Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

স্বর্ণালী ৩০০ গজ

স্বর্ণাকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেন স্থানীয় সাংসদ আনোয়ারুল আবেদিন খান তুহিন। ছবি : সংগৃহীত
স্বর্ণাকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেন স্থানীয় সাংসদ আনোয়ারুল আবেদিন খান তুহিন। ছবি : সংগৃহীত
Picture of রাহেনুর ইসলাম

রাহেনুর ইসলাম

জন্ম থেকেই কথা বলতে পারে না মেয়েটা। শোনে না কানে। তবু মুখে হাসি লেগেই থাকে সারাক্ষণ। পেটে খিদে থাকলেও অস্থির হয়ে কান্নাকাটি করে যে লাভ নেই, শিখে গিয়েছিল শৈশবে। স্বর্ণা আক্তারের কৃষক বাবা নুরু মিয়ার যে নুন আনতে পান্তা ফুরানো অবস্থা। চার ছেলে-মেয়ে নিয়ে কোনো রকমে তার দিন কাটে ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার চন্ডীপাশা ইউনিয়নের বারুইগ্রামে।

এমন একটা পরিবারে প্রতিবন্ধী শিশুর জন্মই হয়ত অভিশাপ। তবে স্বর্ণা আক্তার আশীর্বাদ হয়ে এসেছে নুরু মিয়ার পরিবারে। এমনকি বাংলাদেশের জন্যও।

ধারের টাকায় গাড়ি ভাড়া

 গত বছর স্পেশাল অলিম্পিকস ওয়ার্ল্ড সামার গেমসের সোনাজয়ী বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিল ১৪ বছরের স্বর্ণা। বাংলাদেশি অধিনায়ক জিতেছিল টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কারও। অথচ বার্লিন থেকে গত বছর ২৮ জুন ঢাকায় ফিরে নিজের গ্রামে যাওয়ার টাকা ছিল না স্বর্ণার কাছে। প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরের পথটা পাড়ি দিতে হয় ধারের টাকায় ভাড়া গাড়ি করে। এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও খোঁজ নেয়নি কেউ।

স্বর্ণার এমন অবহেলা নিয়ে ৫ জুলাই প্রতিবেদন করেছিলেন এই প্রতিবেদক। সেটা নজরে আসতেই পরদিন স্বর্ণার বাড়িতে ফুলের তোড়া নিয়ে আসেন নান্দাইল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আবুল মনসুর। স্বর্ণজয়ী ফুটবল অধিনায়ককে আর্থিক সহায়তা করেন তিনি। নেন চিকিৎসার দায়িত্বও।

পর দিন স্বর্ণাদের বাড়ি আসেন ময়মনসিংহ-৯ আসনের সাংসদ মো. আনোয়ারুল আবেদিন খান তুহিন। ফুলের তোড়া দিয়ে অভিনন্দন জানানোর পর প্রতিশ্রুতি দেন টিনের ভাঙা বাড়ি মেরামত করে দেওয়ার। তিনি চলে যাওয়ার সময় হঠাৎ পথ আটকে ধরে স্বর্ণা। এর কারণ জানতে চাইলে হাত দিয়ে কিছু একটা বোঝাচ্ছিল বোবা মেয়েটি।

স্বর্ণার চাওয়া রাস্তা

পাশেই ছিলেন নান্দাইলের চন্ডীপাশার সেবা ফাউন্ডেশন পরিচালিত সেবা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জিয়াউর রহমান আকন্দ। স্বর্ণা এই স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী। তিনি ব্যাপারটা বুঝে সাংসদকে বলেন,‘‘প্রধান সড়ক থেকে স্বর্ণাদের বাড়ির রাস্তাটা ৩০০ গজ। গ্রামের কয়েকটা বাড়ি আসতে এই রাস্তাটাই একমাত্র ভরসা। রাস্তাটা চলাচল অনুপযোগী। বর্ষায় কাদা আর শুষ্ক মৌসুমে থাকে ধুলোয় ভরা। গ্রামের সবার জন্য রাস্তা মেরামত করার অনুরোধ করছে সে।’’

স্বর্ণার এমন চাওয়ায় বিব্রত হন আনোয়ারুল আবেদিন খান তুহিন। স্থানীয় সংসদ সদস্য হিসেবে গ্রামের এই রাস্তা মেরামতের দায়িত্ব তাঁরই। অথচ খোঁজ নেননি এতদিন। সঙ্গে সঙ্গেই স্বর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে তাঁর ঘোষণা,‘‘তুমি চিন্তা করো না, যত দ্রুত সম্ভব রাস্তা মেরামত করে দিব আমি।’’

পাকা রাস্তা হয়েছে ৩০০ গজ

মন্ত্রী-এমপিরা এমন হাজারো প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভুলেও যান । বারুইগ্রামের মানুষও ভেবেছিলেন এটা কথার কথা। কিন্তু কথা রেখেছেন তুহিন। চন্ডীপাশা ইউনিয়নের বারুইগ্রামের ৩০০ গজের রাস্তাটা মেরামত করে দেন তিনি। মেরামত করে দিয়েছেন স্বর্ণাদের বাড়িও।

বার্লিন থেকে আসার পর ভাঙা বাড়িতে পদক রাখার জায়গা পাচ্ছিল না স্বর্ণা। এখন সেটা ঝুলিয়ে রেখেছে নতুন দেয়ালে। বাড়িতে আসা সবাইকে পদকটা দেখায় আগ্রহ নিয়ে। বেশির ভাগ সময় গায়ে জড়ানো থাকে বার্লিন অলিম্পিক থেকে পাওয়া ট্র্যাকস্যুট।

স্বর্ণা চেয়েছিল বলেই গ্রামের রাস্তাটা হয়েছে পিচ ঢালা। এই নতুন রাস্তাটা যেন স্বর্ণার স্বপ্নের ৩০০ গজ। এখানেই সকালে কয়েক চক্কর দিয়ে ধরে রাখে ফিটনেস। ফুটবল নিয়ে একাকী করে অনুশীলন। সে হয়ত কথা বলতে পারে না। শুনতেও পায়না না। কিন্তু ‍তার কথা শোনে গোল বলটা! স্থানীয়রা অবাক হয়ে দেখে স্বর্ণালী ৩০০ গজে তার ফুটবল শৈলী। একটা সময় বুদ্ধি প্রতিবন্ধী এই মেয়েটাকে ফুটবল খেলতে দেখে টিপ্পনী কাটত তারা। সেই গ্রামবাসীই এখন দেয় হাততালি। গর্বভরে বলে স্বর্ণা আমাদের গ্রামের মেয়ে।

 মেয়ের এমন সাফল্যে খুশি তার বাবা নুরু মিয়া, ‘‘ বছরের পর বছর ব্যবহারের অযোগ্য ছিল রাস্তাটা। পাশের ক্ষেত দিয়ে হেঁটে আসতে হত গ্রামবাসীকে। আমার মেয়ের চাওয়ায় রাস্তাটা ঠিক হয়েছে। এখন খুশি পুরো গ্রামবাসী। মেয়েটাও চোখের সামনে দৌড়ায় এখানে। দেখে খুব ভালো লাগে।’’

জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী হলেও দরিদ্র বাবা নুরু মিয়া সর্বোচ্চ যত্নই করেছেন স্বর্ণার। দুবেলা দু-মুঠো খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খান তিনি। তারপরও স্বর্ণাকে পাঠিয়েছেন চন্ডীপাশার সেবা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে। প্রতিবেশীরা টিপ্পনী দিয়েছেন, ‘‘পাগল পড়িয়ে পয়সা খরচ কেন?’’ তবু দমে যাননি নুরু ‍মিয়া। তপ্ত রোদে বা প্রচণ্ড শীতে কৃষিকাজের ফাঁকে মেয়েকে আনা-নেওয়া করেছেন স্কুল থেকে।

কোচ হবে স্কুলেরই

ভালো ফুটবলার হওয়ায় স্কুলের শিক্ষকেরা বাড়তি যত্ন নিয়েছেন স্বর্ণার। বার্লিন গেমসের আগে ট্যালেন্ট হান্টে নির্বাচিত হওয়ায় স্কুলে বয়ে যায় খুশির বন্যা। এরপর বিকেএসপির ক্যাম্পে নজর কাড়ায় স্বর্ণাকে অধিনায়ক করা হয় বাংলাদেশ মেয়েদের দলের।

স্বর্ণার নেতৃত্বে ফাইনালে ইসরায়েলকে ২-০ গোলে হারিয়ে বাংলাদেশ সোনা জেতে।

এতেই সুনাম বেড়েছে চন্ডীপাশার সেবা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক জিয়াউর রহমান আকন্দ এখন আগলে রাখতে চান প্রিয় ছাত্রীটিকে,‘‘স্বর্ণার মত প্রতিভাবান ফুটবলার পাওয়াটা সৌভাগ্যের। ও চাইলে স্বাভাবিক খেলোয়াড়দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলতে পারে। স্বর্ণাকে আমরা কাজে লাগিয়েছি স্কুলের ফুটবল দল গঠনে। পড়াশোনা শেষ হলে স্বর্ণাকে এই স্কুলেই কোচ হিসেবে রাখব।’’

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত