আওয়ামী লীগের নির্দেশনা ছিল- মন্ত্রী কিংবা সংসদ সদস্যদের স্বজনরা যেন উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেয়। কিন্তু সারাদেশের মতো সিলেট বিভাগেও দলের এই নির্দেশনায় কেউ কান দেয়নি।
ফলে বড় ভাই মন্ত্রী তো ছোট ভাই উপজেলা চেয়ারম্যান; বাবা এমপি তো ছেলে উপজেলা চেয়ারম্যান; বাবা ইউপি চেয়ারম্যান তো ছেলে উপজেলা চেয়ারম্যান, বড় ভাই জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান তো ছোট ভাই উপজেলা চেয়ারম্যান- এমন চিত্রই দেখা গেছে সিলেটে।
সিলেট বিভাগের ৩৮ উপজেলায় চার ধাপে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন শেষের পর দেখা যাচ্ছে, ৫টি ছাড়া বাকিগুলোতে জয়ীদের বেশিরভাগই স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীদের স্বজন কিংবা ঘনিষ্ঠজন। পাঁচ উপজেলায় কেবল বিএনপি থেকে বহিষ্কৃতরা জয়ী হয়েছে।
প্রথম ধাপের নির্বাচন হয় গত ৮ মে। এতে সিলেট সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য এ কে আব্দুল মোমেনের ঘনিষ্ঠজন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সুজাত আলী রফিক। তিনি সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীরও কাছের লোক হিসাবে পরিচিত।
দক্ষিণ সুরমা উপজেলায় নির্বাচিত চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো.বদরুল ইসলাম সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিবের ঘনিষ্ঠজন।
সিলেটের গোলাপগঞ্জে নির্বাচিত চেয়ারম্যান, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মঞ্জুর কাদির শাফি চৌধুরী প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।
বিশ্বনাথে জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি (বহিষ্কৃত) মোহাম্মদ সুহেল আহমদ চৌধুরী নির্বাচিত হয়েছেন।
সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে নির্বাচিত উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ রায় এবং শাল্লায় জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি অবনী মোহন দাস নির্বাচিত হয়েছেন। উভয়েই সুনামগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য জয়া সেনগুপ্তার ঘনিষ্ঠজন।
হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন খান ও আজমিরীগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতা মো. আলাউদ্দিন মিয়া চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তারা হবিগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য ময়েজ উদ্দিন শরীফ রুয়েলের ঘনিষ্ঠজন।
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় নির্বাচিত হয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক কিশোর রায় চৌধুরী মনি। বড়লেখায় নির্বাচিত আওয়ামী লীগ নেতা আজির উদ্দিন। তারা কোন সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠ বা সমর্থিত, তা স্পষ্ট নয়।
কুলাউড়া উপজেলার নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান উপজেলা চেয়ারম্যান মাওলানা ফজলুল হক খান সাহেদ সিলেটের ফুলতলী পীর সমর্থিত আল ইসলাহর স্থানীয় নেতা। তিনি সিলেট-৫ আসনের সংসদ সদস্য হুছামুদ্দীন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজন।
দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন হয় গত ২১ মে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া জেলা আওয়ামী লীগের উপ দপ্তর সম্পাদক মো. মজির উদ্দিন সিলেট জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন খানের ঘনিষ্ঠজন হিসাবে পরিচিত।
জৈন্তাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী স্থানীয় সংসদ সদস্য ইমরান আহমদের ঘনিষ্ঠজন। গোয়াইনঘাটে নির্বাচিত চেয়ারম্যান হলেন সিলেট জেলা বিএনপির বহিষ্কৃত কোষাধ্যক্ষ শাহ আলম স্বপন।
সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমদ মুরাদ ও তাহিরপুরে আওয়ামী লীগ নেতা মো. আফতাব উদ্দিন উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। তারা সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য রনজিত চন্দ্র সরকারের আস্থাভাজন হিসাবে পরিচিত।
জামালগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রেজাউল করিম শামীম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নূরুল হুদা মুকুটের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম তালুকদার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নোমান বখত পলিনের ঘনিষ্ঠ।
হবিগঞ্জের বাহুবলে নতুন মুখ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন এবং নবীগঞ্জ উপজেলায় নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা মুজিবুর রহমান চৌধুরী সেফু। মৌলভীবাজারের রাজনগরে দ্বিতীয় বারের মতো উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা মো.শাহজাহান খান।
তৃতীয় ধাপে ২৯ মে নির্বাচন হয়। সিলেটের বালাগঞ্জে উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনহার মিয়া এবং ফেঞ্চুগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান আসফাকুল ইসলাম সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা, বালাগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।
বিয়ানীবাজারে টানা দ্বিতীয়বারের মতো জয়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মো. আবুল কাশেম পল্লব। তিনি অবশ্য স্থানীয় সংসদ সদস্য নূরুল ইসলাম নাহিদের বিরোধী বলয়ের নেতা।
সুনামগঞ্জের ছাতকে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা রফিকুল ইসলাম কিরন ও দোয়ারাবাজারে আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক দেওয়ান আল তানভীর আশরাফী চৌধুরী বাবু উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তারা সুনামগঞ্জ-৫ (ছাতক ও দোয়রাবাজার) আসনের সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিকের সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন।
ছাতকের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান কিরনের বাবা সুন্দর আলী গোবিন্দগঞ্জ সৈদেরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের চেয়ারম্যান মো. ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুল কৃষিমন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুস শহীদের ছোট ভাই।
শ্রীমঙ্গলের টানা দ্বিতীয়বারের উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ভানুলাল রায় মৌলভীবাজার-৪ (শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য আব্দুস শহীদের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।
হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় টানা দ্বিতীয়বারের উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোতাচ্ছিরুল ইসলাম। তিনি আবার স্থানীয় সংসদ সদস্যের বিরোধী বলয়ের নেতা হিসেবে পরিচিত।
লাখাইয়ে টানা তৃতীয়বারের চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মুশফিউল আলম আজাদ ও শায়েস্তাগঞ্জে টানা দ্বিতীয়বারের চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রশিদ তালুকদার। তারা হবিগঞ্জ-৩ (সদর, লাখাই ও শায়েস্তাগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য আবু জাহিরের ঘনিষ্ঠজন।
চতুর্থ ধাপের ভোট হয় ৫ জুন। এতে সিলেটের জকিগঞ্জে টানা দ্বিতীয় বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি লোকমান উদ্দিন চৌধুরী স্থানীয় জনপ্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিত। কানাইঘাটে নির্বাচিত জেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাক আহমদ পলাশ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন খানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।
সুনামগঞ্জ সদরের দ্বিতীয় বারের চেয়ারম্যান, জেলা যুবলীগের আহবায়ক খায়রুল হুদা চপল সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নূরুল হুদা মুকুটের ছোট ভাই।
শান্তিগঞ্জ উপজেলায় নির্বাচিত চেয়ারম্যান সাদাত মান্নান সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী ও সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য এম এ মান্নানের ছেলে।
মধ্যনগর উপজেলার নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছেন মো. আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া। তিনি বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত আইজি আব্দুল বাতেনের বড় ভাই।
হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলায় টানা তৃতীয় বারের মতো চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির বহিষ্কৃত সহসভাপতি এস এফ এ এম শাহজাহান। চুনারুঘাটে নির্বাচিত চেয়ারম্যান উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সৈয়দ লিয়াকত হাসান।
সিলেট বিভাগের ৪১ উপজেলার মধ্যে মৌলভীবাজার সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচন স্থগিত রয়েছে। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর ও সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলায় মেয়াদ উত্তীর্ণ না হওয়ায় নির্বাচন ঘোষণা করেনি নির্বাচন কমিশন।
উপজেলা চেয়ারম্যানদের সঙ্গে সংসদ সদস্যদের আত্মীয়তা ও ঘনিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আওয়ামী লীগের জনবান্ধব নেতা হিসেবে যারা গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয়, জনগণ তাদেরই নির্বাচিত করেছেন। মন্ত্রী-এমপিদের ঘনিষ্ঠ থাকা তো দোষের কিছু নয় বরং সমন্বিত উন্নয়নে ভূমিকা রাখা সহজ হবে, জনগণ আরও বেশি উপকৃত হবে।”
কেন্দ্রীয় নির্দেশনা উপেক্ষা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এসব বিষয় দলীয় ফোরামে আলোচনা হবে। আওয়ামী লীগ একটি অংশগ্রহণমূলক স্বতঃস্ফূর্ত নির্বাচন চেয়েছিল, তা সফল হয়েছে। কোথাও এমপিরা বা স্থানীয় নেতারা অন্যায়ভাবে প্রভাব বিস্তার করে থাকলে তাও দলীয়ভাবে খতিয়ে দেখা হবে।”