বলতে হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন চৌধুরীও মনে করেন, তদন্ত কমিটিতে সব ক্ষেত্রের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়নি।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যেহেতু বিষয়টি নিয়ে ধর্মীয় দিক থেকে বির্তক উঠেছে, তাই হয়ত ধর্মীয় বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মানুষদের রাখা হযেছে এখানে। কিন্তু এখানে এখানে বিজ্ঞান, বায়োলজি, মানসিক স্বাস্থ্য সব ধরনের বিশেষজ্ঞ থাকা উচিৎ ছিল।
“যেহেতু এখানে ধর্মীয় বিতর্ক উঠেছে এবং তদন্ত কমিটি ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে, তাই এখানে রিপোর্ট বায়াসড হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই কমিটিতে পক্ষ বিপক্ষ-দুপক্ষের লোক থাকা উচিৎ ছিল।”
তবে যে বিষয় নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, অনেকে পুরোপুরি না জেনেই তাতে যোগ নিচ্ছেন বলে অধ্যাপক কামালের পর্যবেক্ষণ।
“কিন্তু আমি মনে করি, পুরো বিষয়টি অনুধাবন না করে সবাই কথা বলছেন। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি তাই কি না, সেটা বোঝা দরকার আগে।”