ছয় দশকের সঙ্গীত জীবনে কালজয়ী অসংখ্য গান উপহার দিয়েছেন রুনা লায়লা। উপমহাদেশের খ্যাতিমান সব সুরকার আর কণ্ঠশিল্পীদের সাথে গান করেছেন, গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম এসেছে। রুনা লায়লা সেই অল্প কয়েকজন সঙ্গীতশিল্পীদের মধ্যে অন্যতম যারা সমানভাবে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে জনপ্রিয়।
লোকজ, পপ, রক, গজল, আধুনিক- সব ধাঁচের গানই গেয়েছেন তিনি। রুনা লায়লা বাংলা, উর্দু, পাঞ্জাবি, হিন্দি, সিন্ধি, গুজরাটি, বেলুচি, পশতু, ফার্সি, আরবি, মালয়, নেপালি, জাপানি, স্পেনীয়, ফরাসি, ইতালীয় ও ইংরেজি ভাষাসহ মোট ১৮টি ভাষায় ১০ হাজারেরও বেশি গান করেছেন।
তবে অনেকেই জানেন না, সঙ্গীতের রানি হলেও, আদতে তিনিও শিল্পচর্চা শুরু করেছিলেন নাচ দিয়ে। রুনার ছোটবেলার অনেকটাই কেটেছে পাকিস্তানের করাচিতে। বাবা এমদাদ আলি ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। মা আমিনা লায়লা তাকে করাচির বুলবুল অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে নাচ শেখার জন্য ভর্তি করে দিয়েছিলেন। সেখানেই চার বছর ধরে কত্থক আর ভরতনাট্যম শিখছিলেন রুনা।
রুনা যখন নাচ শিখতেন, তখন তার বোন দিনা লায়লা গানের তালিম নিতেন আবদুল কাদের, হাবিব উদ্দিন আহমেদের কাছে। সেসব গান শুনে শুনেই মুখস্থ করে ফেলতেন ছোট্ট রুনা। গুনগুন করে গাইতেন নিজের মতো। একদিন রুনার সেই গানই শুনতে পেয়েছিলেন ওস্তাদ আবদুল কাদের। তাই শুনে মুগ্ধ হন তিনি, বলেন, একদিন গানের জগতেই অনেক সুনাম কুড়োবে রুনা লায়লা। সেদিন ওস্তাদজির কথা সকলেই শুনেছিলেন। গান শেখানোর জন্য ভর্তিও করেছিলেন।
রুনা প্রথম মঞ্চে গান করেন ছয় বছর বয়সে, কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই। করাচির ঢাকা ওল্ড বয়েজ অ্যাসোসিয়েশনের অনুষ্ঠানে বোন দিনার গান গাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অনুষ্ঠানের আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন দিনা। তাই তার জায়গায় ছোট বোন রুনা গেয়ে দেন। তানপুরা বাজিয়ে গান গেয়ে সেদিন আসর মাত করেছিলেন রুনা।
ছয় বছর পর, ১৯৬৪ সালে রুনা লায়লার বয়স যখন ১২ বছর, তখন প্রথম গান রেকর্ড করার প্রস্তাব আসে, তাও আবার সিনেমার। নারাজ বাবাকে অতি কষ্টে রাজি করিয়ে, করাচির ইস্টার্ন স্টুডিওতে উর্দু ছবি ‘জুগনু’র একটি গান রেকর্ড করে রুনা। সে গানের নাম ছিল, ‘গুড়িয়া সি মুন্নি মেরি’। পর্দায় ১২ বছরের একটি ছেলের ঠোঁটে ছিল গানটি। ছবির সংগীত পরিচালক মনজুর হোসেনের কাছে এক মাস ধরে অনুশীলন করে এই গান রেকর্ড করেছিলেন রুনা।
একবার এক সাক্ষাতকারে রুনা লায়লা বলেছিলেন, “সিনেমায় গাওয়ার কিছু কৌশল আমাকে শিখিয়ে দেন মনজুর হোসেন সাহেব। আমার গানের গলা ভালো ছিল, কিন্তু তা ঘষে-মেজে পলিশ করেন মনজুর সাহেব। মনে হয়, এই তো সেদিন! এত বছর হয়ে গেল!“
সেই সময়েই আরও কয়েকটি গান করতে গিয়ে রুনার নাম ছড়িয়ে পড়ে, কাজ বাড়তে থাকে। একদিকে পড়াশোনা, অন্যদিকে গান। একই দিনে বিভিন্ন স্টুডিওতে ৬-৭টি গানও রেকর্ডিং করতেন তিনি। ভোর ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত অবিরাম কাজ করতেন। ফলে বাংলা সিনেমাতে গান গাওয়ার প্রস্তাব পান রুনা। পরিচালক নজরুল ইসলাম এবং সঙ্গীত পরিচালক সুবল দাস ‘স্বরলিপি’ সিনেমার জন্য রুনার গান রেকর্ডিং করতে লাহোরে গিয়েছিলেন।
এর পরে বাংলাদেশে চলে আসেন রুনা, প্রস্তাব আসতে থাকে একের পর এক গানের। রুনার নিজের ভাষ্যের তার সঙ্গীতজীবন ছিল ‘খুবই মসৃণ’।
“প্রথম গান গাওয়া থেকে শুরু করে কখনওই কারও কাছে যেতে হয়নি, বাড়িতে এসে গান করে দিয়ে গেছেন পরিচালকরা। আমাকে কিছুই করতে হয়নি, স্ট্রাগল করা কাকে বলে, আমি জানতেও পারিনি,” এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন তিনি।
জন্মদিনে রুনা লায়লার উপহার ‘দ্য রুনা লায়লা’
১৯৫২ সালের ১৭ নভেম্বর সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন রুনা লায়লা। জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিবছর ভক্ত, স্বজন, পরিবার ও শুভানুধ্যায়ীদের শুভেচ্ছা ও উপহার পেয়ে আসছেন । ৭২ বছরে পা দিয়ে এবার তিনি সবাইকে দিলেন উপহার।
“আমার প্রতি জন্মদিনে আপনারা অনেক শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান, ভালোবাসা দেন, উপহার দেন। সেই সঙ্গে দোয়া-আশীর্বাদ তো থাকেই আপনাদের। ভাবছি আমার এবারের জন্মদিনে আপনাদের একটা উপহার দেবো” ফেইসবুকে এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন রুনা লায়লা। তার সেই উপহারটি হলো অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ‘দ্য রুনা লায়লা’।
রুনা লায়লা আরও বলেন, “গানের জগতে আমার ৬০ বছরের পথচলায় যা কিছু করেছি এবং আগামীতে কী করতে চাই সেগুলো তুলে ধরতে আপনাদের সবাইকে পাশে চাই। আপনাদের ভালোবাসা যেন থাকে। আপনারা ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। নিজের যত্ন নেবেন। আমি সবাইকে ভালোবাসি। অনেক ধন্যবাদ।”
ভিডিও বার্তা শেয়ার দিতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে রুনা লায়লা লিখেছেন, “জন্মদিনের শুভেচ্ছার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ! আমার অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল শেয়ার করে বেশ উচ্ছ্বসিত লাগছে।”
রুনা লায়লার অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করা প্রথম কন্টেন্ট হলো ‘শিল্পী আমি তোমাদেরই গান শোনাবো’-এর ভিডিও। বিটিভিতে প্রচারিত হয়েছে তার এই পরিবেশনা। গানটি লিখেছেন মাসুদ করিম, সুর করেছেন সুবল দাস।