রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন কী টিকবেন? ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আড়াই মাস পর এই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত মো. সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরানোর দাবি তুলেছে।
শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে উদ্ধৃত করে সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরীর এক প্রতিবেদনের পর সাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে ওঠে মিথ্যাচারের অভিযোগ।
সেই অভিযোগ তোলেন এই আন্দোলনের মধ্যদিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তারপর গত কয়েকদিনে বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভ হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সাহাবুদ্দিনকে সরানোর প্রক্রিয়া কী হবে, তা কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, সেই প্রশ্ন অবশ্য থেকে যাচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই এবিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তবে রাষ্ট্রপতি পদে সাহাবুদ্দিনকে রাখা হবে কি না, তা নিয়ে একেক দলের একেক অবস্থান দেখা যাচ্ছে।
দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলের একটি বিএনপি এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতি পরিবর্তনের পক্ষপাতি নয়। জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী দলগুলো আবার সাহাবুিদ্দনকে বঙ্গভবন থেকে সরানোর পক্ষে। কিছু দল আবার এখনও নিজেদের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেনি।
বিএনপি
রাষ্ট্রপতি অপসারণের দাবি ওঠার পরপরই বিএনপি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে জানিয়ে এসেছিল, নতুন করে সাংবিধানিক শূন্যতা চায় না তারা।
পরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, তারা এই সময়ে রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন করে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরির পক্ষপাতি নয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান এবিষয়ে সকাল সন্ধ্যার জিজ্ঞাসায় বলেন, “এটা তো আমরা পরিষ্কার করে বলে দিয়েছি। আমরা নতুন করে কোনও সাংবিধানিক জটিলতা দেখতে চাই না।”
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা শনিবার বিএনপির সঙ্গে এনিয়ে বৈঠক করেছে। তবে বিএনপি তাদের বলেছে, তারা দলীয় ফোরামে আলোচনা করে রাষ্ট্রপতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত পরে জানাবে।
গণফোরাম
রাষ্ট্রপতি এই মূহূর্তে চলে গেলে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করেন গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সাংবিধানিক সংকট তৈরি হলে তারা যে সংস্কার করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে, সে প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে। তাই সাংবিধানিক সংকট তৈরি হোক, এরকম কিছু চাই না।”
জামায়াতে ইসলামী
রাষ্ট্রপতির বিষয়ে জামায়াতের সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে দলটির প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ তাদের আমির শফিকুর রহমানের একটি ফেইসবুক পোস্ট দেখিয়ে দেন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “জামায়াতে ইসলামীর আমির ড. শফিকুর রহমান ফেইসবুক পোস্টে বলেছেন, ৫ই আগস্ট রাষ্ট্রপতি বক্তব্য দিয়েছেন তিনি পদত্যাগপত্র পেয়েছেন। পরে তিনি আবার ভিন্ন বক্তব্য দিয়ে তার শপথ ভঙ্গ করেছেন। যার ফলে ওই পদে থাকার সাংবিধানিক ও নৈতিক অধিকার হারিয়ে ফেলেছেন। এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত।”
ইসলামী আন্দোলন
রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের বক্তব্যকে স্ববিরোধী বলছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব ইউনুস আহমেদ। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তিনি নিজেও বিতর্কিত হয়ে পড়েছেন। তিনি একবার বলেছেন পদত্যাগ পত্র পেয়েছেন, আরেকবার বলেছেন, তিনি পাননি। যার ফলে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তার সরে যাওয়াই একদিক থেকে ভালো হবে।”
সংবিধানের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে পদে রাখা ঠিক হবে না বলে মনে করেন ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব। তবে এ বিষয় সিদ্ধান্ত দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নিলে ভালো হবে বলে তার মত।
এবি পার্টি
রাষ্ট্রপতির নিজ থেকেই পদত্যাগ করা উচিৎ বলে মনে করেন আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রাষ্ট্রপতির উচিৎ পদত্যাগ করা। সকল দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সবাই মিলে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে।”
বিএনপি সাংবিধানিক শূন্যতার যে বিষয় তুলেছে, সেই প্রসঙ্গে মঞ্জু বলেন, “সাংবিধানিক সংকট তো আমরাও দেখতে চাই না। রাষ্ট্রপতি নিজেই সংকট তৈরি করেছে। তাকে রেখে দিলেও সংকট যাবে না। দ্রুতই একটা সেটেলমেন্টে যাওয়া উচিৎ।”
গণঅধিকার পরিষদ
রাষ্ট্রপতিকে বিদায় করার পক্ষে গণঅধিকার পরিষদ। দলটির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, হাসিনার আমলে যত খলনায়ক ছিল, তাদের সরিয়ে দিতে হবে। আমরা রাষ্ট্রপতির অপসারণ চাচ্ছি। দলগুলোর সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
বিপ্লবী সরকার অথবা জাতীয় সরকারে গঠনের পক্ষে মত জানিয়ে তিনি বলেন, “এই আন্দোলনের ৯৯ শতাংশ স্টেক হোল্ডার মানুষকে বাদ দিয়ে ১ শতাংশ মানুষ নিয়ে সরকার গঠন হয়েছে।”
নাগরিক ঐক্য
রাষ্ট্রপতির অপসারণ চাওয়া নিয়ে দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে নাগরিক ঐক্য।
দলটির সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এ বিষয়ে তারা (সরকার) এখনও কিছু জানতে চায়নি। কারও সঙ্গে আলাপ করেনি। পত্রিকার পাতায় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে।
“সবার সঙ্গে আলাপ হলে তখন মত দেব। তার মানে এই না যে আমরা চাই রাষ্ট্রপতির আয়ু দীর্ঘ হোক। আবার সরাতে গিয়ে যে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে, ওরকম কিছু চাই না।”
সিপিবি
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি মনে করে না যে রাষ্ট্রপতি অপসারণ এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
দলটির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি অপসারণ প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কোনও আলোচনা হয়নি।
“উপদেষ্টা পরিষদ কী কারণে চাচ্ছেন? উনি থাকলে তাদের সংস্কার কার্যক্রম ব্যাহত হবে কি না? এসব বিষয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেব।”
গণসংহতি আন্দোলন
রাষ্ট্রপতির অপসারণের বিষয়ে দলীয় অবস্থান জানতে চাইলে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি সরাসরি উত্তর এড়িয়ে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা সব সময় বলেছি, জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সরকার গঠন করতে হবে।”
বিজেপি
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টিও (বিজেপি) রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন নিয়ে নিজেদের অবস্থান এখনও ঠিক করতে পারেনি।
দলটির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিষয়টি নিয়ে এখনও আমরা আলোচনা করিনি। বিষয়টি পরিণত হলে তখন কথা বলব।
“এটা আলোচনা করতে হবে। হঠাৎ করেই তিনি (রাষ্ট্রপতি) এমন কথা বললেন কেন? এরমধ্যে ষড়যন্ত্র আছে কি না? সবদলগুলোর সঙ্গে বসে আলাপ- আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
১২ দলীয় জোট
১২ দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দারও জানান, রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে তাদের সিদ্ধান্ত এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমরা এখনও বসি নাই। আলোচনা করে পরে সিদ্ধান্ত নেব।”
আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মো. সাহাবুদ্দিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে ২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিল শপথ নেন। আইন অনুযায়ী, ২০২৮ সালের ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত তার মেয়াদ।
মেয়াদের আগে রাষ্ট্রপতি নিজে পদত্যাগ করতে পারেন, অথবা সংসদের মাধ্যমে তাকে অপসারণ করতে হয়। তবে এই মুহূর্তে দেশে সংসদ নেই। রাষ্ট্রপতি পদত্যাগপত্র যার কাছে দেবেন, সেই স্পিকারও নেই।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বলেন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন এবং সাংবিধানিক সংকটের যে আশঙ্কা দুটি বিষয় নিয়েই তারা আলোচনা করছেন।
“রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের ভিত্তিতেই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারব বলে আশা করি। পদত্যাগের দাবিটা ক্রমান্বয়ে জোরাল হচ্ছে। এটা গণদাবি, সেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে।”