এমভি আবদুল্লাহ দখলে নেওয়ার আট দিন পর বুধবার বাংলাদেশি জাহাজটির মালিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। তবে সেই যোগাযোগ হয়েছে তৃতীয় একটি পক্ষের মাধ্যমে।
অথচ জাহাজে একটি স্যাটেলাইট ফোন আছে, যার মাধ্যমে মালিকপক্ষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব। এছাড়া জাহাজে মনোনীত একজন ব্যক্তির নম্বরও আছে, তার মাধ্যমেও সরাসরি মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়।
জাহাজের মালিকপক্ষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের সহজ পথ থাকলেও সেই পথে না হেঁটে কেন তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যোগাযোগ করল সোমালিয়ার জলদস্যুরা।
জানতে চাইলে মাস্টার মেরিনার ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখানে আসলে একটি বিশ্বাসের বিষয় জড়িত। তৃতীয় একটি পক্ষের মাধ্যমে দস্যুরা নিশ্চিত হতে চায় তারা জাহাজ মালিকদের সাথে কথা বলছে। আর জাহাজ মালিকও নিশ্চিত হতে চায় দস্যুদের সঠিক প্রতিনিধি তারা (যোগাযোগকারী) কি না।
“এখন ধরুন জাহাজের স্যাটেলাইট ফোন থেকে কল দিল দস্যুরা। তাতে সাড়া দিল জাহাজ মালিকের অন্য একটি পক্ষ। ফলে দেন-দরবার তো আগাবে না। আর সঠিক প্রতিনিধি না হলে মুক্তিপণের বিষয়টি অন্য দিকে মোড় নিতে পারে। ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। আবার সিম ব্যবহার করে বা অন্য যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে ফোন দিলে ট্র্যাকিং হতে পারে। ফলে তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি শ্রেয় মনে করে মুক্তিপণ দাবিকারী দস্যু এবং জাহাজ মালিক উভয়পক্ষ,” বলেন তিনি।
গত ১২ মার্চ সোমালিয়া উপকূল থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে ভারত মহাসাগরে এমভি আবদুল্লাহ সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে। জাহাজটিতে ২৩ নাবিক রয়েছেন, যাদের সবাই বাংলাদেশি।
কবির গ্রুপের কোম্পানি এস আর শিপিংয়ের আরেকটি জাহাজ জাহান মনি এক যুগের বেশি সময় আগে সোমালি জলদস্যুরা ছিনতাই করেছিল। তখন মুক্তিপণ দিয়ে ৯৯ দিন পর জাহাজটি ছাড়িয়ে আনা হয়েছিল।
সম্প্রতি মাল্টার পতাকাবাহী এক জাহাজ ভারতীয় নৌবাহিনীর অভিযানে সোমালি জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার পর এমভি আবদুল্লাহকেও সেভাবে উদ্ধারের একটি আলোচনা চলছিল।
তার মধ্যেই বুধবার দুপুরে এস আর শিপিংয়ের পক্ষ থেকে জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগের খবর জানানো হয়। তারা জানায়, দস্যুদের একটি তৃতীয় পক্ষ এই যোগাযোগ করেছে। তবে তৃতীয় পক্ষটি কারা এবং মুক্তিপণ নিয়ে কী কথা হয়েছে সে বিষয়ে এস আর শিপিং কিছু জানায়নি।
বিদেশি তেলবাহী একটি জাহাজের ক্যাপ্টেনের দাবি, জাহাজের স্যাটেলাইট ফোনেই মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে দস্যুরা।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে ওই ক্যাপ্টেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “খোঁজ নিয়ে দেখেন জাহাজের স্যাটেলাইট ফোনেই মালিকপক্ষের সাথে এই যোগাযোগ হয়েছে। নাবিকদের অগোচরে তো আর সেটি হয়নি। কিন্তু দস্যুরা সরাসরি যোগাযোগটি করেনি। তৃতীয় পক্ষ সেই যোগাযোগটি করেছে। এর আগে জাহাজের বিদেশি ইনস্যুরেন্স কোম্পানির মাধ্যমে তৃতীয় পক্ষ নিশ্চিত হয়েছে জাহাজ মালিকদের পক্ষে কে এই নেগোসিয়েটটা করবে। সেটি নিশ্চিত হওয়ার পরই দস্যুদের পক্ষ থেকে ফোন এসেছে।”
তাহলে তৃতীয় পক্ষটি আসলে কে- জানতে চাইলে ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, “তৃতীয় পক্ষ মূলত দস্যুদের প্রতিনিধি। তারা কে তা আসলে সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাবে না। দু’পক্ষকে কথা বলানোর মাধ্যমেই তারা জানান দেবে তাদের সক্ষমতা-পরিচয়।
“দেন-দরবারের একদিকে জাহাজ মালিক ও বিদেশি ইনস্যুরেন্স কর্তৃপক্ষ, অপরদিকে থাকবে দস্যুরা। দুপক্ষই উপলব্ধি করবে তারা সঠিক প্রতিনিধির সাথেই দেন-দরবার করছে। সমঝোতা থেকে শুরু করে নাবিকের মুক্তিপণ পর্যন্ত ওই তৃতীয় পক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে থাকবে। মুক্তিপণের মাধ্যমে আদায়কৃত অর্থের একটি বড় অঙ্ক তারা পাবে।”
তবে এই তৃতীয় পক্ষ সরাসরি দস্যু নয় জানিয়ে তিনি বলেন, “আর্ন্তজাতিক বিভিন্ন ভুইফোঁড় সংগঠনের ব্যানারে তারা কাজ করে। শিপিং সংশ্লিষ্ট বলা যায়। তাদেরকে এমনি চেনা যাবে না কিন্তু দেন-দরবারে তাদের চিনবেন। এস আর শিপিং তাদেরকে আগেও চিনেছে। ফলে এবারও সমঝোতা দ্রুতই করা সম্ভব হবে।”
জাহাজ জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের পর তার ভাগ-বাটোয়ারা যাতে সঠিকভাবে হয়, সেটি নিশ্চিত করার জন্যও দস্যুরা তৃতীয় পক্ষের দারস্থ হয় বলে জানিয়েছেন বিদেশি জাহাজে কর্মরত জাহাজের একাধিক নাবিক।
তাদের মতে, দস্যুদের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস আছে। মুক্তিপণের অর্থের বাটোয়ারা যাতে সঠিকভাবে হয় সেজন্যও দস্যুরা তৃতীয় পক্ষ রাখে। এছাড়া জাহাজের মালিকপক্ষ নিজেদের বিভিন্ন আর্থিক অক্ষমতা তুলে ধরে কম টাকায় রফা করতে চাইবে। সেক্ষেত্রে দস্যুদের নিয়োজিত তৃতীয় পক্ষ জাহাজ মালিকের যুক্তি খণ্ডাবে। আবার দস্যুদের যুক্তির জবাব দেবে জাহাজের ইন্সু্রেন্স কোম্পানির প্রতিনিধি- এভাবেই দর কষাকষি চলবে।
তারা জানান, সোমালিয়ার উপকূলে বর্তমানে দস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়া অন্তত পাঁচটি জাহাজ আছে, যেগুলো মুক্তিপণ আদায়ের প্রক্রিয়ায় আছে। জাহাজ জিম্মি করার পর মুক্তিপণ আদায়ে সাধারণত এই প্রক্রিয়াতেই আগায় দস্যুরা।
মেরিনাররা বলছেন, জাহাজ ছিনতাই বা জিম্মি করার পর অন্তত তিন থেকে চার সপ্তাহ লাগে দস্যুদের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করতে। এবার সেই দিক থেকে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গেই যোগাযোগ হয়েছে।
২০১০ সালে এস আর শিপিংয়ের আরেক জাহাজ ‘জাহান মণি’র জলদস্যুদের কবলে পড়ার কথা উল্লেখ করে তারা বলেন, মুক্তিপণ দিয়ে সেই জাহাজ ও নাবিকদের উদ্ধারের অভিজ্ঞতা এমভি আবদুল্লাহ উদ্ধারে মালিকপক্ষের কাজে লাগবে বলেও মনে করেন মেরিনাররা।
কবির গ্রুপের এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “অতীতের জাহান মণির অভিজ্ঞতায় অনেকগুলো ধাপ আমরা এগিয়ে রেখেছি। ফলে আমি বলব- দস্যুদের কাছ থেকে অত্যন্তু দ্রুত সাড়া এসেছে। আশা করছি সমঝোতা প্রক্রিয়াটা দ্রুতই শেষ করতে পারব।”
জলদস্যুদের কবলে পড়া অন্য যেকোনো জাহাজের চেয়ে এমভি আবদুল্লাহর নাবিকরা দ্রুত মুক্তি পাবেন বলে মনে করছেন বাণিজ্যিক একটি জাহাজের ক্যাপ্টেন আতিক ইউ এ খানও। তার মানে দুদিনের মধ্যেই সব হয়ে যাবে- বিষয়টিও এমনও নয়।
ক্যাপ্টেন আতিক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটা ভাবার কারণ নেই যে দুদিনের মধ্যেই দুপক্ষের মধ্যে সমঝোতা হবে। আর তৃতীয় দিন নাবিকরা মুক্তি পাবেন। তবে অন্য যেকোনো ছিনতাই হওয়া জাহাজের চেয়ে আবদুল্লাহ জাহাজের নাবিকদের দ্রুত ছাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।”
তিনি বলেন, “বিভিন্ন দস্যু গ্রুপের সাথে ধাপে ধাপে বেশ কিছু আলোচনার পরই মূলত সুফলটা মিলবে।”
তবে এসব ঘটনায় কত মুক্তিপণ দিয়ে নাবিকরা ছাড়া পান, শেষ পর্যন্ত তা অফিসিয়ালি প্রকাশ পায় না বলেও জানিয়েছেন ক্যাপ্টেন আতিক।
এদিকে দস্যুদের পক্ষ থেকে যোগাযোগের পর জিম্মি হওয়া নাবিকদের পরিবারের মধ্যে উৎকণ্ঠা কিছুটা কেটেছে। তারা জিম্মিদশা থেকে নিজ পরিবারের সদস্যদের পেতে আশায় বুক বেঁধেছেন।
আবদুল্লাহর চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খানের শ্বশুর মোহাম্মদ ফরহাদ বলেন, ‘‘এটি অবশ্যই আমাদের জন্য সুসংবাদ। জিম্মি নাবিকদের পরিবারের জন্য স্বস্তিদায়ক। দস্যুরা যোগাযোগ করেছে মানে নাবিকদের মুক্ত করার একটি প্রক্রিয়া শুরু হল।”