সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে ঘিরে গত কয়েকদিনে সংঘাত-সহিংসতায় দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানির বিচার দাবি করেছে বিভিন্ন প্রতিবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা।
শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমবেত হয়ে তারা এই দাবি জানান। এ সময় সেখানে ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে এই জনতা’, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’-এর মতো বিভিন্ন প্রতিবাদী গান পরিবেশন করা হয়।
এক পর্যায়ে সমবেতদের কণ্ঠে শোনা যায় স্লোগান– ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন সংগঠনের এই প্রতিবাদ সমাবেশে সংহতি জানিয়ে শুক্রবার প্রেসক্লাবের সামনে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোকজনের সরব উপস্থিতিও দেখা গেছে।
সমাবেশের প্রতি সংহতি জানিয়ে সেখানে বক্তব্য দেন দৈনিক সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা নিত্রা ও আইনজীবী সারা হোসেন।
আবু সাঈদ খান বলেন, “আমি এই আন্দোলনে সংহতি জানাই। বেদনা ভারাক্রান্তভাবে বলতে চাই, ’৬৬ সালে মিছিলে ছিলাম, ’৬৯ সালে মিছিলে ছিলাম। স্বাধীনতা পরবর্তী সবগুলো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু এত রক্ত দেখিনি। মাত্র ৭ দিনে বিভিন্ন পত্রিকার সংবাদ অনুসারে দুই শতাধিক প্রাণ ঝরে গেছে। অনেক সম্পদেরও ক্ষতি হয়েছে।”
কিন্তু তদন্তের আগেই এই ক্ষয়ক্ষতির জন্য কারা জড়িত তাদের নাম বলে দেওয়া হলে তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে বলে মনে করেন জ্যেষ্ঠ এই সাংবাদিক। তিনি বলেন, “কারা এই ক্ষতি করেছে আগেই যদি আপনি তাদের নাম বলে দেন, তাহলে তো মনে হতেই পারে তদন্ত প্রভাবিত হবে।”
এই আন্দোলন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পরিণত হয়েছে মন্তব্য করে আবু সাঈদ খান বলেন, “ছাত্র সমাজের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের সাথে হকার, শ্রমজীবী মানুষ, সাধারণ মানুষের যুক্ততায় এখন এটা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। এ আন্দোলন এখন শুধু ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন নয়, এটি দেশের মানুষের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।
“এই আন্দোলন জবাবহীনতার বিরুদ্ধে, সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ একনায়কত্ববাদের বিরুদ্ধে জনগণ একত্রিত হয়েছে। তাই আজকে আন্দোলনকে প্রতিহত করতে যত ষড়যন্ত্রই থাক, আজকে জনগণকে রাস্তায় নামতে হবে, একত্রিত হতে হবে।”
অধ্যাপক সামিনা লুৎফা নিত্রা বলেন, “একটি স্বৈরশাসনের আমল আমরা পার করছি। এই স্বৈরশাসকের হাতে দুইশর বেশি প্রাণের রক্ত লেগে আছে। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং হিসাব যদি আমরা করতে চাই তাহলে আমাদের ভবিষ্যতের কাজ নিয়ে পরিষ্কার থাকতে হবে।”
তিনি বলেন, “যারা গত কয়েকদিনে মারা গেছেন, হাজার হাজার আহত হয়েছেন, মিথ্যা মামলায় হাজার হাজার মানুষকে যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের পরিসংখ্যান আমাদের তৈরি করতে হবে। এসব হত্যা ধামাচাপা দেওয়ার কাজ চলছে। আমাদের কাজ এই হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিতে না দেওয়া। এসব হত্যা হারিয়ে যেতে আমরা দেব না।”
টিভি চ্যানেলগুলো এসব কাজে সরকারকে সহযোগিতা করছে– এমন অভিযোগ করে ঢাবির এই অধ্যাপক বলেন, “তারা (টিভি চ্যানেলগুলো) শুধু রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসের হিসাব দিচ্ছে। কিন্তু এই সম্পদ আমার করের টাকায় কেনা। এই চ্যানেলগুলো মানুষের মৃত্যুর কথা বলছে না। সবকিছুর আগে মানুষের প্রাণ। এই প্রাণের কথা বলতে হবে। প্রতিটি প্রাণের হিসাব দিতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “বিভিন্ন মতের মানুষ বাংলাদেশে আছেন। কিন্তু আজকে যদি একটি গণতান্ত্রিক স্পেস তৈরি করতে আমরা না পারি, তাহলে এই স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আমরা পারব না। আমাদের সবাইকে একত্রিত হতে হবে দেশকে রক্ষা করার জন্য।”
সমাবেশে আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, “আমরা সবাই দেখেছি, সবাই শুনেছি, ছাত্ররা যখন শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করছিল সারা বাংলাদেশে তখন পুলিশ তাদের উপর গুলিবর্ষণ করেছে। কিন্তু আজকে টিভি চ্যানেলগুলোর দিকে কিংবা আমাদের মন্ত্রীদের দিকে তাকালে মনে হয় কিছুই হয় নাই। কেউ মরেনি,কোন লাশ পড়েনি। তারা শুধু বলছে কিছু বিল্ডিংয়ের ওপর হামলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করেছে।
“আমি প্রশ্ন রাখতে চাই– সম্পদ বড় নাকি প্রাণ বড়। আমাদের দেশের সন্তানদের হত্যার বিচার চাইতে হবে। শুধু চাইলেই হবে না নিশ্চিত করতে হবে, তা নাহলে আমাদের স্বাধীনতা মিথ্যা হয়ে যাবে।”
বক্তব্যের মাঝে মাঝেই প্রতিবাদী গান ও কবিতা পাঠ চলতে থাকে। প্রেসক্লাব থেকে ১২টা ২০ মিনিটের দিকে গানের মিছিল নিয়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কর্মীরা শহীদ মিনারের দিকে রওনা হন। তবে পুলিশি বাধায় সেদিকে যেতে না পেরে পুরানা পল্টন মোড়ে গিয়ে গানের মিছিল শেষ করেন তারা।