দক্ষিণ কোরিয়ায় সামরিক আইন জারির পর পার্লামেন্ট সদস্যদের বিরোধিতার মুখে কয়েক ঘণ্টা পরই তা প্রত্যাহার করে নেওয়া দেশটির প্রেসিডেন্ট উন সুক ইয়েল নিজ দলের নেতা হান ডং-হুনকেও গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
গ্রেপ্তার তালিকায় প্রধান বিরোধী দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা লি জে-মিয়ং এবং তিনজন বিরোধী আইনপ্রণেতার নামও ছিল।
দেশটির জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার উপ-পরিচালক হং জাং-উন বলেছেন, “সামরিক আইন জারি করে প্রেসিডেন্ট তাদের গ্রেপ্তার এবং নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছেন।”
এই তথ্য প্রকাশের পর শুক্রবার ক্ষমতাসীন দল পিপল পাওয়ার পার্টি বা পিপিপিসহ দেশটির অন্য রাজনৈতিক দলগুলো জরুরি বৈঠক করেছে। সব দলের পার্লামেন্ট সদস্যরা মিলে প্রেসিডেন্ট উনের বিরুদ্ধে অভিশংসনের প্রস্তাব আনার পরিকল্পনা করেছেন।
এই প্রস্তাব শনিবার পার্লামেন্টে ভোটের জন্য তোলা হতে পারে। ৩০০ আসনের পার্লামেন্টে প্রস্তাবটি পাস করার জন্য লাগবে ২০০ ভোট। প্রস্তাবটি পাস করাতে বিরোধী দলগুলো ছাড়াও ক্ষমতাসীন দলেরও কমপক্ষে ৮ জন এমপির সমর্থন লাগবে।
ক্ষমতাসীন দলও তাদের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে। শুক্রবার প্রেসিডেন্ট উন সুক-ইয়েলের ক্ষমতা দ্রুত স্থগিত করার আহ্বান জানান তার দল পিপিপি প্রধান হান ডং-হুন।
এর আগে হান বলেছিলেন, প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রস্তাবে তারা সমর্থন দেবেন না।
কিন্তু শুক্রবার তিনি বলেন, ‘নতুন প্রকাশিত তথ্য’ প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানে পরিবর্তন এনেছে। কারণ প্রেসিডেন্ট উন ক্ষমতায় থাকলে দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্রের জন্য ‘মহা বিপদ’ সৃষ্টি করবেন।
হান ডং-হুন বলেন, “গত রাতে আমি জানতে পারি যে প্রেসিডেন্ট প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা কমান্ডারকে প্রধান রাজনৈতিক নেতাদের ‘রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি’ হিসাবে আখ্যা দিয়ে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
“দেশকে আরও বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়া থেকে রক্ষার জন্য আমি এর আগে অভিশংসন প্রস্তাব পাস হওয়া ঠেকানোর চেষ্টা করব বলে জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে, দক্ষিণ কোরিয়া ও আমাদের জনগণকে রক্ষার জন্য প্রেসিডেন্ট উনের ক্ষমতা দ্রুত সীমিত করা প্রয়োজন বলে আমি বিশ্বাস করি।”
হান বলেন, “প্রেসিডেন্ট উন তার সামরিক আইন ঘোষণা যে অবৈধ ও ভুল ছিল, তাও স্বীকার করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এরপরও তাকে ক্ষমতায় রাখলে তিনি আবারও এমন চরমপন্থা গ্রহণ করতে পারেন। এ নিয়ে গুরুতর ঝুঁকি রয়েছে।”
হান ডং-হুন বর্তমানে বিচারমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং প্রেসিডেন্ট উনের অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীও। তার এই আহ্বান চলমান সংকট মোকাবিলায় শাসক দলের অবস্থানে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট উন সুক ইয়েল গত মঙ্গলবার গভীর রাতে হঠাৎ করেই টেলিভিশনে এক বিশেষ ভাষণে ‘মার্শাল ল’ বা ‘সামরিক আইন’ জারির ঘোষণা দেন। তবে পার্লামেন্ট সদস্যদের বিরোধিতার মুখে কয়েক ঘণ্টা পরই তিনি তা প্রত্যাহারে বাধ্য হন।
প্রেসিডেন্টের ওই ঘোষণার দুই ঘণ্টার মধ্যেই সরকার ও বিরোধী দলের পার্লামেন্ট সদস্যরা মধ্যরাতেই জাতীয় পরিষদে একত্রিত হয়ে তার এই সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য ভোট দেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের এমন ঘোষণা দেশটির সবাইকে হতবাক করে দেয়। কারণ, দেশটি গত চার দশক ধরে নিজেকে একটি শক্তিশালী গণতন্ত্র হিসাবে গড়ে তুলেছে। সেখানে নিয়মিত প্রতিবাদ এবং সুরক্ষিত স্বাধীনতা বিদ্যমান, যা রক্তাক্ত স্বৈরাচারী শাসনের দীর্ঘ ইতিহাস অতিক্রম করে অর্জিত হয়েছে।
বুধবার সকালে প্রেসিডেন্ট তার সিদ্ধান্ত বাতিল করার পর তাকে অপসারণের দাবিও উঠেছে। বিরোধী দলগুলো প্রেসিডেন্টেকে অপসারণে তার বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রক্রিয়াও শুরু করেছে।
শনিবার প্রেসিডেন্টকে অভিশংসনের বিষয়ে পার্লামেন্টে ভোটাভুটি হতে পারে। অভিশংসন প্রস্তাব পাস হতে হলে ৩০০ সদস্যের জাতীয় পরিষদের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ কমপক্ষে ২০০ সদস্যের ভোট লাগবে। শাসক দলও এখন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে।
স্থানীয় জরিপ সংস্থা রিয়েলমিটারের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকদের মধ্যেও প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৭ জনেরও বেশি প্রেসিডেন্টেকে অভিশংসনের পক্ষে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিশংসনের ঘটনা নতুন নয়। নিজেকে একটি আধুনিক ও সফল গণতন্ত্র হিসেবে দেখা দেশটি এর আগেও একাধিকবার এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার এর আগের ৭ জন প্রেসিডেন্টের মধ্যে ৪ জনই দুর্নীতির অভিযোগে অভিশংসিত বা কারাবন্দি হয়েছেন। ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে দেশটিতে গণতান্ত্রিকভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শুরু হয়।
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা, বিবিসি