Beta
শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫

সূর্যগ্রহণ, মিথ ও আশ্চর্য ঐতিহাসিক ঘটনাবলি

solar eclipse picture nasa
[publishpress_authors_box]

৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি। মদিনায় কেবল সূর্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। বৃত্তাকার সূর্যগ্রহণ ছিল সেটি। চাঁদ যেন সূর্যের মাঝখানে গেঁথে গিয়েছিল কিছু সময়ের জন্য। মুসলিমদের নবী মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন আঙুর ক্ষেতে। এইসময়ে খবর পেলেন মারিয়ার ঔরসে জন্ম নেওয়া তার পুত্র ইব্রাহিম মারাত্মক অসুস্থ। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। পাশের সাহাবিকে অনুরোধ করলেন একটু সাহায্য করতে। সন্তান হারানোর শোকের সঙ্গে তিনি আগে থেকেই পরিচিত। ইব্রাহিমের জন্য বুক কেঁপে উঠলো। বাড়ি পৌঁছানোর পর ১৮ মাস বয়সী ইব্রাহিমকে কোলে নিলেন। মুহাম্মদ (সা.) এর কোলের মধ্যেই ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো শিশু ইব্রাহিম। ইসলামের মহানবী কেঁদে উঠলেন। ইব্রাহিম ছিল মুহাম্মদ (সা.) এর শেষ সন্তান।   

অনেকে সাহাবি তখন ইব্রাহিমের মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে সূর্যগ্রহণের সংযোগ রয়েছে বলে প্রচার করতে লাগলেন। শোকাতুর মুহাম্মদ (সা.) তখন সাহাবিদের উদ্দেশে বলেন, “চন্দ্র ও সূর্যও আল্লাহর তৈরি দুইটা নিদর্শন। কারও জন্ম বা মৃত্যুর জন্য তাদের গ্রহণ হয় না। যখন তোমরা গ্রহণ দেখবে তখন আল্লাহকে স্মরণ করো এবং গ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রার্থনা করো।” (সহীহ বুখারি, হাদিস নং: ১০৬০) 

প্রকৃতির যে বিষয়গুলো মানুষ এখনও বদলে দিতে পারেনি, ব্যাখ্যা করতে পারে না, সেসব নিয়েই তার মনস্তত্বে গেঁথে থাকে নানা সংস্কার।

সূর্য ও চন্দ্রের গ্রহণ তেমনই দুটি বিষয়। কখনও কখনও সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণের কারণে অলৌকিক ঘটনাও ঘটেছে বৈকি! তাই এ দুই মহাজাগতিক ঘটনার সঙ্গে মিথ-বিজ্ঞান-বাস্তব ঘটনা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

চাঁদ ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে চলে এলেই হয় সূর্যগ্রহণ। বিজ্ঞানের এ সহজ ব্যাখ্যার পরেও মানুষের মনের অলৌকিকতার কুঠুরি একেকটি বড় ঘটনার সঙ্গে গ্রহণের যোগ খুঁজে পেতে চেষ্টা করে।

সূর্যগ্রহণের সঙ্গে কিছু ঘটনার কাকতাল

মার্ক টোয়াইনের উপন্যাস ‘আ কানেটিকাট ইয়াঙ্কি ইন কিং আর্থার্স কোর্ট’ ১৮৮৯ সালে প্রকাশ হয়। এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হ্যাংক মর্গান ঘটনাচক্রে জ্ঞান হারিয়ে ষষ্ঠ শতকের ইংল্যান্ডে জেগে ওঠে। সেখানে শিগগিরই হ্যাংক নানা ধরনের সংকটে পড়ে। ঘটনা পরম্পরায় তাকে পুড়িয়ে মারার শাস্তি দেওয়া হয়।

ঐতিহাসিক হেরাডোটাসারের বর্ণনা অনুযায়ী, লিডিয়া ও মেডদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছিল সূর্যগ্রহণ।

তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিনক্ষণেই একটি সূর্যগ্রহণ হওয়ার কথা ছিল। মর্গান যেহেতু ভবিষ্যৎ থেকে আসা মানুষ সে জানতো একটি সূর্যগ্রহণ আসছে। এই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে মৃত্যুদণ্ডদানকারীদের মর্গান শেষ পর্যন্ত দেখায় যে, সে ইচ্ছা করলেই চাঁদ ও সূর্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং প্রাণে বেঁচে যায়।

মর্গানের গল্পের সঙ্গে কিন্তু বাস্তবেও বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনার মিলও রয়েছে। অভিযাত্রী ও নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাসের জীবনও একবার এভাবেই বেঁচে গিয়েছিল।

ইতিহাসজুড়ে বিভিন্ন সময়ে হওয়া সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ মানুষের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে, যুদ্ধের ফলাফলও বদলে দিয়েছে। এমনকি নতুন তত্ত্ব এবং চিন্তাধারা আবিষ্কারের মাধ্যমে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের অতীতের ধারণাকেও আমূল পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ।

অসংখ্য সংস্কৃতি লোকায়ত বিশ্বাস এবং পৌরাণিক কাহিনীর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সূর্য ও চন্দ্রের গ্রহণ।

হাজার বছর ধরে, মানুষ গ্রহণের মতো মহাজাগতিক ঘটনাকে দেবতা, অতিপ্রাকৃত শক্তি, দানব এবং বিস্ময়কর প্রাণীদের সঙ্গে যুক্ত করেছে। যেমন, পশ্চিম এশিয়ায় সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে বলা হতো ড্রাগন সূর্যকে গ্রাস করেছে। একই ধরনের মিথ ছিল অন্য জায়গাতেও- পেরুতে পুমা, নেটিভ আমেরিকানদের একাংশ ক্ষুধার্ত ভাল্লুকের পেটে সূর্য গিয়েছে বলে মনে করতো। আর দুর্ধর্ষ ভাইকিংসরা সূর্যগ্রহণকে আকাশে দুইটি নেকড়ে দেখার সঙ্গে তুলনা করেছে।

হাজার বছরের ইতিহাসে এমন কিছু ঘটনা পাওয়া যায়, যাদের সত্যিকার অর্থেই সূর্যগ্রহণের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল।

যুদ্ধ ও সূর্যগ্রহণ

যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ‘টোটালিটি: একলিপ্স অব দ্য সান’ বইয়ের লেখক মার্ক লিটম্যান সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে বলেন, যুদ্ধের সময় ফলাফল পরিবর্তনে সত্যিকার অর্থেই সূর্যগ্রহণ ভূমিকা রেখেছে। উদাহরণ টানতে গিয়ে তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০ সালে লেখা গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের লিপিবদ্ধ করা একটি ঘটনার উল্লেখ করেন। 

হেরাডোটাসারের বর্ণনা অনুযায়ী, লিডিয়া এবং প্রাচীন ইরানি জাতি মেডদের মধ্যে ছয় বছরব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছিল এক সূর্যগ্রহণের কারণে।

“ছয় বছরব্যাপী যুদ্ধে উভয় পক্ষই একে অপরের বিপক্ষে জয়-পরাজয়ের পর বারবার মুখোমুখি হচ্ছিলো। তবে, শেষবার ‘দিনটি হঠাৎ রাতে পরিবর্তিত হয়েছিল’। হেরোডোটাস লিখেছেন, মেড ও লিডিয়ানরা এই পরিবর্তন দেখে যুদ্ধ বন্ধ করে দেয় এবং উভয় পক্ষই শান্তির শর্তে একমত হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে।”

লিটম্যান বলেন, “১৮০০ শতকের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন যে, হেরোডোটাস সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৫ সালের ২৮ মে যে সূর্যগ্রহণ হয়েছিল, তার বর্ণনা দিয়েছেন।”

“আরেকটি বিবরণেও হেরাডোটাস বলেছেন, পারসিয়ান রাজা জারক্সিস গ্রিস আক্রমণের আগে একটি গ্রহণ দেখেছিলেন।”

লিটম্যান বলেন, “সেই বছরে ঠিক কোন সময়ের গ্রহণটি রাজা জারক্সিস দেখেছিলেন তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু হেরোডোটাসের বর্ণনা অনুযায়ী, এ বিষয়ে জারক্সিস তার জরথুস্ট্রীয় পুরোহিতদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। পুরোহিতরা তাকে জানান, ঈশ্বর গ্রিকদের তাদের শহরগুলোর আসন্ন ধ্বংস সম্পর্কে সতর্ক করছে। ‘সূর্য তাদের জন্য, আর চাঁদ আমাদের জন্য ভবিষ্যদ্বাণী করে’, তারা সম্ভবত পরামর্শ দিয়েছিল। ‘জারক্সিস খুব আনন্দিত মনে তার পথে এগিয়ে গেলেন’, হেরোডোটাস লিখেছিলেন।”

ক্রিস্টোফার কলম্বাস এবং গ্রহণ

১৫০৩ সালে নাবিক ও অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাস তার শেষ ভ্রমণে ছিলেন। তার নৌবহর জ্যামাইকায় এক ঝড়ের কবলে পড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল। 

বিধ্বস্ত জাহাজ নিয়ে একটি দ্বীপের সৈকতে ঘাঁটি গাড়েন কলম্বাস। ক্ষুধা ও স্থানীয়দের সঙ্গে দ্বন্দ্বের আশঙ্কায়, কলম্বাস তার কর্মীদের ঘাঁটি ছেড়ে যাওয়া নিষিদ্ধ করেন। স্পেন থেকে আনা প্রায় মূল্যহীন জিনিসপত্র দিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে খাবার-দাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিস বিনিময়ের একটি বন্দোবস্ত করেন। কিন্তু কলম্বাসের সতর্কতা সত্ত্বেও নাবিকরা বিভিন্নভাবে দ্বীপের বাসিন্দাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে।

১৫০৪ সালের জানুয়ারিতে কয়েকজন জাহাজের কর্মী বিদ্রোহ করে দ্বীপে পালিয়ে যায়। কলম্বাসের জীবনীকার লিখেছেন, পলাতকরা দ্বীপের বাসিন্দাদের নির্যাতন ও উপহাস করেছিল, খাদ্যদ্রব্য চুরি করেছিল এবং ‘সম্ভব সব ধরনের অত্যাচার করেছিল’।

এর কয়েক সপ্তাহ পর, স্থানীয়রা তাদের ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। সহিষ্ণুতা ঘৃণায় রূপান্তরিত হয় এবং খাদ্যের বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। কলম্বাস এবং বাকি জাহাজের কর্মীরা অনাহারের মুখোমুখি হয়।

আদিবাসীদের চন্দ্রগ্রহণ দেখিয়ে বোকা বানিয়েছিলেন কলম্বাস।

কিন্তু জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে কলম্বাস মনে মনে জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটি ঘটনা দিয়ে উদ্ধার পাওয়ার ফন্দি আঁটেন। আর সেই মহাজাগতিক ঘটনাটি হলো- একটি চন্দ্রগ্রহণ।

পয়লা মার্চে তিনি স্থানীয় সম্প্রদায়ের নেতাদের একত্রিত করেন, খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করার জন্য তাদের নিন্দা করেন এবং সতর্ক করেন: “যে ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করেন তিনি আপনাদের শাস্তি দেবেন … আজ রাতেই চাঁদ তার রং পরিবর্তন করবে এবং তার আলো হারাবে, আকাশ থেকে আপনাদের উপর যে অশুভ শক্তি নেমে আসবে তার সাক্ষী হিসেবে।”

এটা কাজে লাগল। ভীত স্থানীয়রা নরম হয়ে আবার খাবার দিতে শুরু করে। কলম্বাস তাদের ‘ক্ষমা’ করার জন্য একটি ‘আচার-অনুষ্ঠান’ করার প্রতিশ্রুতি দেয়।

বর্তমান সময়ে হয়তো এটি একটি প্রতারণার গল্প হিসেবেই গণ্য হবে। কেননা দ্বীপের আদিবাসীদের লুটেরা ইউরোপীয়দের এড়িয়ে যাওয়ার সবধরনের অধিকার ছিল। তাছাড়া কলম্বাসও নিজের পথ চলার জন্য বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং ফাঁপা হুমকি ব্যবহার করেছিলেন, যা নৈতিক কূটনীতির মধ্যে পড়ে না।

যাই হোক না কেন, এটি একটি প্রশ্নের উদ্রেক ঘটায়- যদি মার্চ মাসে চন্দ্রগ্রহণ না ঘটতো তাহলে কলম্বাসের কী হতো? উদ্ধারকারী দল জুন মাস পর্যন্ত আসত না। সম্ভবত জ্যামাইকায় মারা গেলে কলম্বাসের খ্যাতির জন্য ভালো হতো। কেননা, তার জীবনের বাকি অংশ খুব একটা গৌরবময় ছিল না। তিনি দুর্বল শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে স্পেনে ফিরে এসেছিলেন, সরকারি স্বীকৃতি এবং অর্থের জন্য আন্দোলন করছিলেন। তার পৃষ্ঠপোষকরা তার মানসিক অবস্থা নিয়ে সন্দেহ করতেন এবং তার কথাই শুনতে চাইতেন না। ১৫০৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দারুণ অসুখী জীবন যাপন করেছেন কলম্বাস। চন্দ্রগ্রহণ তাকে তবে কী দিয়েছিল? বিনিময়ে কী করেছিল গ্রহণ?

তবে সূর্যগ্রহণের চেয়ে চন্দ্রগ্রহণকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন লেখক লিটম্যান। তার মতে, সূর্যগ্রহণের পরিমাণ বেশি ঘটলেও, খুব কম সংখ্যক মানুষই সেটি দেখতে পায়, এটি স্বল্পস্থায়ীও বটে।

সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ইতিহাসে যে সূর্য গ্রহণটি হয়েছিল সেটি খ্রিস্টের জন্মের অনেক আগে। ৭৪৩ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দের ওই সূর্যগ্রহণের সময় কাল ছিল ৭ মিনিট ২৭.৫৪ সেকেন্ড। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো, সূর্যগ্রহণের এই সময় ধরা হয়েছে, চাঁদ কতক্ষণ সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে রাখে সেই হিসেব করে।

পক্ষান্তরে চন্দ্রগ্রহণ অপেক্ষাকৃত বেশি দীর্ঘস্থায়ী এবং পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি অংশ থেকে দৃশ্যমান হয়। ‘ইতিহাসকে প্রভাবিত করার জন্য এগুলোর ব্যবহার সহজ’, গ্রহণ সংক্রান্ত বইয়ের লেখj লিটম্যান মনে করেন।

টেকুমসেহের গ্রহণ

সৌরগ্রহণের সঙ্গে এক দারুণ মার্কিন ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। ১৮০০ শতাব্দীতে, নেটিভ আমেরিকান শওনি নেতা টেকুমসেহ এবং তার ভবিষ্যতদ্রষ্টা হিসেবে পরিচিতি দানকারী তার ভাই নিজেদের লোকদের ঐক্যবদ্ধ করে স্থানীয় ঐতিহ্য ও জমির মালিকানা বজায় রাখতে বিদ্রোহ করেছিলেন।  

সেইসময় ওই স্থানের গভর্নর ছিলেন উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসন (পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন)। তো হ্যারিসন নেটিভ আমেরিকান নেতাদের জমির মালিকানা হস্তান্তর করার ব্যাপারে প্রায় রাজি করিয়েই ফেলেছিলেন। কিন্তু টেকুমসেহ এবং তার ভাইকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা রয়েই গিয়েছিল। তারা বাধা দিচ্ছিল।

তাই তাদের হেয় প্রতিপন্ন করার আশায় এ দুই আদিবাসী নেতার কাছে কোনও একটি বিশেষ বা অলৌকিক ক্ষমতা দেখানোর আহ্বান জানান হ্যারিসন। বিশেষ করে, টেকুমসেহ এর ভাই যদি এতো বড় ভবিষ্যতদ্রষ্টাই হয়, তাহলে আকাশে সূর্যকে থামাতে পারছে না কেন- এই ছিল হ্য্যারিসনের কথা।

টেকুমসেহের ভাই এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। তিনি ঘোষণা করলেন যে, নির্দিষ্ট তারিখে, ‘মহান আত্মা’ সূর্যকে অন্ধকার করবেন, স্পষ্টতই দেখিয়ে দেবেন যে তিনিই প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী।

নির্ধারিত দিনটি এল। টেকুমসেহ এবং তার অনুসারীরা উত্তেজনা ও আগ্রহ নিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করছিল। ঠিক যেমন ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, সূর্য আংশিকভাবে ঢাকা পড়ে গেল- একটি সৌরগ্রহণ ঘটেছিল। টেকুমসেহের সমর্থকরা আনন্দে চিৎকার করে উঠল। তাদের নেতার ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়েছে!

কিন্তু হ্যারিসন দমে যাননি। তিনি দাবি করলেন যে গ্রহণটি, কাকতালীয়ভাবে ঘটেছে এবং ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি আরও যুক্তি দেখালেন, সূর্য সম্পূর্ণরূপে ঢাকা পড়েনি, যা প্রমাণ করে যে ভবিষ্যদ্বাণীটি আংশিকভাবেই সফল হয়েছে।

টেকুমসেহের অনুসারীদের মধ্যে বিভ্রম দেখা দেয়। কিছু লোক হ্যারিসনের কথায় বিশ্বাস করে, অন্যরা তাদের নেতার প্রতি আনুগত্য বজায় রাখে। এই বিভাজন শেষ পর্যন্ত টেকুমসেহের আন্দোলনের ক্ষতি করে।

এ ঘটনাটি প্রমাণ করে, কীভাবে একটি প্রাকৃতিক ঘটনা ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর গতিপথ পরিবর্তন করে দিতে পারে। টেকুমসেহের ক্ষেত্রে, সৌরগ্রহণটি তার আন্দোলনের ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

দুঃখের বিষয় হলো, ওই গ্রহণ ইতিহাসের বইয়ে দীর্ঘমেয়াদী এক যুদ্ধে ফিরে আসার গল্পই কেবল লিখতে পেরেছে।

ভারতে সূর্যগ্রহণের পর্যবেক্ষণ ইতিহাস

ভারতের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণ জড়িয়ে রয়েছে। হিন্দুরা গ্রহণকে পুণ্য স্নান এবং দানের জন্য শুভ সময় মনে করেন। এতে পরকালের সৌভাগ্য লাভ হয় বলে তারা মনে করেন। ৪৭৬-৫৫০ খ্রিস্টাব্দে জীবিত ভারতীয় গণিতবিদ আর্যভট্টের গ্রন্থ ‘আর্যভট্টীয়’তে প্রথম গ্রহণ সম্পর্কে বলা হয়। তিনি গ্রহণের পেছনে চাঁদ ও পৃথিবীর ভূমিকাও ব্যাখ্যা করেছেন। গ্রন্থটি ৪৯৯ খ্রিস্টাব্দে লেখা হয়েছিল।

ভারতীয় গ্রন্থে বলয়াকার গ্রহণের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় বৃহৎসংহিতা (৫০৫ খ্রিস্টাব্দ) গ্রন্থে। এই বিশ্বকোষাত্মক গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন বরাহমিহির (৪৮৫-৫৮৭ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ‘মধ্যে তমঃ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যার অর্থ ‘মাঝখানে অন্ধকার’ (বৃহৎসংহিতা: ৫:৫১; ভট্ট ২০০৬)। এই শব্দটি নির্দেশ করে যে সম্ভবত তিনি একটি বলয়াকার গ্রহণ দেখেছিলেন। বরাহমিহিরের বাসস্থান উজ্জয়িনের কাছেই ৪৯৬ ও ৫৫০ খ্রিস্টাব্দে এমন দুটি বলয়াকার গ্রহণ ঘটেছিল বলে জানা যায়।

১৫০১ খ্রিস্টাব্দে রচিত নিলাকণ্ঠ সোময়াজীর ‘তন্ত্রসংগ্রহ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, সূর্যের কোণীয় ব্যাস যখন চাঁদের চেয়ে বড় হয়, তখন বলয়াকার গ্রহণ ঘটে। যদিও কোনও কারণ এ বইয়ে অনুসন্ধানের কথা লেখা নেই ।

আবার প্রায় ৯০০ বছর পরে এসে পরমেশ্বর (১৩৮০-১৪৬০ খ্রিস্টাব্দ) রচিত ‘সিদ্ধান্তদীপিকা’ গ্রন্থে ১৩৯৩ থেকে ১৪৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সৌর ও চন্দ্রগ্রহণের বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি ওই গ্রহণগুলো নিজেই পর্যবেক্ষণ ও লিপিবদ্ধ করেছেন।

ভারতে প্রথম সূর্যগ্রহণ নথিবদ্ধ করেন আর্যভট্ট।

এছাড়া ভারতের সূর্যমন্দিরের কথা বলা যায়। ভারতের মালাওয়াতে দশাপুরে (যার আগের নাম মান্দসৌর) প্রথম কুমারগুপ্তের (রাজত্বকাল ৪১৪-৪৫৫ খ্রিস্টাব্দ) সমসাময়িক রাজা বান্ধুবর্মণের শাসনামলে ৪৩৬-৩৭ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দিরটি নির্মিত হয়। রেশম বয়নকারদের একটি শ্রেণি দেশের রাজাদের সদগুণে আকৃষ্ট হয়ে লাট জেলা থেকে দশাপুরে চলে আসে। এখানে তারা ৪৩৬-৩৭ খ্রিস্টাব্দে ‘সূর্য মন্দির’ নির্মাণ করেন (ফ্লিট ১৮৮৬)।

মাত্র এক বছর আগে, অর্থাৎ ১৪ ফেব্রুয়ারি ৪৩৫ খ্রিস্টাব্দে একটি বলয়াকার গ্রহণ ঘটেছিল। মান্দসৌর শহরটি (২৪.০৩৭° উত্তর, ৭৫.০৭৭° পূর্ব) গ্রহণপথের কেন্দ্রীয় রেখার কাছাকাছি ছিল।

এছাড়াও ভারতীয় ইতিহাসে মুঘল সম্রাটদের রাজজ্যোতিষদের গ্রহণ পর্যবেক্ষণের রেকর্ড পাওয়া যায়। গ্রহণকে অশুভ লক্ষণ হিসেবে ধরে মুঘল সম্রাটরা ফাঁড়া কাটাতে নিজেদের ওজন পরিমাণ শস্য দান-খয়রাত করতেন। এই রেওয়াজ সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ পর্যন্ত চলেছে।  

‘আকবরনামা’য় উল্লেখ রয়েছে যে, সম্রাট আকবর হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিকে সম্মান জানাতে সৌর মাসের প্রথম দিন, রবিবার এবং চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের দিনগুলোতে মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকতেন। ‘আকবরনামা’য় কুরুক্ষেত্রের জায়গার অধিকার নিয়ে হিন্দু সন্ন্যাসীদের দুইটি বিরোধী গোষ্ঠীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কথা রয়েছে। যেটি সংগঠিত হয় ১৫৬৭ সালের ৯ এপ্রিল। ওইদিন সৌর গ্রহণের সময়ই এ সংঘর্ষ হয়েছিল।

বিজ্ঞান ও সূর্যগ্রহণ

সূর্য গ্রহণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের নামও। ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ ও গণিতবিদ স্যার আর্থার এডিংটন আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব পরীক্ষা করার জন্য ১৯১৯ সালের ২৯ মে তারিখের পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময়ক্ষণটি বেছে নেন। চাঁদ যখন সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে দিয়েছিল তখন সেই অন্ধকার মুহূর্তে অন্যান্য নক্ষত্রের ছবি তুলে তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, তীব্র মাধ্যাকর্ষণের কারণে আলো বেঁকে যেতে পারে। এই ঘটনাটিকে মহাকর্ষীয় বিচ্যুতি বা গ্রাভিটেশনাল ডিফ্লেকশন বলা হয়।

এর আগে ১৮৬৮ সালের ১৮ আগস্টের সূর্যগ্রহণের সময় হিলিয়াম আবিষ্কার করেন ফরাসি জ্যোতির্বিদ পিয়েরে জুলস জসন। গ্রিক ভাষায় সূর্যকে ‘হেলিও’ শব্দ দিয়ে বোঝায়। সেই অনুযায়ী পৃথিবীর দ্বিতীয় হালকাতম বস্তু হিলিয়ামের নাম রাখা হয়েছে সূর্যকে মাথায় রেখেই।

গ্রহণ অবলোকনে নানা যজ্ঞ

উত্তর আমেরিকার কোটি কোটি মানুষ ৮ অক্টোবরের সূর্যগ্রহণ দেখার প্রস্তুতি নিয়েছে। পর্যটকরা ভিড় করছেন বিভিন্ন শহরে। কর্তৃপক্ষ নিয়েছে কড়া নজরদারির ব্যবস্থা।

মেক্সিকো থেকে শুরু হবে সূর্যগ্রহণ। বেশিরভাগ মানুষই প্রায় চার মিনিট পুরো অন্ধকারে থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে দর্শনার্থীদের বাইরে বিজ্ঞানীরা নিচ্ছেন এক ভিন্ন ধরনের প্রস্তুতি। চারটি মূল্যবান মিনিট তারা কাটাবেন অসম্ভব ব্যস্ততায়।

গবেষকরা গ্রহণের পথে রকেট উড়িয়ে দেবেন, প্রাণীদের পর্যবেক্ষণ করতে চিড়িয়াখানায় দাঁড়াবেন, পৃথিবীর জুড়ে রেডিও সংকেত পাঠাবেন এবং বিশাল ক্যামেরা দিয়ে মহাকাশে তাকাবেন। কিন্তু এখনও বিপত্তি ঘটতে পারে। একটি সৌর শিখা অথবা এমনকি কিছু সাধারণ মেঘ এই পরিকল্পনাগুলো ভেস্তে দিতে পারে।

উত্তর ক্যারোলাইনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যাডাম হার্টস্টোন-রোজ সূর্যগ্রহণের দিন টেক্সাসের ফোর্ট ওয়ার্থের চিড়িয়াখানায় সময় কাটাবেন।

তিনি গরিলা থেকে গ্যালাপাগোস কচ্ছপ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রাণীর আচরণের দিকে লক্ষ্য রাখবেন বলে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন।

অনেক প্রাণী হঠাৎ অন্ধকার হলেই উদ্বিগ্ন প্রতিক্রিয়া দেখায়। ২০১৭ সালের গ্রহণের সময়, কচ্ছপগুলো হঠাৎ জোড়ায় মিলিত হতে শুরু করেছিল।

“গতবারের ফ্লেমিঙ্গো পাখিদের একটি আচরণ খুব অদ্ভুত ছিল। পূর্ণ গ্রহণের সময় যত অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল, প্রাপ্তবয়স্ক পাখিটি বাচ্চাদের নিজের পাখার ভেতরে ঢুকিয়ে রেখেছিল, আর বারবার চিন্তিত হয়ে আকাশের দিকে তাকাচ্ছিল, যেন কোনো শিকারি পাখি আসছে।”

মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা গ্রহণের পথ বরাবর ডাব্লিউবি-৫৭ জেট ওড়াবে। ওই বিমানটি থেকে পৃথিবী পৃষ্ঠের ৫০ হাজার ফুট (১৫,২৪০ মিটার) ওপর থেকে ছবি তোলা হবে। তারমানে হলো, মেঘের ওপর দিয়ে ওড়া। অর্থাৎ সূর্যগ্রহণ ‘মিস’ করার কোনও সুযোগ নেই।

এছাড়াও সূর্যগ্রহণ সরাসরি ওয়েবসাইটে দেখানোর ব্যবস্থাও করেছে নাসা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত