Beta
বুধবার, ৮ মে, ২০২৪
Beta
বুধবার, ৮ মে, ২০২৪

কলাম

সোশাল মিডিয়া বনাম লিগেসি মিডিয়া: বিশ্বাস কোথায়

আফরোজা সোমা। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার

‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে’:

প্রবাদে আছে, ‘ যে কহে বিস্তর, সে কহে বিস্তর মিছা’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই যুগে কি সেই পুরনো প্রবাদ বিশেষভাবে সত্য হয়ে উঠেছে? এই লেখা সেই বিষয়েই খানিকটা অনুসন্ধান করবে।   

তথ্যের জোয়ার নয়, চারিদিকে তথ্যের সুনামি বইছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পাল্টে দিয়েছে মানবজাতির তথ্যের চাহিদা ও যোগানের অভ্যাস। তথ্যভুখ নেটিজেনরা ২৪/৭ যুক্ত থাকছে ইন্টারনেটে। নইলে ‘কী না-জানি কী মিস হয়ে যায়’ ভাবনায় তারা আক্রান্ত হচ্ছে।

কিতাবী ভাষায় সেইসব ভয়-ভীতিকে ডাকা হচ্ছে ‘ফোমো’। মানে ‘ফিয়ার অফ মিসিং আউট’। অর্থাৎ ফেবু বা ইন্সটা বা সোশাল মিডিয়ায় না থাকলে কি না-জানি কী মিস হয়ে যায়, এই ভাবনায় সারাক্ষণ সংযুক্ত থাকা।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপরে মানুষের নির্ভরশীলতা দিন দিন বেড়েছে। ২০২১ সালের ৭ই এপ্রিল পিউ রিসার্চ সেন্টার তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, প্রতি ১০জনের মধ্যে ৭ জন মার্কিন নাগরিক একে অন্যের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপর নির্ভরশীল।

যুক্ত থাকার মাধ্যমে তারা মূলত বিভিন্ন সংবাদ আধেয় জানা, নানাবিধ তথ্য সর্ম্পকে নিজে জানা বা অন্যকে জানানো এবং নিজেদেরকে বিনোদিত করার কাজগুলো করে থাকে।

তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের গতি-প্রকৃতি ঠিক কোন দিকে যাচ্ছে? এই বিষয়ের উপরে ধারাবাহিকভাবে নজর রাখছিল পিউ রিসার্চ সেন্টার। উল্লিখিত সেই প্রতিবেদনে পিউ জানাচ্ছে, সোশাল মিডিয়া ব্যবহারের প্রবণতা মানুষের মধ্যে কী রকম এই বিষয়টি তারা প্রথম পর্যবেক্ষণ করা শুরু করে ২০০৫ সালে।

সেই সময়ে প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে মোটে ৫ শতাংশ মানুষ সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করত। কিন্তু পরবর্তী কয়েক বছরে এর ব্যবহার তীব্র গতিতে বাড়তে থাকে।

দেখা যায়, ২০১১ সালে আমেরিকার প্রায় অর্ধেক মানুষ সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছে। আর ২০২১ সাল নাগাদ সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭২ শতাংশ।

মার্কিনিরা সোশাল মিডিয়ার যে প্লাটফর্মগুলো ব্যহার করেন এর মধ্যে সবার উপরে রয়েছে, ইউটিউব ও ফেইসবুক। এর বাইরে বাকি যে প্ল্যাটফর্মগুলো জনপ্রিয়তায় উপরের দিকে আছে সেগুলো হলো, টুইটার, পিন্টারেস্ট, ইনস্টাগ্রাম ও লিংকডইন।

চারিদিকে তথ্যের জোয়ার নয়, সুনামি চলছে। এই সুনামির মধ্যে সত্য আর মিথ্যা যখন আলাদা করা যাচ্ছে না তখন এই যুগে মানুষ মৌলিকভাবেই গণমাধ্যমের দিকে আরও বেশি ঝুঁকবে।

চটকের যুগে বিশ্বাসযোগ্যতা:

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনও তথ্য দিলে মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।

চাঁদে সাঈদীর মুখ হোক, ব্রাহ্মবাড়িয়ার নাসিরনগরে রসরাজ দাসের নামে ছড়ানো ফেইসবুকের ভুয়া পোস্ট হোক বা হোক এটিএম শামসুজ্জামান অথবা অমর্ত্য সেনের মৃত্যুর অসত্য সংবাদ— ফেইসবুকে আসা মাত্রই দাবানলের মতন তা ছড়িয়ে যায়।

সত্য না অসত্য সেই বিবেচনা ভস্ম হয়ে যায় ‘ভাইরাল পোস্টের’ দাবানলে।

কথায় আছে, যার যেটা শক্তি তার সেটিই দুর্বলতা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। অতি দ্রুত, ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি এবং ব্যক্তি থেকে বহু বা গণ’র সাথে যোগাযোগ করার এই অকল্পনীয় সুযোগের সুবাদে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে মাথা চাড়া দিয়েছে আপদ এবং বিপদ।

ভুল করে নিরীহ, নির্বিষ ভুল তথ্য ছড়ানোতে হয়ত বিশেষ ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই। তাই, এটাকে হয়ত আমরা আপদ বলতে পারি।

কিন্তু কুরুক্ষেত্রের ময়দানের মতন কোনও ‘যুধিষ্ঠির’ যদি প্রতিপক্ষ দ্রোণকে ঘায়েল করার উদ্দেশ্যে ‘অশ্বথামা হত, ইতি গজ’ বলে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেন, তখন তা বিপদ বৈকি! কেননা এর প্রভাব হবে রক্তক্ষয়ী ও সুদূর প্রসারী।

বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই হয়ে উঠেছে ‘মিসইনফরমেশান’, ‘ডিজইনফরমেশান’, ‘মেলইনফরমেশান’ এবং ‘ক্লিকবেইট’ জার্নালিজমের প্রধান উৎস ও কারণ।

লাইক, শেয়ার, ভিউ পেতে জনতা মরিয়া। যত লাইক তত টাকা। যত ভিউ তত কড়ি। ফলে, চারিদিকে চটকের ছড়াছড়ি। চটকের যুগে বিশ্বাসযোগ্যতা হয়ে উঠেছে সোনার হরিণ।

সোশাল মিডিয়া পৃথিবীতে আবির্ভূত হবার আগে পৃথিবীতে বেদবাক্য বা অলংঘনীয় সত্য ছিল, ‘সিয়িং ইজ বিলিভিং’।

সাংবাদিকতায় আরেকটা বেদবাক্য ছিল, ‘আ পিকচার ইজ ওর্থ আ থাউজেন্ড ওয়ার্ডস’। মানে আপনি হাজার শব্দ দিয়ে যা বোঝাতে চাইবেন, একটা ছবিই তা বুঝিয়ে দিতে পারে।  

জামানা বদলে গেছে। এখন আর নেই সেই সাবেকী মিডিয়ার যুগ। নিউ মিডিয়া ও সোশাল মিডিয়ার এই নয়া যুগে তৈরি হয়েছে নয়া বাস্তবতা। তাই, ফেক নিউজ, ডিপ ফেক, আর আর্টিফিশায়ল ইন্টেলিজেন্স হয়ে উঠেছে আমাদের এখনকার দৈনন্দিন আলোচনার বিষয়।

অর্থাৎ নয়া-মাধ্যমের এই যুগে ঝড়ে ভাঙা গাছের মতন মুখ থুবরে পড়েছে ‘সিয়িং ইজ বিলিভিং’ এবং ‘আ পিকচার ইজ ওর্থ আ থাউজেন্ড ওয়ার্ডস’ এর মতন পুরনো বেদবাক্যাবলী।

এখন আর ‘সিয়িং ইজ বিলিভিং’ বলার সুযোগ নেই। কারণ বিশ্বাসকে পুঁজি করে, বিশ্বাসের ঘরেই চুরি করে সোশাল মিডিয়ায় ঘাপটি মেরে থাকা দুষ্টুচক্রের দল।

লোকের বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবেই ভুয়া ছবি, ভিডিও ও অডিও দিয়ে স্থিরচিত্র ও ভিডিও তৈরি করা হয়। তারপর, বিভিন্ন উদ্দেশ্যে সেগুলো ছড়িয়ে দেয়া হয় ইউটিউব, ফেইসবুকসহ অন্যান্য সোশাল মিডিয়ায়।  

তাই, এখন বলতে হচ্ছে, আগের দিন বাঘে খেয়েছে। কোনও কিছুর ছবি বা ভিডিও দেখলেই তা ‘নির্ভুল সত্য’ হবে, এমন নয়।

সোশাল মিডিয়ার এই যুগের নতুন সত্য হতে হবে, ‘সিয়িং ইজ ডিজবিলিভিং’। অর্থাৎ সোশাল মিডিয়ায় কোনও তথ্য বা ছবি দেখলে সেটিকে সত্য বলে বিশ্বাস করার আগে, প্রশ্ন করতে হবে, ‘এই ছবি সত্য নাকি বানোয়াট’?  

‘এগুলা ইডিট করা যায়, ভাইয়া’:

সোশাল মিডিয়ায় পাওয়া তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে জানতে ইউনিসেফ এবং গ্যালপ মিলে ২০২১ সালে একটি গবেষণা করেছিল। প্রাপ্ত ফলাফল বলছে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে অন্তত ৪৫ শতাংশ  সোশাল মিডিয়াকে তথ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহার করে।

কিন্তু কৌতুহল উদ্দীপক ব্যাপার হলো, তারা সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোকে তথ্য পাবার উৎস হিসেবে বিবেচনা করলেও, প্রাপ্ত তথ্যকে পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য মনে করে না।

ইউনিসেফের চেন্জিং চাইল্ডহুড প্রজেক্ট-এর অংশ হিসেবে পৃথিবীর ২১টি দেশের ১৫-২৪ বছর বয়সীদের নিয়ে এই গবেষণা করা হয়। নিম্ন-মধ্য-উচ্চ সকল প্রকার আয়ের মানুষই এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ছিল বলেও জানাচ্ছে গ্যালপ।

প্রায় একই রকম তথ্য এসেছে পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণাতেও।

২০২১ সালে ৯ হাজার মার্কিন নাগরিকের উপর এক জরিপ চালায় পিউ। জরিপ জানাচ্ছে, সোশাল মিডিয়া থেকে পাওয়া তথ্যকে সঠিক বা নির্ভুল বা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করেন না ৫৯ শতাংশ মানুষ।

বাংলাদেশের বিষয়টা কী, সেই নিয়ে গবেষণার সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া আমাদের দেশে ডিজিটাল লিটারেসির ঘাটতি রয়েছে।

আপনাদের হয়ত মনে থাকবে, ২০২৩ সালের মে মাসের দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি ভিডিও ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছিল।

ভাইরাল সেই ভিডিওটিতে দেখা যায়, তিনি বিশ্বব্যাংক কার্যালয়ের সামনে। তার আশপাশে শোনা যাচ্ছে, ‘ভোট চোর’, ‘ভোট চোর’ স্লোগান।

এই ভিডিওর আধেয় দেখার পর সেটি নিয়ে প্রথমে নেটিজেনদের মধ্যে পরে ব্যাপকহারে জনপরিসরে দেখা দেয় সন্দেহ ও বিভেদ।

ভিডিও দেখে জনতার একাংশকে বলতে শোনো গেছে, এতো বড় ঘটনা ঘটেছে! প্রধানমন্ত্রীর সামনে ‘ভোট চোর’ বলে স্লোগান দেওয়া হয়েছে। অথচ দেশের কোনো মিডিয়াই এই খবর প্রকাশ করল না! সোশাল মিডিয়া না থাকলে তো এই খবর জানাই যেতো না!

অন্যদিকে, জনতার এই সন্দেহের জবাবে আওয়ামী লীগ শিবির থেকে বারবারই বলা হয়েছে, এটা ‘ভুয়া ভিডিও’।

আওয়ামী শিবির যখন ‘ভুয়া ভিডিও’ দাবি করেছে এর প্রতিউত্তরে আওয়ামী বিরোধী শিবিরকে বলতে শোনা গেছে, ‘ভুয়া ভিডিও বলে সত্য লুকানো যায় না’।

‘ভুয়া ভিডিও’ আর ‘সত্য ভিডিও’র এ হেন বিতর্কে পরে সাধারণ মানুষের অবস্থা হয়েছে তথৈবচ। তারা কোন দিকে যাবে!

এই বাস্তবতায় ‘ভোট চোর’ ভিডিওর সত্যতা যাচাই করতে অনুসন্ধানে নামে একটি ফ্যাক্ট চেক সংগঠন। 

তাদের অনুসন্ধানে উঠে আসে, বিশ্বব্যাংকের কার্যালয়ের সামনে শেখ হাসিনার ভিডিও চিত্রটি যে জায়গার, সেই জায়গাটি ঠিকই আছে। কিন্তু সেই ভিডিওটিকে এডিট করে অন্য আরেকটি পুরনো কন্টেন্ট থেকে কপি করে এনে ‘ভোট চোর’ সাউন্ড ট্র্যাকটি যোগ করে দেওয়া হয়। এভাবেই উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বানানো হয় শেখ হাসিনাকে বিশ্বব্যংকের সামনে বলা ‘ভোট চোর’ ভিডিওটি।

এভাবেই প্রমাণ হয়, সেটি ছিল ভুয়া ভিডিও।

বিশ্বাসই গণমাধ্যমের মূলধন:

পুরনো একটা ইংরেজি বচন আছে এরকম, Trust takes years to build, seconds to break,and forever to repair’. 

মানবীয় সম্পর্কে বিশ্বাস গড়তে লম্বা সময় লাগলেও ভাঙতে সময় লাগে না। আর একবার ভেঙে যাওয়া বিশ্বাস পুনরায় জোড়া লাগানো কঠিন বৈকি!

মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের মতোই গণমাধ্যমের সাথে পাঠক ও দর্শকের সম্পর্ক। কয়েক শতকের তিল তিল শ্রমে গণমাধ্যমের উপর বিশ্বব্যাপী তৈরি হয়েছে মানুষের আস্থা।  

যে কোনও কঠিন ও ধোঁয়াশাপূর্ণ সময় যেমন— যুদ্ধ, মারী, কারফিউ, বন্যা, সংঘর্ষ, দাঙ্গা বা গণঅভ্যুত্থান ইত্যকার সময়ে মানুষ গণমাধ্যমের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেননা, মানুষ মনে করে গণমাধ্যম যা বলে, সত্য বলে। গণমাধ্যম যা দেখায়, সত্য দেখায়।

মানুষ আরও মনে করে, যেখানে সাধারণ মানুষের পৌঁছানো সম্ভব না, সেখানেও গণমাধ্যম পৌঁছাতে পারে।

তাই, লিগেসি মিডিয়া তথা সাবেকী গণমাধ্যম যেমন রেডিও, টিভি, অনলাইন বা নিউজপেপারের দেওয়া সংবাদের উপরে মানুষের অগাধ বিশ্বাস।

কিন্তু অতি লোভে নষ্ট হওয়া তাঁতীর মতন, গণমাধ্যমও ‘নষ্ট’ হলো।

সোশাল মিডিয়ার সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে গণমাধ্যমও খবর প্রকাশের ভঙ্গিতে দিনে দিনে হয়ে উঠতে থাকল চতুর। তারাও শুরু করল, ‘দেখায় মুরগী, খাওয়ায় ডাইল’ টাইপ চালাকী।

মানে, শুরু হলো ক্লিকবেইট জার্নালিজম। শুরু হলো, ‘পাবলিককে টানার’ উদ্দেশ্যে ‘হট’ বা ‘সেক্সি’ শিরোনাম লেখার ধুন্দুমার প্রতিযোগিতা। যুগের পর যুগ ধরে ‘রেস্পন্সিবল’ জার্নালিজম করে আসা সংবাদ প্রতিষ্ঠানও তেমন শিরোনাম ও ছবি দিয়ে সোশাল মিডিয়ায় লিংক পোস্ট করা শুরু করল।

সোশাল মিডিয়া বিদ্যুৎগতিতে খবর দেয়। তাই, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রথাগত সংবাদ মাধ্যমগুলোর মধ্যেও ‘দ্রুততম সময়ে’ খবর দেওয়ার ‘হিড়িক’ পড়ে গেল।

‘জীবন যুদ্ধে এগিয়ে থাকার লড়াইয়ে’ নামতে গিয়ে, গণমাধ্যমগুলোও তার সবচে’ দামী কারেন্সি বা মূলধন ‘ট্রাস্ট’ বা ‘বিশ্বাস’ একটু একটু করে হারাতে শুরু করল।

উনিশ শতকে ইয়েলো জার্নালিজমের জন্মও হয়েছিল এইভাবে, পাঠক টানার জন্য এমন এক অসুস্থ প্রতিযোগিতার ভেতর দিয়েই।

সোশাল মিডিয়ার সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মূল তফাৎ কোথায়? তফাৎ খবর বিষয়ে তার আচরণে ও দৃষ্টিভঙ্গীতে।

কোনও একটি ঘটনা ঘটলেই সোশাল মিডিয়ার মতন ‘গেইট কিপিং’ হয় না এমন মাধ্যমে যে কেউ আনচেকড বা আনভেরিফাইড তথ্য দিয়ে দিতে পারে।

কিন্তু গণমাধ্যম কি তা পারে? এমনকি ‘অসমর্থিত সূত্রের’ বরাত দিয়েও কি গণমাধ্যম একেবারে ভিত্তিহীন খবর প্রচার করতে পারে?

উত্তর হচ্ছে, না। সাংবাদিকতার বৈশ্বিক মান ও নীতি অনুযায়ী সেটা তারা করতে পারে না।

কিন্তু বাংলাদেশের সাংবাদিকতার চিত্র কী বলছে?

এ টি এম শামসুজ্জামানের মৃত্যুর সংবাদের খবরের দিকে তাকিয়ে দেখলেই বাংলাদেশের বর্তমান সাংবাদিকতার দেউলিয়াত্ব বেরিয়ে আসে।  

কোনও একটি ‘ভুঁইফোড়’ মাধ্যম বা ফেইসবুক পোস্টে কেউ হয়তো লিখল, এটিএম শামসুজ্জামান হাসপাতালে বা মারা গেছেন। ব্যাস! অমনি শুরু হয়ে যায় প্রতিযোগিতা। খবরটা অনলাইনে প্রকাশ করার আগে এটিএম শামসুজ্জামানের পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করে সেটি যাচাই করে নেওয়ার নৈতিকতা বা হুঁশটুকুও অনেকের কাজ করে না।

এভাবেই, গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের বিশ্বাস একটু একটু করে উঠে যায়।

এটা তো গেল একটা দিক।

এছাড়াও, গণমাধ্যমের ‘দলকানা আচরণ’ও গণমাধ্যমের উপর থেকে অডিয়েন্সের বিশ্বাস উঠে যাবার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

গণমাধ্যমের সম্পাদক বা মালিকের  বা মালিকের প্রতিষ্ঠানের অন্যায়-দুর্নীতির ‘বিরাট ঘটনাকে’ও ‘ছোট খবর’ হিসেবে ট্রিটমেন্ট দেওয়া বা খবর হিসেবে একেবারে ‘হাপিস’ করে দেওয়ার উদাহরণ আমাদের আছে। আবার বিরোধী শিবিরের ‘ছোট ঘটনা’কেও ‘বড় খবর হিসেবে’ চাউড় করে প্রচার করার মতন উদাহরণও আছে ভুরি ভুরি।

এইসব ঘটনায় গণমাধ্যম তার মূল ‘কারেন্সি’ অর্থাৎ বিশ্বাস অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। মানুষ যখন মূলধারার গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দিহান হয়, তখন সে বিকল্প মাধ্যমের দিকে ঝুঁকতে থাকে।

ইকবাল ধীরসে আয়্যা:

সবার আগে সর্বশেষ তথ্য নাকি সবচে’ নির্ভরযোগ্য তথ্য— কোনটি হবে সাংবাদিকের কার্ডিনাল ল বা অলংঘনীয় বেদবাক্য?

সবার আগে সর্বশেষ তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করা অবশ্যই ভালো। কিন্তু ‘লাইক, ভিউ’ পাওয়ার লড়াইয়ে এগিয়ে থাকতে গিয়ে সেনসেশান ক্রিয়েট করা, আনভেরিফাইড তথ্য দেওয়া, একেকবার একেক তথ্য দেওয়া সাংবাদিকের জন্য হারাম।

তাই, সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠানের কালিমা তৈয়্যেবা হলো ‘সবচে’ নির্ভরযোগ্য তথ্য’। প্রয়োজনে দেরি হোক। প্রতিদ্বন্দী হাউজ সংবাদ দিয়ে দিক। কিন্তু ‘এগিয়ে থাকার’ ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না।

বিবিসি ঠিক এই কাজটিই করে। অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল-ভ্রান্তি তাদেরও হয় বটে। কিন্তু তাদের বেদবাক্য হলো,  নির্ভুল না হয়ে, যাচাই না করে কোনও তথ্য প্রকাশ করা যাবে না।

আমাদের দেশে টিভিস্ক্রল থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠিত বড় বড় সংবাদ মাধ্যমে প্রথমে ১০/২০ জনকে মারার খবর দিয়ে পরে মৃতের সংখ্যা এক-দুইজনে নেমে আসার ঘটনা আছে। এসব চর্চা বন্ধ করতে হবে।  

লেখার শুরুতে বলেছিলাম, চারিদিকে তথ্যের জোয়ার নয়, সুনামি চলছে। এই সুনামির মধ্যে সত্য আর মিথ্যা যখন আলাদা করা যাচ্ছে না তখন এই যুগে মানুষ মৌলিকভাবেই গণমাধ্যমের দিকে আরও বেশি ঝুঁকবে।

লিগেসি মিডিয়ার জন্য এটিই মোক্ষম সুযোগ পাঠক ও দর্শককে আরও কাছে টানার।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পেশাদার সাংবাদিক এবং নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিদের সাথে বিভিন্ন সময়ে আমি প্রশিক্ষক ও কনসাল্টেন্ট হিসেবে কাজ করেছি। কাজ করতে গিয়ে একটি কথা ঘুরে ফিরে তারা বলেন। সেটি হলো, ‘অর্থলগ্নীকারি ব্যক্তি বা ইনভেস্টর তো এসব নীতি-নৈতিকতা দেখে না। ফোন করে বলে, অমুকে অমুক খবর দিয়ে দিয়েছে, তুমি কেন দাও নাই? এটা তো তখন আমার জন্য ডিসক্রেডিট’।

তাদেরকে আমি বলি, এগুলো হয়ত ছেঁদো যুক্তি নয়। কিন্তু নিজের পেশার জন্য নিজের লড়াইটা নিজেকেই লড়তে হবে।

আলু-পাটল-লাউয়ের ব্যবসা আর ইনফরমেশান ব্যবসা এক কায়দায় চলে না। ফলে, অর্থ লগ্নিকারককে সব সাংবাদিক মিলে একাট্টা হয়ে বোঝাতে হবে, এই ব্যবসার ধরণ আলাদা।

সংবাদ মাধ্যম হিসেবে সংবাদ প্রতিষ্ঠান যদি নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা ধরে রাখতে না পারে, যদি সোশাল মিডিয়ার মতন ‘একে তো নাচুনি বুড়ি তার উপরে ঢোলের বাড়ি’ টাইপ আচরণ পরিত্যাগ না করে, তাহলে গণমাধ্যমের প্রতিও মানুষের আস্থা ফিরবে না।

আস্থা ও সুনাম একদিনে হয় না। গণমাধ্যমের ‘ভাগ্য’ আস্থা ও সুনামের সাথে ওতপ্রোতভাবে বাঁধা। তাড়াহুড়ো করে, সোনার ডিম পাড়া হাঁসের পেট কেটে ডিম বের করতে চাইলে মিলবে ‘ফক্কা’। এই ক্ষেত্রে মনে রাখা ভালো, ইকবাল ধীরসে আয়া।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক। সহকারী অধ্যাপক, মিডিয়া এন্ড ম্যাস কমিউনিকেশান বিভাগ, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ।

ইমেইল: afroja.shoma@gmail.com

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত