ফিলিস্তিনের গাজার সশস্ত্র সংগঠন হামাসের সঙ্গে গত অক্টোবর থেকেই যুদ্ধ করছে ইসরায়েল। হামাসকে সমর্থন দিয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই ইসরায়েলের ভূমি লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালাতে শুরু করে হিজবুল্লাহ। শুরুতে বিষয়টি হামলা-পাল্টা হামলায় সীমিত থাকলেও পরে পরিসর বাড়ে।
ইসরায়েল ও লেবাননের রাজনৈতিক দল ও সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর মধ্যে গত এক সপ্তাহ হামলা-পাল্টা হামলার তীব্রতা বেড়েছে। সোমবার থেকে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল। এক পর্যায়ে শুক্রবার ইসরায়েলের হামলায় নিহত হন হিজবুল্লাহপ্রধান শেখ হাসান নাসরাল্লাহ।
হামলায় নাসরাল্লাহর সঙ্গে হিজবুল্লাহর দক্ষিণাঞ্চলীয় ফ্রন্টের কমান্ডার আলী কারকিও নিহত হন।
শনিবার ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, বেক্কা ভ্যালি ও লেবাননের দক্ষিণে হিজবুল্লাহর একাধিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালানো হচ্ছে, হামলা চলবে।
মূলত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকেই ইসরায়েল ও লেবাননের মধ্যে উত্তেজনা চরমে ওঠে। সেদিন লেবাননে পেজার বোমা হামলায় প্রায় তিন হাজার মানুষ আহত ও ৯ জন নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে তিনটি শিশুও ছিল।
পেজার বোমা হামলায় আহতদের অধিকাংশই হিজবুল্লাহর সক্রিয় সদস্য। ওই হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে লেবানন।
লেবানন ও ইসরায়েলের মধ্যে সাংঘর্ষিক ইতিহাস নতুন কিছু না। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে থেমে থেমে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে।
১৯৮২ – আক্রমণ ও গঠন
দক্ষিণ লেবানন থেকে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল ১৯৮২ সালের জুনে লেবাননে আক্রমণ করে। লেবাননে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে এ হামলা হয়, যে গৃহযুদ্ধ চলে সাত বছর।
লেবাননে বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার প্রতিষ্ঠার আশায় ইসরায়েল দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের দখল নেয়। এমনকি পশ্চিম বৈরুতের অনেক জায়গাও ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। পিএলওর নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাটিকে কার্যত অবরুদ্ধ করে রেখেছিল ইসরায়েল।
পরে একটি চুক্তির অধীনে পিএলও তিউনিশিয়ায় চলে গেলেও ইসরায়েলি সেনারা লেবাননে থেকে যায়। কারণ তারা তখন লেবাননের গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরও ভয়ানক করতে স্থানীয় কয়েকটি গ্রুপকে মদত দিতে থাকে। এই মদতের ফলে সাবরা ও সাতিলা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
ইসরায়েলের সমর্থন নিয়ে লেবাননের খ্রিস্টান মিলিশিয়াদের মধ্যকার একটি উপদল বৈরুতের সাবরা পাড়া ও পার্শ্ববর্তী শাতিলা শরণার্থী শিবিরে ওই হামলা চালায়। দুই দিন ধরে চালানো ওই হামলায় সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়। নিহতদের অধিকাংশই ছিল ফিলিস্তিনি ও লেবানিজ শিয়া।
তখন লেবাননের স্থানীয় কয়েকটি গ্রুপ আলাদা আলাদাভাবে হামলার জবাব দিতে শুরু করে। বিশেষ করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে দেশটির শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়।
ইরানের সমর্থন ও বেশ কয়েকজন মুসলিম নেতার পরিকল্পনার ফল হলো হিজবুল্লাহ। লেবাননের বেক্কা ভ্যালির তরুণদের আকুণ্ঠ সমর্থন ও বৈরুতের দক্ষিণের শহরতলীগুলোর শিয়া জনগোষ্ঠীর হাত ধরে খুব দ্রুত হিজবুল্লাহ অগ্রগামী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
১৯৮৩ সালের হামলা
১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে লেবাননে বিদেশি সামরিক উপস্থিতির বিরুদ্ধে বহু হামলা হয়। বিভিন্ন গোষ্ঠী এসব হামলার দায় স্বীকার করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে হিজবুল্লাহকেই দায়ী করা হয়।
বৈরুতে অবস্থিত বেশ কয়েকটি সামরিক ব্যারাকে ১৯৮৩ সালের ২৩ অক্টোবর ব্যাপক মাত্রায় বোমা হামলা চালানো হয়। এতে ফরাসি ও আমেরিকান শান্তিরক্ষী বাহিনীর তিন শতাধিক সদস্য নিহত হয়। তখন বোমা হামলার দায় স্বীকার করে ইসলামিক জিহাদ নামের একটি গ্রুপ। অনেকের মতে এটি হিজবুল্লাহর একটি ফ্রন্ট।
১৯৮৫ – হিজবুল্লাহর শক্তির প্রকাশ
হিজবুল্লাহর সামরিক শক্তি ১৯৮৫ সাল নাগাদ এতটাই বেড়েছিল যে তারা ও তাদের মিত্র বাহিনী মিলে দক্ষিণ লেবাননের লিটানি নদীর পার থেকে ইসরায়েলি বাহিনীকে তাড়িয়ে দিতে পেরেছিল।
ইসরায়েল তখন লেবানন-ইসরায়েল সীমান্তের বিস্তৃত অংশকে ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ ঘোষণা করে। অঞ্চলটি ছিল খ্রিস্টান-অধ্যুষিত সাউথ লেবানন আর্মি (এসএলএ) নিয়ন্ত্রিত। এসএলএ মূলত ইসরায়েলি প্রক্সি বাহিনী হিসাবে কাজ করত। ২০০০ সালে লেবানন থেকে ইসরায়েলের চূড়ান্ত প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত ওই বাহিনী ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে যায়।
১৯৯২ – রাজনীতি
লেবাননের গৃহযুদ্ধ শেষে ১৯৯২ সালের দিকে হিজবুল্লাহ সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করে। দেশটির পার্লামেন্টের ১২৮ আসনের মধ্যে আটটি জিতে নেয় দলটি। তখন থেকেই পার্লামেন্টে হিজবুল্লাহর আসন বাড়তে থাকে। এখন পার্লামেন্টের ৬২টি আসন তাদের।
১৯৯৩ – সাত দিনের যুদ্ধ
ইসরায়েল ১৯৯৩ সালের জুলাইয়ে ‘অপারেশন একাউন্টিবিলিটি’ নামে লেবাননের সঙ্গে সাত দিনের যুদ্ধে জড়ায়। লেবাননের একটি গ্রামে ইসরায়েলি আক্রমণের জবাবে হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের উত্তরে হামলা চালায়। এই যুদ্ধে ১১৮ লেবানিজ নিহত ও পাঁচ শতাধিক আহত হয়। কয়েক হাজার বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়।
১৯৯৬ – ’এপ্রিল আগ্রাসন’ ও কানা গ্রাম
তিন বছর বাদে ১৯৯৬ সালের ১১ এপ্রিল ইসরায়েল আবার লিটানি নদীর ওপারে হিজবুল্লাহকে টার্গেট করে অভিযান চালায়। অভিযান চলে ১৭ দিন। লেবানন ওই অভিযানকে বলে ‘এপ্রিল আগ্রাসন’। আর ইসরায়েল বলে ‘অপারেশন গ্র্যাপস অব রাথ’।
সেবার উভয়পক্ষেরই অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
এপ্রিলের ১৮ তারিখ ইসরায়েল দক্ষিণ লেবাননের কানা গ্রামের কাছে জাতিসংঘের একটি ভবনে হামলা চালায়। ওই ভবনে আট শতাধিক বাস্তুচ্যুত বেসামরিক আশ্রয় নিয়েছিল। হামলায় ১০৬ বেসামরিক নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে ৩৭ জনই ছিল শিশু। জাতিসংঘের অধীনে শান্তি মিশনের দায়িত্বে থাকা চার ফিজি সেনাও গুরুতর আহত হয়।
২০০৬ – জুলাইয়ের লড়াই
হিজবুল্লাহর সেনারা ২০০৬ সালের জুলাইয়ে ইসরায়েলের মাটিতে অভিযান চালিয়ে তিন সেনাকে হত্যা ও দুইজনকে অপহরণ করে। নিহত সেনারা হলেন- ওয়াশিম নাজাল, ইয়াল বেনিন ও শানি তুর্গেম্যান। আর অপহৃতরা হলেন- গোল্ডওয়াজার ও ইলদাদা রাগেব।
হিজবুল্লাহ লেবানিজ বন্দীদের সঙ্গে ওই দুই ইসরায়েলি সেনাকে বিনিময় করতে চায়। তবে দুই বছর পর ওই দুই ইসরায়েলি সেনার বিনিময়ে পাঁচ লেবানিজ বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়।
ওই জুলাই মাসেই ইসরায়েলের সঙ্গে যে যুদ্ধ শুরু হয়, তা টানা ৩৪ দিন ধরে চলেছিল। এসময় ১২০০ লেবানিজ নিহত ও ৪ হাজার ৪০০ জন আহত হয়। আর ইসরায়েলের ১৫৮ জন নিহত হয়, যাদের অধিকাংশই ছিল সেনাসদস্য।
২০০৯ – হিজবুল্লাহর নতুন ইশতেহার
ইসরায়েলের বিরোধিতা ও ইরানের প্রতি সমর্থনের মধ্যেই হিজবুল্লাহ ২০০৯ সালে তাদের নতুন ইশতেহার প্রকাশ করে। এতে তারা গণতান্ত্রিক সরকারের অংশ হতে চাওয়ার বাসনা জানায়। তবে ওই ইশতেহারেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়।
২০১২ – সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সমর্থনে হিজবুল্লাহর সদস্যরা দেশটিতে প্রবেশ করে। তখন আরব বিশ্বের অনেকেই হিজবুল্লাহর এমন পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছিল। গোষ্ঠীটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা সুভি আল তোফায়েলি নিন্দাও জানিয়েছিলেন।
তবে হিজবুল্লাহর সমর্থকরা মনে করেন, সিরিয়ায় হিজবুল্লাহর সেনাদের প্রবেশের ফলে ইসলামিক স্টেটের অগ্রগতি থেমে গিয়েছিল।
২০২৩ থেকে ২০২৪ – গাজা
গাজার প্রতি সংহতি জানিয়ে গত বছরের অক্টোবরে ইসরায়েলে রকেট হামলা চালায় হিজবুল্লাহ। জবাবে ইসরায়েলও হামলা চালায় লেবাননে। এ পর্যন্ত ইসরায়েলের হামলায় ৫৬৬ লেবানিজ নিহত ও ৯৭ হাজারের বেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ১৩৩ জনই বেসামরিক নাগরিক।
অন্যদিকে হিজবুল্লাহর হামলায় উত্তর ইসরায়েল ছাড়তে হয়েছে ৬০ হাজার ইসরায়েলিকে।
গাজাকে কেন্দ্র করে হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের উত্তেজনার মধ্যেই একাধিক গোপন হামলা চালায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। এসব হামলায় তেহরানে অবস্থানরত হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া ও বৈরুতে হিজবুল্লাহর কমান্ডার ফুয়াদ শুকুর নিহত হয়। এই দুই ঘটনায় নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্য।
পেজার হামলা
বৈরুতে গত ১৭ সেপ্টেম্বর একযোগে বহু জায়গায় পেজার বিস্ফোরণ হয়। হিজবুল্লাহ সদস্যদের যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত পেজার টার্গেট করে হামলা চালানো হয়। এজন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে লেবানন কর্তৃপক্ষ। প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দেয় হিজবুল্লাহ।
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা