সাপের কামড়কে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবহেলিত স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা হয়। বিশেষ করে দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলে এই সমস্যা প্রকট।
সম্প্রতি বাংলাদেশে বিষাক্ত রাসেলস ভাইপারের কামড়ে কয়েক জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এনিয়ে সামাজিক পর্যায়ে এক প্রকার উত্তেজনা চলছে। ফলে সাপের কামড়ের প্রতিষেধকের (অ্যান্টিভেনম) বিষয়টি ফের আলোচনায় উঠে এসেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) থেকে শুরু করে একাধিক সংস্থার রিপোর্ট বলছে, বিশ্বে প্রতি বছর যত মানুষ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়, সেই অনুসারে প্রতিষেধক উৎপাদন হয় না। কেন এই উৎপাদন হয় না এবং সমস্যা কোথায়, এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
বছরে বিশ্বে সাপের কামড়ে প্রায় ৫৪ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ১৮ থেকে ২৭ লাখের ক্ষেত্রে বিষক্রিয়া দেখা দেয়। একই সময়ে সাপের কামড়ে ৮১ হাজার ৪১০ থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৮৮০ জন মানুষ মারা যায়। এর পাশাপাশি বছরে সাপের কামড়ের কারণে মৃতের তিনগুণ বেশি মানুষের নানা স্থায়ী অক্ষমতা দেখা দেয়।
বিষাক্ত সাপের কামড়ে যেসব শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়, এর মধ্যে শ্বাসকষ্ট, রক্তক্ষরণ, কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া ও পক্ষাঘাতগ্রস্ততার মতো জটিলতা রয়েছে।
উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের অনেক দেশে বিষাক্ত সাপের কামড় একটি উপেক্ষিত জনস্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্বের অধিকাংশ সাপের কামড়ের ঘটনাই আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকায় ঘটে। প্রতি বছর এশিয়ায় প্রায় ২০ লাখ মানুষ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়। আর আফ্রিকায় এই সংখ্যা ৪ লাখ ৩৫ হাজার থেকে ৫ লাখ ৮০ হাজার।
ডব্লিউএইচওর মতে, সবার জন্য অ্যান্টিভেনম সহজলভ্য করলে সাপের কামড়ে আক্রান্তদের মৃত্যু ও জটিল পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব। উচ্চমানের অ্যান্টিভেনম সাপের বিষের প্রভাব নষ্ট করতে পারে।
যেভাবে তৈরি হয় অ্যান্টিভেনম
প্রথমে বিভিন্ন প্রজাতির সাপের বিষ সংগ্রহ করা হয়। এই বিপজ্জনক কাজটি করে একদল বিশেষজ্ঞ। এদের সংখ্যা বিশ্বে কম। সাপের বিষগ্রন্থি থেকে বিষ সংগ্রহের এই প্রক্রিয়াকে বলে ‘মিল্কিং’।
সংগ্রীহিত বিষ প্রথমে পরীক্ষাগারে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এসময় বিষের বিভিন্ন উপাদান যেমন- প্রোটিন, এনজাইম ও টক্সিন আলাদা করা হয়। সাপের বিষ হলো একাধিক জটিল বিষাক্ত পদার্থের সংমিশ্রণ। এই বিষে থাকা কিছু এনজাইম ও প্রোটিন স্নায়ু কোষের সংকেতকে বাধাগ্রস্ত করে।
অ্যান্টিভেনম তৈরির জন্য ওই প্রক্রিয়াজাত বিষ ঘোড়া, খরগোশ বা ভেড়ার মতো প্রাণীদের শরীরে প্রবেশ করানো হয়। অল্প অল্প ডোজে একাধিকবার এই বিষ দেওয়ার ফলে ওই প্রাণীদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। পরে এগুলো বিশেষজ্ঞরা ওই প্রাণীদের রক্ত থেকে সংগ্রহ করেন।
সংগ্রহ করা অ্যান্টিবডিগুলো বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের সঙ্গে মিশিয়ে অ্যান্টিভেনম তৈরি করা হয়। এতে অ্যান্টিভেনমটি সহজে সংরক্ষণযোগ্য হয়ে ওঠে।
এই পুরো প্রক্রিয়াটি একদিকে যেমন জটিল, তেমনি সময় ও ব্যয়সাধ্য। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানই সক্ষমতা থাকলেও অ্যান্টিভেনম তৈরিতে আগ্রহী হয় না। কারণ শুধু অ্যান্টিভেনম তৈরি করলেই হচ্ছে না, এর কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও অনেক জটিল।
অ্যান্টিভেনম উৎপাদনে জটিলতা
অ্যান্টিভেনম তৈরির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হলো প্রয়োজনীয় সাপের বিষ সংগ্রহ করা। খুব কম দেশেরই পর্যাপ্ত মানের সাপের বিষ সংগ্রহের ক্ষমতা রয়েছে। ফলে বৈশ্বিক চাহিদা অনুসারে অ্যান্টিভেনম চাইলেও তৈরি করা যায় না।
এছাড়া সাপের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক বৈচিত্র্যও অনেক বড় চ্যালেঞ্জের। কারণ বিভিন্ন অঞ্চলের একই প্রজাতির সাপের বিষের রাসায়নিক গঠন এক নয়। ফলে বাজারে পাওয়া অ্যান্টিভেনম সবসময় নির্দিষ্ট এলাকার সাপের বিষের বিরুদ্ধে কার্যকর নাও হতে পারে।
অধিকাংশ দেশেই অ্যান্টিভেনমের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রক কাঠামো নেই। এতে অনেক সময়ই মানহীন অ্যান্টিভেনম বাজারে প্রবেশ করে, যা রোগীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
অঞ্চলভেদে অ্যান্টিভেনমের দামে পার্থক্য হয়। সাব-সাহারান আফ্রিকায় এক ভায়াল অ্যান্টিভেনমের দাম ১৮ থেকে ২০০ ডলার পর্যন্ত হয়। আবার যুক্তরাষ্ট্রের কিছু জায়গায় একই ভায়ালের দাম ১৭ হাজার ডলার পর্যন্ত হতে পারে। দামের এই পার্থক্য হওয়ার অন্যতম কারণ উৎপাদন খরচের চেয়ে স্বাস্থ্যসেবা খাতে অর্থায়নের বিষয়টি।
তবে ভারতে উৎপাদিত অ্যান্টিভেনমের দাম বিশ্বের অন্য জায়গায় তুলনায় কম। দেশটিতে প্রতি ভায়াল অ্যান্টিভেনম সাড়ে ৬ থেকে ১১ ডলারে বিক্রি হয়। কিন্তু এই অ্যান্টিভেনমের মান অন্যদের তুলনায় ভালো না। ফলে ভারতেও বছরে অনেক মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়।
ভারতের হাসপাতালগুলোতে মূলত প্রধান চার সাপের (কোবরা, ক্রাইট, খড়ের রংয়ের ভাইপার ও রাসেলস ভাইপার) বিষের প্রতিষেধক হিসাবে পলিভ্যালেন্ট (বহুমুখী) অ্যান্টিভেনম ব্যবহার করে। কিন্তু দেশটিতে ৬০ প্রজাতির চেয়ে বেশি বিষাক্ত সাপ রয়েছে। এসব সাপের কামড়ের বিরুদ্ধে সবসময় কার্যকরী হয় না পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম।
অ্যান্টিভেনমের উৎপাদন কম হওয়ার আরেক কারণ পরিবহন ব্যবস্থা। প্রতিষেধকটি তৈরির পরই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্থানে রাখতে হয়। অনেক দেশেরই এমন প্রতিষেধক পরিবহনে প্রয়োজনীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যানবাহন নেই। ফলে বিশেষ করে দারিদ্র্যপীড়িত অনেক অঞ্চলে অ্যান্টিভেনম পাঠানো যায় না।
অ্যান্টিভেনম সংকটের কারণ
বর্তমানে অ্যান্টিভেনম সংকটের পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে সাপের কামড়ের তথ্যের অভাব, অকার্যকর বিতরণ নীতি, অর্থনৈতিক সমস্যা ও গবেণার অভাবের মতো বিষয়গুলো চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
অঞ্চলভেদে বছরে কত সংখ্যক মানুষ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হচ্ছে, এর সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। আবার অকার্যকর বিতরণ নীতির কারণে অ্যান্টিভেনম প্রস্তুতকারকরা উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে বা দাম বাড়িয়েছে।
অ্যান্টিভেনম তৈরি করা বেশ ব্যয়সাধ্য। বিশ্বে এমনিতেই হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অ্যান্টিভেনম তৈরি করে। অর্থনৈতিক সমস্যা বিশেষত বিনিয়োগের অভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কয়েকটি এরই মধ্যে উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে।
গত ২০ বছরে অ্যান্টিভেনমের দাম নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। এই কারণে অনেক সাপে কাটা রোগী চাইলেও অর্থাভাবে অ্যান্টিভেনম নিতে পারেন না। বাড়তি দামের কারণে কিছু দেশ এখন আর সাপের বিষ কিনছে না। আবার নকল অ্যান্টিভেনমের কারণেও এর প্রতি মানুষের আস্থা কমছে।
বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক দেশে অ্যান্টিভেনম সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর এতে বছরে বহু মানুষের মৃত্যু হতে পারে।
অবহেলিত স্বাস্থ্য সমস্যা
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনার ভেনম ইমিউনোকেমিস্ট্রি, ফার্মাকোলজি এবং ইমার্জেন্সি রেসপন্স (ভাইপার) ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক লেসলি বোয়ারের মতে, “সাপের কামড় অনেক বড় সমস্যা। প্রায় ১২০ বছর ধরে আমরা জানি কীভাবে অ্যান্টিভেমন তৈরি করতে হয়।”
কিন্তু এখনও এটি তৈরির নির্দিষ্ট কোনও ফর্মুলা নির্দেশিকা আকার দেওয়া যায়নি বলে জানান বোয়ার।
এতো বছর ধরে অ্যান্টিভেনম তৈরি হলেও এখনও এর প্রক্রিয়া নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও নির্দেশিকা নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটি ঠিক করার চেষ্টা করছে। গত কয়েক মাস আগে ডব্লিউএইচও কিছু অ্যান্টিভেনমের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। এটি অ্যান্টিভেনম উৎপাদক, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, সংগ্রহকারী সংস্থা ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সাপের কামড়ে আক্রান্তদের চিকিৎসায় সহায়ক হবে।
ডব্লিউএইচও বলছে, অ্যান্টিভেনম তৈরিতে ব্যবহৃত সাপের বিষের প্রোফাইল সম্পর্কে জানার ফলে উৎপাদনে ব্যয় কমবে।
শীর্ষ অ্যান্টিভেনম উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ও বাজারের আয়তন
ইয়াহু ফাইন্যান্স বলছে, বিশ্বব্যাপী অ্যান্টিভেনম বাজারের আকার ২০২৩ সালে ১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল। ২০৩২ সালের মধ্যে এই বাজার ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে। বলা হচ্ছে, ২০২৩ থেকে ২০৩২ সালের মধ্যে ৬ দশমিক ১৬ শতাংশ হারে এই বৃদ্ধি হবে।
বিশ্বের খুব বেশি প্রতিষ্ঠান অ্যান্টিভেনম তৈরি করে না। যেসব প্রতিষ্ঠান এটি তৈরি করে এর মধ্যে রয়েছে, মেক্সিকোর বায়োক্লন এস এ ডি সিভি, ভারতের ভারত সিরাম অ্যান্ড ভ্যাকসিন লিমিটেড (বিএসডি), জার্মানির বোয়েরিংগার ইঞ্জেলহেইম ইন্টারন্যাশনাল জিএমবিএইচ, যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন সায়েন্টিফিক কারপোরেশন, অস্ট্রেলিয়ার সিএসএল লিমিটেড, ভারতের হ্যাফকিন বায়ো-ফার্মাসিউটিক্যাল করপোরেশন, বাংলাদেশের ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, জার্মানির মার্ক কেজিএ এবং সুইজারল্যান্ডের ফাইজার এজি।
ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস যে শিল্প পরিবারভুক্ত, সেই ইমপ্রেস গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান চ্যানেল আইর বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ মঙ্গলবার গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে রাসেলস ভাইপার সাপ নিয়ে আতঙ্কের কথা তোলেন।